আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প - গিনিপিগ

মোটাসোটা - গোলমুখ - চোখ ছোট একজন মানুষ

আশরাফ আলী মজুমদার যতটা উত্তেজনা নিয়ে প্রাণীটা দেখতে গিয়েছিলেন দেখা শেষে তার থেকেও বেশী উত্তেজিত হয়ে বাড়ি ফিরছেন। হাঁটতে হাঁটতে এ মূহুর্তে তিনি ভাবছেন এ ব্যাপারগুলো কেবল তার সাথেই কেন হয়। তিনি কি ভেবে রেখেছিলেন আর কি দেখলেন। কল্পনা ও বাস্তবতার এ ফারাকটা মেঘনার এপাড়-ওপাড়ের মত। মেঘনার যেমন এ কূলে দাঁড়িয়ে অপর কূল আপনি দেখতে পাবেন না , ঠিক তেমনিই আপনারা আশরাফ আলী মজুমদারের কল্পনা ও বাস্তবতার মাঝের তফাৎটুকু ঠিক বুঝতে পারবেন না।

উদাহরন হিসেবে বলা যায় গাধার ব্যাপারটা। তবে গাধা বৃত্তান্তটুকু বলার আগে মানুষটা সর্ম্পকে আপনাদের একটু জানানো না হলে ব্যাপারটা ঠিক জমবে না। আশরাফ আলী মজুমদারের বয়স পঁয়তাল্লিশ। মাঝারী উচ্চতা। গায়ের রং কুচকুচে কালো।

ভরাট গাল। স্বাস্থ্য স্বাভাবিক। চুলে মেহেদী দেয়ায় ওটার রং লাল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসেন। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট কর্মব্যস্ত সময়ের পোষাক।

বিশ্বাস করবেন না কিন্তু তবুও বলি এ মানুষটা যদি টানা সপ্তাহ একই শার্ট - প্যান্ট গায়ে চড়িয়ে আপনাদের সামনে আসে, আপনারা তার শার্টের কোথাও এক ফোঁটা ময়লা পাবেন না। অথচ গাঁয়ের ধুলো-কাদা মাড়ানো অনেকটা পথ তাকে প্রতিদিন হাঁটতে হয়। ঘামের গন্ধ নাই, শার্টের কলারের ভাঁজ ধবধবে সাদা। পেশা শিক্ষকতা। রামচন্দ্রপুর বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের বাইশটি বছর এর মধ্যেই তিনি পার করেছেন।

বউ সুফিয়া খাতুন । এক ছেলে ,এক মেয়ে। বেতনের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের উৎস সবজি চাষ। এ দুয়ের যোগফলে যতটুকু টাকা তার পকেটে আসে তাতে সংসারে নিত্য টানাটানি লেগে থাকলেও তাদের জীবনটা মন্দ কাটে না। বেশ ছোট থাকতেই তিনি বাবাকে হারিয়েছেন।

বিয়ের তিনমাস পর বউয়ের হাতে তাকে তুলে দিয়ে মা হন জান্নাতবাসী । পড়ালেখার অনেক ইচ্ছে ছিল। হয়ে উঠেনি। মেট্রিক পাস করার পর এ স্কুলটাতে ঢুকে পড়েন। তবে তার লেখাপড়া থেমে থাকেনি।

ডিগ্রী না হলেও মনের টানে নিজে নিজে নানা বই-পত্র যোগাড় করেছেন। পড়েছেন, জেনেছেন আর অবাক হয়েছেন। কত কি জানার বাকি আছে! কত বিচিত্র সব জগৎ। মহাপুরুষদের জীবনী হল তার সবচেয়ে প্রিয়। মহামানব, বিখ্যাত মানবদের জীবনী তার মুখস্ত।

