আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশ ও আমার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়

seremos como el Che
আজ একটা লজ্জা আর দুঃখ মেশানো মিশ্রবোধ নিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসেছি। এই ধরণের লেখা আমি সাধারণত লিখি না। আমাকে যারা চেনেন না তারাও আমার ব্লগের প্রোফাইলের ছবিটা দেখলে বুঝতে পারবেন যে আমি একজন আশাবাদী মানুষ, একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। এই দেশটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি, শত ব্যর্থতায়ও নিরাশ হইনা কখনো। আশায় থাকি- আজ না হোক কাল, বাঙ্গালীরা উন্নত হবেই।

সামর্থ্য খুব বেশী না থাকলেও যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করি মানুষের জন্য করতে। গত কিছুদিন ধরে মনটা অনেক খারাপ, কেমন যেন উল্টা-পাল্টা লাগছে সবকিছু। কিন্তু না, নিরাশ হইনি, তবে কিছুটা হতাশ যে হইনি সেটা অস্বীকার করব না। সেই সূত্রেই এই লেখাটা লিখতে বসা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি এই লেখাটা লিখতে চাইনি, আমি আর কাউকে হতাশ করতে চাইনি।

আমাদের সন্মানীয় নেতা-নেত্রীবৃন্দ সবসময় একটা কথা বলেন – ‘বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে’। আমি জানি উন্নতি হচ্ছে, স্বাধীনতার সময়ের অর্থনীতির সাথে তুলনা করলে আমরা এখন অনেক উন্নত। কিন্তু এই যে প্রতি বছর আমরা কোটি কোটি টাকার বাজেট করছি, এটা কোথা থেকে আসছে এটা কি আমরা সাধারণ মানুষেরা ভেবে দেখি? বেশী দূরে যাওয়ার দরকার নেই, গতকালের(১০ই ডিসেম্বর, ২০১০) প্রথম আলোর হেডলাইন দেখলেই বুঝতে পারবেনঃ ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পেতে বাংলাদেশকে শর্ত মানতে হবে। ৮৫% পণ্য কিনতে হবে দিল্লি থেকে। ভারতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

এমনিতেই আমাদের জনগণের পেটে ভাই নাই, শীতের কাপড় নাই, এই ঋণের বোঝা কি আমাদের আর আমাদের সন্তানদেরই বহন করতে হবে না? ভাববেন না যে আমাদের নেতাদের সন্তানেরাও আমাদের সাথে থাকবেন, তারা থাকবেন বিদেশে। উন্নত জীবনযাপনে তারা অভ্যস্ত, ‘বাংলাদেশ’ আমাদের মত অভাবী শীর্ণকায় বাঙ্গালীদের ‘মা’ হতে পারে, কিন্তু তাদের নয়। এইসব ট্রাফিক জ্যাম, লোডশেডিং তারা জীবনে কখনও দেখেননি, তাই এই দেশে থাকার প্রশ্নই উঠে না। এই দেশে দূর্ভোগটা শুধু জনগনের কপালেই লেখা থাকে। আমাদের এই গনতন্ত্র আব্রাহাম লিঙ্কনকে এনে দেখাতে পারলে দেখালে তার মুখে ‘ডেমোক্রেসি ইজ দ্যা গর্ভনমেন্ট অফ দ্যা পিপ্‌ল, বাই দ্যা পিপ্‌ল, ফর দ্যা পিপ্‌ল’ এই বুলি ফুটত কিনা সন্দেহ আছে।

এই প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের কথা মনে পড়ছে, স্বাধীনতার পর অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি কোনদিন শর্তযুক্ত ঋণ নিতে চাইতেন না। তিনি বলতেন, আমরা একটি নবজাতক দেশ, আমরা শর্তযুক্ত ঋণ যত নেব ততই নানান দেশের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ব। গতকালের(১০ই ডিসেম্বর, ২০১০) প্রথম আলোর আরেকটি লিড নিউজঃ ‘দুর্নীতির শীর্ষে পুলিশ, পরে জনপ্রশাসন’ শীর্ষক খবরের প্রথম দু’লাইনঃ বাংলাদেশের মানুষ পুলিশ বিভাগকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে জনপ্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও বিচার বিভাগ। আমি ভেবে পাই না যে এই অবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এভাবে চলছে, সবাই নিজের কাজে সৎ থাকলে না আমরা কি করে ফেলতাম! প্রথম আলো’র প্রতিও আমার অনেক অভিমান।

