আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধদিনের স্মৃতিগাঁথা; মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর

Never argue with idiots. They bring you down to their level and then beat you with experience
৩৯ বছর হল দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধের বারুদপোড়া গন্ধ, বধ্যভুমির গলিত লাশ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদেও বীরত্বেও কোন চিহ্ন দেখার সুযোগ হয়নি এ প্রজন্মেও তরুনদের। ঢাকার সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ধরে রেখেছে যুদ্ধদিনের সেইসব স্মৃতিচিহ্নকে। আপনিও দেখে আসতে পারেন ৭১ এর উত্তাল কিছু ঘটনাপ্রবাহের বাস্তব চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর ঘুরে , সন্দীপন বসু মুন্না ।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ছিমছাম ছোট্ট একটি তিনতলা বাড়ি। দেখতে সাদামাটা হলেও বাঙ্গালি জাতির কাছে এই বাড়িটির আকর্ষণ চুম্বকের চেয়েও শক্তিশালী। বাঙালির ঐতিহ্য, বীরত্ব, সংগ্রাম আর ত্যাগের সাক্ষ্য বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত চেতনায়। ‘সত্যেও মুখোমুখি হোন , ইতিহাসকে জানুন’ মুলমন্ত্রকে সামনে রেখে ২২ মার্চ ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর। বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ এবং ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়গত বিভেদেও নামে নৃশংসতার শিকার সব মানুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর।

মুক্তি ও স্বাধীনতার স্পৃহায় দৃড়প্রতিজ্ঞ মানুষই যে পারে সব বাধা বিপত্তি দুর করে এগিয়ে যেতে তারই পরিচয় মেলে ধরেছে এই মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ সংগ্রামে অকুতোভয় জনগণের বিপুল আত্মদান ও মুক্তির স্বপ্নকে বহন করে চলছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর । মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা। এখানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, বই, আলোকচিত্র, চলচ্চিত্র, তথ্য, স্মৃতি সংরক্ষণসহ মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন। এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ও দলিলপত্রাদি সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

যা দেশে নতুন প্রজন্ম পূর্ব পুরুষদের সংগ্রাম এবং দেশের জন্য তাদের মহৎ আত্মত্যাগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করবে। দেশ ও জাতি সম্পর্কে তাদের চেতনাকে শাণিত করার প্রয়াস পাবে। জাদুঘরের প্রবেশ পথেই রয়েছে শিখা চিরন্তন। এ শিখা জ্বলছে পৃথিবীর সেই সব মানবদের উদ্দেশে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন স্বাধীনতার জন্য। এ শিখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পৌঁছে দেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

এছাড়াও প্রবেশপথে প্রদর্শিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ ফজলে রাব্বি-ও ব্যাবহৃত গাড়িটি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বাঙালির অতীত, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উপস্থাপিত হয়েছে ছয়টি গ্যালারির মাধ্যমে। প্রথম গ্যালারি এই গ্যালারিতে বাংলার অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা থেকে স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের সংগ্রামের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আছে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার রেপ্লিকা, প্রাচীন আমলের যুদ্ধাস্ত্র, ঢাল বর্মসহ বিভিন্ন দুর্গ ও নকশার প্রতিকৃতি। এছাড়াও এখানে সংরক্ষিত আছে মহৎ বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের একটি মূর্তি।

১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে রাজা কল্যাণ শ্রী ও রাণী প্রভাবতীর মধ্যমপুত্র চন্দ্রগর্ভ জন্মগ্রহণ করেন। ভিক্ষু হওয়ার পর তার নাম হয় অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ভারতবর্ষে বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ও দন্তপুরী, সামপুরী ও বিক্রমশীল বিহারে অধ্যাপনা ও পরিচালনা করার সময় তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে অতীশ দীপঙ্কর দেহভস্ম ও রচিত গ্রন্থের পান্ডুলিপি চীন থেকে ঢাকায় ধর্মরাজিক বিহারে আনা হয়। সেই পান্ডুলিপির একটি সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে।

দ্বিতীয় গ্যালরি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের দ্বিতীয় গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে মূলত পাকিস্থানি শাসনামল থেকে শুরু করে ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত ইতিহাসের পথপরিক্রমাকে কেন্দ্র করে । এখানে এলে দেখতে পাবেন তৎকালীন পত্রপত্রিকা, পাকিস্থান আমলের শাসন শোষণের বিভিন্ন দলিলপত্র এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রথমধাপের বেশকিছু দুর্লভ ফটোগ্রাফ। তৃতীয় গ্যালারি তৃতীয় গ্যালারির প্রদর্শনী সূচিত হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রামের ডাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ, ১৯৭১ এর উদাত্ত আহ্বানের ছবি ও ঘেষণাপত্রের দ্বারা। এর মাধ্যমে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে জনতার অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এখানে ২৫ মার্চ কালরাত্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার উপস্থাপন রয়েছে।

এছাড়া ছবি, পেপার কাটিং এবং অন্যান্য তথ্যাদির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধেও প্রাক্কআলে তৎকালীন ছাত্র জনতার গণআন্দোলন, পাকিস্থানী হানাদারদেও নৃশংসতা ও গণহত্যা , লাখ লাখ শরণার্থীর দুর্গতির চিত্রও রয়েছে। তাদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেরও দুর্লভ কয়েকটি ফটোগ্রাফও স্থান পেয়েছে এখানে। সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায় উঠার সময় দর্শকরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালীন কিছু ছবি দেখতে পারবেন। এর মধ্যে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের সদস্যভুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং প্রাথমিক প্রতিরোধের অনেক ছবি ; যা যুদ্ধদিনের প্রথমাংশের স্মৃতি বহন করে।

পাকবাহিনীর সংগঠিত নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞের প্রমাণাদি বারান্দায় বিভিন্ন পেপার কাটিং এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। চতুর্থ গ্যালারি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের চতুর্থ গ্যালারিতে আছে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা ও প্রশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন জিনিসপত্র ও দলিলাদি ও যুদ্ধকালীন বিভিন্ন দুর্লভ ফটোগ্রাফ। কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালির ব্যবহৃত জিনিস। এরা পাকবাহিনীর দ্বারা নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। রয়েছে এসব নিহত মুক্তিযোদ্ধার ব্যাবহৃত নানাবিধ বস্তুসামগ্রীসহ বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের ব্যবহৃত সামগ্রী।

চতুর্থ থেকে পঞ্চম গ্যালারিতে যেতে একটি ব্যালকনি। ব্যালকনিতে আছে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্র। সেক্টর কমান্ডার এবং আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান যোদ্ধাদের ছবি সম্বলিত বিস্তারিত বিতরণ দেয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পতাকা, যা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। আরও আছে তৎকালীন দেশী বিদেশী পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ক প্রতিবেদন।

প্রবাসী বাংলাদেশীদের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রচারিত পুস্তিকা ও প্রচারণার দলিল, কিছু দুর্লভ ফটোগ্রাফ এবং ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কৃত ভাষ্কর্য ‘অন্ধকারের উৎস হতে’।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।