বাড়ির দেয়ালে তাদের ছবি। বানী। বানীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাদের মত ভাবতে শিখেছেন। আসরের নামায শেষে পুকুর ঘাটে বসে পানির দিকে তাকিয়ে কিংবা মাগরিবের নামাযের পর উঠোনে শুয়ে রাতের তারায় তারায় ভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবেন, আমরা কে? কোথা থেকে এসেছি? ও তারার জগৎটায় কি কেউ আছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর তার জানা নাই। জানার জন্য তেমন কোন উত্তেজনাও বোধ করেন না তিনি।

তিনি মহামানবদের মত ভাবতে শিখেছেন এটার উত্তেজনাতেই সবকিছু আচ্ছন্ন হয়ে আসে তার। এশার নামাযের আগে পাশের পাড়ার কাজী তাহেরের বাড়ীতে মাঝে মাঝে এক ঘন্টার জন্য হাজিরা দেন। এরা গ্রামের মাথা। তার স্কুলটায় নিয়মিত টাকা পয়সা দেয় ওরা। তাদের সাথে একটু খাতির রাখতেই হয়।

ও জায়গায় বসে থাকতে তার একটুও ভাল লাগে না। কাজী সাহেব বড্ড বকেন। মাঝে মাঝে এমন সব ঠাট্রা করেন যা সহ্যের বাইরে চলে যায়। মাস দুই আগে এশার নামায পড়ে কাজীদের কাছারীতে বসে আছেন। কি নিয়ে জানি কথা হচ্ছিল।

মজুমদার সাহেব খেয়াল করেন নাই। তার মাথায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মানুষটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কত আগের যুগের একটা মানুষের কি সব চিন্তা! অতি সম্প্রতি উনাকে নিয়ে একটা বই পড়ার কারনেই মজুমদারের মাথায় দা ভিঞ্চি সাহেব ঘুরপাক খাচ্ছিল। কাজী সাহেব হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করে, কি মজুমদার! তুমি দেখছ নাকি? আচমকা প্রশ্ন আসায় মজুমদার থতমত খেয়ে বলে, ইয়ে. . .না . . .মানে . . দেখছি। তাই ? কবে দেখছ? কোথায়? এই মানে গত হাটবারে।

কাজী সাহেব আশেপাশের দু-চারজনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, তাই নাকি? হাটে উঠেছিল নাকি? আমি তো দেখলাম না। তোমরা দেখছ নাকি? সবাই একবাক্যে বলে , না। কাজী সাহেব একটু থমথমে গলায় বলে, মজুমদার। তুমি কিসের কথা বলছ? রামছাগলের কথা।

হু। আমরা তো আলাপ করছিলাম গাধাকে নিয়ে। আজকাল তো গাধা দেখাই যায় না। যাক এতদিনে একটা গাধা দেখতে পেলাম। তুমি এখন দেখতে পাচ্ছ তো? মজুমদার কিছু বলে না।

গাধাটা এখানে কে তা ঠিক বুঝতে পারে সে। লজ্জিত হয় । তবে তা কাজী সাহেব তাকে গাধা বলার জন্য না। গাধা নামক প্রাণীটাকে কখনও নিজ চোখে না দেখার লজ্জায়। পরের শুক্রবার ছেলেটাকে হাতে করে চলে যান ঢাকা।

চিড়িয়াখানায় খুঁজে খুঁজে গাধা বের করেন। তারপর মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকেন। ছেলেটা বিরক্ত হয়। গাধাকে আবার এত দেখার কি আছে? গাধাকে পেছনে রেখে ছেলের সাথে ছবি তোলেন। তারপর তার লাল ছোট ডাইরীতে কি কি যেন লিখে রাখেন।

সেই শুরু। তারপর থেকে বই-পুস্তকে যা পড়েন তা তার সামর্থ্যে থাকলে তা করার চেষ্টা করেন। ভাত চটকে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে আয়োডিন টেস্টের কথা অনেকবার ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছেন। অথচ নিজে কোনদিন ব্যাপারটা পরখ করেন নাই। বড় লজ্জার কথা।