গত ৮ ডিসেম্বর ছিল জন লেননের ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমি পুরো পত্রিকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও এই ব্যাপারে একটি লাইনও পেলাম না, দুঃখ লাগল খুব। চে’র মৃত্যুদিবসেও কেমন যেন দায়সারা লেখা ছাপিয়েছে এ বছর। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়ত আমার ধারণাই ভুল, আমি বেশী আশা করে ফেলি প্রথম আলোর কাছ থেকে। গতকাল একটি স্বনামধন্য পত্রিকার সহ-সম্পাদক বলছিলেন যে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের রাজনীতিবিদরা শিখলেন না যে ওই পদে থেকে কিভাবে আচরন করতে হয়।

অন্যদের কথা বাদ দিলাম, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এর ব্যাতিক্রম নন। তিনি নাকি সম্প্রতি বলেছেন যে ‘বেগম খালেদা জিয়া তার বাড়ির ৭৬টা এসি খুলে নিয়ে গেছে, কিছুদিন আগে শুনেছিলাম তিনি বলেছিলেন যে, ‘কোকো প্যারোলে বের হয়ে নাইট ক্লাবে যায়’(আমি কোন সূত্র দিব না, কারণ আমি এখানে কিছু প্রমান করতে চাচ্ছি না, খালি আমার অনুভূতিটা বলছি)। গতকাল এই সামু ব্লগেই একটা লেখা পড়লাম এই নিয়ে, সময় থাকলে দেখে নিবেন । আবার একহাতেও যে তালি বাজে না সেটাও আমরা সবাই জানি। কারণ বেগম খালেদা জিয়া তার বাড়ির প্রসঙ্গে মিডিয়ার সামনে যেভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তাতে তার নেতাসুলভ চরিত্র যে ফুটে ওঠেনি তা বলাই বাহুল্য।

এই প্রসঙ্গে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী’র একটি কথা বলতে চাচ্ছি- ‘বাঙ্গালি শুধু ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচে, ভাবে সে খুব সুন্দর। সে যে কদর্য, বুঝতে পারে না’(দৈনিক ইত্তেফাক, নভেম্বর ১৬, ২০১০ )। কিন্তু দেশের স্বার্থে এই আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের লড়াই তো কাউকে না কাউকে বন্ধ করতেই হবে। জানিনা কবে সেই সুদিন আসবে আমাদের এই দেশটার। গত কয়েকদিনে ব্লগের পাতায় পাতায় শাহ্‌রুখ খান’কে নিয়ে লেখা দেখতে দেখতে আমার চোখদু’টো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

সেদিন কোন একটি লেখায় পড়ছিলাম যে শাহ্‌রুখ খানের অনুষ্ঠানের সব টিকিটই শেষ(টোটাল টাকার অ্যামাউন্টটা খেয়াল নাই), কিন্তু শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র সরবরাহের জন্য যে চেষ্টাটা করা হচ্ছে সেখানে পাঁচ হাজার টাকাও হয়নি। আপনারা বিনোদন চান, খুব ভাল কথা। দেশে এত লোক দারিদ্রসীমার নীচে অথচ আপনারা কোটিপতি হয়েছেন আরও ভাল কথা। ক্ষুধার জ্বালা, শীতের কষ্ট আপনারা কোনদিন পাননি, আপনাদের এসব বোঝাটাই বরং অস্বাভাবিক। কিন্তু যে আপনারা ২৫,০০০ টাকা দিয়ে একটি টিকিট কাটতে পারেন, সেই আপনারা কি একটা টিকিটের টাকার পাঁচ ভাগের এক ভাগও মানুষের জন্য দিতে পারেন না? কিশোর বয়সে আমার ধারণা ছিল, টাকা না হলে জীবনে কিছুই হল না।

তখন আমার মা আমাকে বলতেন, ‘শোন, জীবনে সৎ থাকবি আর মানুষের মত মানুষ হবি। এরপর তুই যদি গরীবও থাকিস তাহলেও আমি সবার সামনে পরিচয় দেব যে এই আমার ছেলে’। তখন বুঝতাম না এর মমার্থ, এখন বুঝি। আর বুঝি বলেই যে টাকা থেকে মানুষের জন্য কিছুটা দিতেও দ্বিধা হয় সেই টাকার মালিক আমি হতে চাই না কোনদিন। যারা ফেসবুক ইউজার আছেন তারা এই ব্যাপারটা অবশ্যই খেয়াল করে থাকবেন।

বহু ছেলে-মেয়ের পলিটিক্যাল ভিউতে লেখা থাকেঃ ‘আই হেট পলিটিক্স’। নতুন প্রজন্ম কি পেয়েছে? তারা বুঝতে শিখেছে পলিটিক্স মানে ধরপাকড়, মারামারি, খুন-জখম, ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া, রাম-দা আর বন্দুক-পিস্তল হাতে মহড়া। পলিটিক্সের আসল যে অর্থ সেটা বিলুপ্তপ্রায়। পলিটিক্স করা দূরে থাক, ‘আই হেট পলিটিক্স’ বলতে পেরে তারা নিজেদেরকে গর্বিত মনে করে। এর জন্য দায়ী কারা? আমরাই কি এটা তাদের শিখাইনি? প্রতিদিনের পত্রিকা ভর্তি খুন, ধর্ষণ আর ইভটিজিং এর খবর- এসব ছাড়া ওরা শিখবেই বা কি? এবার আমার এক বন্ধুর কথা বলি।