তাই প্রথম যেদিন উনি ভাতের মাঝে বেগুনী রংটা দেখেন সেদিন মুগ্ধ হয়ে ওর দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। অবাক হবার জন্য তাকে চীনের প্রাচীর দেখানোর দরকার নাই। তার মাঝে অবাক হবার একটা জন্মগত স্বভাব আছে। এগুলো করতে করতে তিনি ভাবেন আসলেই তো দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া। আজ তিনি গিয়েছিলেন গিনিপগ দেখতে।

বই- পুস্তকে এ প্রাণীটার কথা বিস্তর পড়েছেন। কিন্তু কখনও দেখেন নাই। ভেবেছিলেন কি না কি। আজ দেখলেন। ওমা ! এ দেখি ইঁদুরের মত প্রাণী।

চোখ দুটোতে মায়া আছে। ঘাস খায়। নিরীহ । দক্ষিন আমেরিকার মানুষরা নাকি এদেরকে রোস্ট করে খায়। তাদের আমিষের উৎস! দোকানীর শেষ কথাটা শুনে গা ঘিনঘিন করে তার।

মনে মনে প্রাণীটাকে তিনি বিজ্ঞানের একটা উপকরন হিসেবেই কল্পনা করে রেখেছিলেন। পরীক্ষাগার ছাড়া আর সবকিছুইতে একে বেমানান লাগে। এরা গবেষনাগারে থাকবে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করবে। মানব কল্যান হবে।

এটারে রোস্ট করে খাওয়া-দাওয়া করার দরকার কি? আশরাফ আলী মজুমদার কিছুদিন আগে প্রাইমারী শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে এক সপ্তাহের ট্রেনিং করেছেন। বিষয় মনোবিজ্ঞান। শিশু মনোবিজ্ঞান। এ ব্যাপারে তার গাঁয়ে বসে বই পত্র পাবার সম্ভাবনা কম। প্রতি জুম্মাবার থানা সদরে জুম্মার নামায পড়তে যান আর বেশ কিছুটা সময় প্রশিক্ষন কেন্দ্রের লাইব্রেরীতে কাটিয়ে আসেন।

ওখানে পড়ে আসেন আর উঠোনে শুয়ে তারা দেখতে দেখতে ভাবেন। খাঁচা ভর্তি গিনিপিগ দেখে আসার পর আকাশ ভরা তারার দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় একটা পাগলাটে চিন্তা ধাক্কা মারে। সে থেকে নিজেকে গিনিপিগ ভাবতে থাকলেন তিনি। চারপাশটা মনে হয় একটা বড় খাঁচা। চিন্তাটা এমনি ক্ষ্যাপাটে যে নিজেই নিজের পাগলামীতে হাসতে থাকেন।

এ কথা কারও কাছে বললে সবাই ভাববে মজুমদার একটা পাগল। সে রাতের পর থেকে যতবারই তারাগুলোর দিকে তাকান ততবারই তার মাথায় পাগলাটে চিন্তাটা খেলা করে। চিন্তার ডাল-পালা গজায়। একটা কাঠামোবদ্ধ রূপ নেয় গিনিপিগ বিষয়ক চিন্তাটা। ব্যাপারটা এমন এক পর্যায়ে গেল যে তার পক্ষে আর ঠিক থাকা সম্ভব হল না।

তার ভাবনাটা সর্ম্পকে মতামত দরকার। জ্ঞানী মানুষের মতামত। কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লেখতে বসলেন। কাকে লেখবেন তা বের করতে পারলেন না প্রথমে। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে শুরু করলেন।

প্রাপক বিভাগীয় প্রধান, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চিঠিটা ভাঁজ করে বুক পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন। নজরটা অন্যদিকে দু-তিন সেকেন্ডের জন্য কেবল সরিয়েছেন, এর মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেল। বুক পকেটটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।