আমার স্কুল জীবনের অনেক প্রিয় বন্ধু। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। নামটা গোপন থাক। গতকালের(১০ই ডিসেম্বর, ২০১০) কথা। বিকালবেলা এই শাহ্‌রুখ খানের অনুষ্ঠানের ভিড় পার হয়ে গিয়েছিলাম ‘তাজউদ্দীন আহমদ পাঠচক্র’তে।

আমার বন্ধুটিও ছিল সাথে। মাত্র এক ঘন্টা বসে থেকে পারলে ও ঘুমিয়ে পড়ে যায়। যাই হোক, আরও কিছু বন্ধুদের সাথে প্ল্যান ছিল যে মুক্ত মঞ্চে ‘শিমুল মুস্তাফা’র একক আবৃতি শুনতে যাব। আমার বন্ধু আমাকে বলে, আরে ধুর, কবিতা আবৃতি শুনে কি করবি? এর চাইতে তুই ওই শাহ্‌রুখ খানের কনসার্টে গেলে ভাল করতি। কি আর বলব, বলার কিছু নাই।

গেলাম রবীন্দ্র সরোবরে। আবৃতি শুনছিঃ আমি কিংবদন্তির কথা বলছি আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি। কবিতার মাঝে নিজের স্বত্ত্বাকে খুঁজে পাচ্ছি। মনের ক্ষুধা নিবৃত হচ্ছে। কিছুক্ষন পরে মঞ্চে আসলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।

আমার বন্ধুটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই এইটা কে রে? নির্মলেন্দু গুণ, আমি বললাম। একটু পরে আবার একই প্রশ্ন। একে একে আমাকে চারবার জিজ্ঞেস করল এই একই প্রশ্নটি। শেষে বলে ‘এই লোক কি কোলকাতার? রবীন্দ্রনাথের মত দেখতে’। আমার আর বলার কিছু ছিলনা, শুধু বললাম, ‘না, ঢাকার কবি’।

আমার এই বন্ধুটির কিন্তু হেভী মেটাল গানের প্রতি অনেক ঝোঁক, সবই শোনে প্রায়। আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন যে আপনি বিদেশী গান শোনেন না? হ্যাঁ, শুনি। কিন্ত এখানে একটা ব্যাপার আছে। আমি হেমন্ত-মান্নাদে থেকে শুরু করে, শচীন, সায়গল, লতা, সন্ধ্যা সবই শুনেছি, অপুর সংসার থেকে শুরু করে রাজ্জাক-ববিতার আলোর মিছিল, উত্তম-সুচিত্রা সবই কম-বেশী জানি আমি। আমি বাঙ্গালীর বেসিক জানি, আর সেজন্যই আবৃতি-সন্ধ্যা, গানের আসর এসব জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করি সময় পেলেই।

আমি সেই বাঙ্গালী নই যারা শুধু ওয়েষ্টার্ন কালচারটা দেখে নিজেদের তাদের অংশ ভাবতে পছন্দ করে আর ‘ইয়ো ম্যান’ টাইপের বাংলিশ কথা বলে নিজেদের জ্ঞান জাহির করে। আমার ঠিক নাম মনে পড়ছে না কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার একটা ভার্সিটির কনভোকেশন অনুষ্ঠানে একজন বক্তা বলেছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের অতীতকে ভুলো না আর দেশের জন্য ছোট্ট হলেও কিছু একটা কোরো’। বাংলাদেশের একটি প্রজন্ম তাদের অতীত জানে কিনা সেটাই সন্দেহ। কিন্তু জিজ্ঞেস করে দেখুন, নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া কতদূর সেটা ঠিকই জানে। হয়ত একটা সময়ে এদেরও মাইকেলের মতই বলতে হবে- হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন; তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

(বঙ্গভাষা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত) এই লেখাটাতে মনের অনেক ক্ষোভ নিংড়ে দিলাম। আসলে দেশটা তো আমাদের, মাঝে মাঝে বুকের গভীরে একটা কষ্ট লাগে। যদি কাউকে আঘাত দিয়ে থাকি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারও যদি মনে হয় আমি কিছু ভুল বলেছি, যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিন, আমি নিজেকে শুধরে নেব। আপনাদের সবাইকে শুভকামনা।

১১ই ডিসেম্বর, ২০১০, ঢাকা।
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.