ব্যাপারটা এমনই গোলমেলে যে বুকের চামড়াটা একটু পোড়ার আগ পর্যন্ত তিনি সামলে উঠতে পারলেন না। চিঠির কথা তার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেল। বাড়ীর লোকজন সব অস্থির। জীন বা ভূতের আছর। তাড়াতাড়ি মৌলভী আনা হয়।

পুরো গ্রামে দিনভর হৈ-চৈ। এ গন্ডোগলের মধ্যে ডাক্তার আর দেখান হয় না। এশার নামাযের আগে কাজী তাহেরের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন তিনি। হিমাংশু ডাক্তার ওখানেই থাকে এ সময়। বউ তাকে বাধা দিল।

খারাপ নজর পড়েছে। আজ রাতে বাইরে না গেলেই না? তিনি হাসেন। তার মধ্যে এসব গোঁড়ামী মোটেই নাই। তবে এ দিন বউয়ের কথাটা শুনলে হয়ত আরও কিছুটা সময় তিনি পৃথিবীতে থাকতে পারতেন। তার জীবনের সবচেয়ে গূরত্বপূর্ন ব্যাপারটা ঘটে দু- বাড়ি পরের বাঁশঝাড় তলার হালকা কুয়াশার মধ্যে।

সকালবেলার আগুনটার কথা মাথায় থাকায় রাস্তার দিকে তেমন একটা খেয়াল করেননি। প্রায় ধাক্কাই লাগছিল ও মানুষ দুটোর সাথে। লোকগুলো কে তা দেখার জন্য চোখ কুঁচকে তাকান তিনি। চেহারাটা দেখার পর কুঁচকে থাকা চোখের ভুরু দুটো উপরে উঠে যায়। মানুষটার বয়স পঁয়তাল্লিশ।

মাঝারী উচ্চতা। গায়ের রং কুচকুচে কালো। গোলগাল ভরাট গাল। স্বাস্থ্য স্বাভাবিক। চুলে মেহেদী দেয়ায় ওটার রং লাল।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। শার্টের কোথাও এক ফোঁটা ময়লা নাই। ঘামের গন্ধ নাই, শার্টের কলারের ভাঁজ ধবধবে সাদা। চেহারায় আশরাফ আলী মজুমদার।

সাথের মানুষটির গায়ের রং কুচকুচে কাল। মুখে বয়সের ছাপ আছে। গায়ে পোষাক সাধারন। জুতো দুটো অস্বাভাবিক উঁচু। আমাদের মজুমদারের ভূরুটা উঁচুই হয়ে আছে।

উঁচু জুতোর মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলে, মজুমদার সাহেব, আমার নাম অধ্যাপক বোস। আপনার সাথে একটু কথা আছে। আসেন বাঁশঝাড়ের ও পাশটায় যাই। মজুমদার সাহেব যন্ত্রচালিত পায়ে সামনে এগিয়ে যান। তার মাথা কাজ করছে না।

তারা এখন দুজন। মজুমদারের মত দেখতে মানুষটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কারা জানি বাঁশ ঝাড়ের পেছনে কালো দুটো টুল এনে রেখেছে। বসতে বসতে বোসবাবু বলেন, আপনি একজন মহান মানুষ এটা কি আপনি জানেন? মজুমদার সাহেব জানেন না। এবং তিনি মহান মানুষ না।

মহান মানুষরা যন্ত্রের মত অন্যকে অনুসরন করে হাঁটেন না। বোসবাবু বলে চলেছেন, আমরা হাজার বছর ধরে আপনার চিন্তাটার জন্য অপেক্ষা করছি। মানব সভ্যতার জ্ঞানের এমন পর্যায়ে এ ভাবনা আসাটা স্বাভাবিক। কিছুটা কল্পনা আর বেশ খানিকটা জ্ঞান দরকার চিন্তাটার জন্য। আপনার মাথায় চিন্তাটা খেলা করায় আবার ও প্রমানিত হল মানুষ জগৎতের সবচেয়ে রহস্যময় প্রাণ।

এ প্রানীকে কখনও আগে থেকে অনুমান করা যায় না। তবে আপনি যা ভাবছেন তা সবাইকে জানতে দেয়া যায় না। তাই আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে। মজুমদার সাহেব এতক্ষনে গলায় কিছুটা জোর পেলেন। একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বলেন, আপনি কে? হঠাৎ করে কোথা থেকে এলেন? আর ও মানুষটাই বা কে? বোসবাবু হাসতে লাগলেন।

আমি মানুষ। আপনার মতই। আর এসেছি কোথা থেকে? ধরে নিন আপনাদের মতই কোন এক পৃথিবী থেকে। মানব সমাজ ও জ্ঞানের ক্রমবিকাশ নিয়ে আমি গবেষনা করি। মানব সভ্যতার এক অগ্রসর স্তরে সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিয়ে মহা বির্তকের সূচনা ঘটে।

নানা তর্ক-বির্তক এবং রক্তক্ষয়ের পর প্রস্তাবনা হয় কিছু মানব সন্তানকে প্রাণধারনের উপযোগী একটা গ্রহে রেখে সর্তকতার সাথে তাদের পর্যবেক্ষন করা। গ্রহটিকে মানুষের সামাজিক ও জ্ঞানবিকাশ ল্যাবরেটরি পরীক্ষাগার হিসেবে গড়ে তোলা হয়। মানব সন্তানরা কিভাবে একেবারে আদিম পর্যায়ে জ্ঞানের বিকাশ শুরু করে, কিভাবে সমাজ ও সভ্যতা তৈরী হয় তা পর্যবেক্ষন করে মানব উন্মেষের শুরুতে মানব আচরন সর্ম্পকে বিস্তারিত জ্ঞানাজর্নই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল। সে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমাদের কিছু সন্তানদের এ গ্রহের বুকে রেখে যাওয়া হয়। প্রথম প্রজন্মকে একটা বয়স পর্যন্ত সরাসরি নিরাপত্তা দেই আমরা যেন তারা বিলুপ্ত না হয়।

তারপর থেকে আমরা দূর থেকে কেবল তোমাদের পর্যবেক্ষন করি। দেখি তোমাদের বিকাশ। তবে আমাদের জগতের কিছু কিছূ ভিন্নমতের মানুষ মাঝে মাঝে তোমাদের সাহায্য করার নামে উচ্চমানের টেকনোলজী নানাভাবে তোমাদের হাতে তুলে দিয়েছে বলে অনেক সময়ই আদর্শ আচরন কর নাই তোমরা। যুগের আগেই পাওয়া সে টেকনোলজীকে তোমরা ভেবেছ জাদু। মহান আর্শীবাদ।

সৃষ্টি করেছ নানা উপকথা-রূপকথা। আমার পুরো গবেষনার এক মাত্র সংকট ছিল যদি তোমরাও এমন করে মানুষকে গবেষনাগারে নিয়ে গবেষনা শুরু করে দাও তাহলে তোমাদেরকে নিয়ে পরীক্ষা হচ্ছে এমন একটা তোমাদের ভেতর উঁকি দিতে পারে। সন্দেহটা ছড়িয়ে পড়লে আমাদের পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে যেত পারত। এত বছরের সাধনা এক নিমিষেই শেষ। মজুমদার সাহেব কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না।

তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কানটা বন্ধ হয়ে আসছে । কেমন জানি একটা চাপা ধাক্কা দু –কানের উপর। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। এখন কি হবে? যেন তার মনের কথা ভেবেই প্রফেসর বোস বলে, এখন অবশ্য আর কিছুই না।

সব কিছু আগের মত চলবে। কেবল তুমি থাকবে না। শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। মনে হয় বুকের কাছে আগুন লাগায় মাথায় কোন গন্ডগোল শুরু হয়েছে। মজুমদার উশখুশ করে।

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিলেন তিনি। দু’পাও যেতে পারলেন না। বাতাসের সাথে ধাক্কা খেলেন। সে ধাক্কায় চারদিকের অন্ধকারটা কেটে গেল। তার উপর-নিচ, ডান-বাম এখন তারায় তারায় ভরা।

তিনি তারার রাজ্যে উড়ে বেড়াচ্ছেন। প্রফেসর বোস আর দুটো কালো টুল ছাড়া সবখানেই কেবল তারার ঝলকানী ও নিকষ কালো অন্ধকার। এমন দৃশ্য তিনি কেবল ছবিতে দেখেছেন। মহাকাশের ছবিতে। তার চোখে-মুখে ভয়-বিস্ময় এক সাথে খেলা করছে।

খেলার মাঝেই হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যান তিনি। সাদা শার্টের কলারে ফুটে উঠে ঘামের দাগ । প্রফেসর বোস একটা চাপা শ্বাস ছাড়লেন। অনেক আগেই তারা পৃথিবী থেকে একে উঠিয়ে নিলেও শকটা কাটাবার জন্য ওর চারদিকে এতক্ষন পরিচিত পরিবেশটুকুর স্থির চিত্র রাখা হয়েছিল। মজুমদারকে না নিলেও চলত।

ওর চিন্তাকে কেউ পাত্তা দিত না। কিন্তু তারপরও কেউ যদি ব্যাপারটাকে গূরুত্বে সাথে নিয়ে নেয় তাহলে তার সদূরপ্রসারী প্রভাব অনেক। প্রচলিত বিশ্বাসগুলো সব ধ্বসে যাবে। এ ধাক্কাটা সামলানোর মত মানসিকতা এ গ্রহর মানব সভ্যতার আজও হয়নি। সেদিন রাতে রামচন্দ্রপুর গ্রামের সুফিয়া খাতুন স্বামী সহবাসে গিয়ে কি যেন মেলাতে পারেন না।

মজুমদার সাহেবের মধ্যে কি যেন একটা আছে তা তিনি ধরতে পারেন না। মনে হয় এ লোকটা তার কত অচেনা। আসলেই অচেনা। আসল মজুমদার যখন মানব রাজ্যের তীর্থস্থানের পথে তখন নকল মজুমদার তার স্ত্রীর সাথে সহবাসে ব্যস্ত। অতঃপর . . . লেখাটা আরেকটুও লম্বা করার ইচ্ছে আছে।

তাছাড়া বেশ কয়েক জায়গার খাপ ছাড়া অংশগুলো মেলাতে হবে। কিন্তু কলিং বেলের আওয়াজে মনটা বসাতে পারছি না। দরজা খুলে দেখি দরজার সামনে একটা গিনিপিগের খাঁচা। খাঁচার পেছনের মানুষটার বয়স পঁয়তাল্লিশ। মাঝারী উচ্চতা।

গায়ের রং কুচকুচে কালো। গোলগাল ভরাট গাল। স্বাস্থ্য স্বাভাবিক। চুলে মেহেদী দেয়ায় ওটার রং লাল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। শার্টের কোথাও এক ফোঁটা ময়লা নাই। ঘামের গন্ধ নাই, শার্টের কলারের ভাঁজ ধবধবে সাদা। জুতো দুটো অস্বাভাবিক উঁচু। তার পেছনে মানুষটা আমাকে পেছন করে একটা কালো টুলে বসে আছে ।

আরেকটা কালো টুল ফাঁকা। মানুষটাকে পেছন থেকে দেখতে অবিকল আমার মত লাগছে। কুচকুচে কাল মানুষটি পরিষ্কার বাংলায় বলে, সারোয়ার সাহেব, আমার নাম আশরাফ আলী মজুমদার। । আপনার সাথে একটু কথা আছে।

আসেন বসি একটু। আমি গিনিপিগগুলোর দিকে তাকাই। নাকের মাথায় বিশ্রী রকম ঘাম জমে যাওয়ায় চশমার ভেতর দিয়ে ওগুলোকে ভাল করে দেখতে পাই না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।