আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বগালেক ও কেওক্রাডাং: যেতে যেতে একলা পথে--(১ম পর্ব )

মুখোশ

কোরবানি ঈদের পরেরদিন ছিল স্কুলবন্ধু আজিজের বাসায় বিরিয়ানির দাওয়াত। রাতে খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ করেই অ্যালেক্স প্রস্তাব দিল বান্দরবান যাওয়ার। নীলগিরি দেখতে। একরাত দুইদিনের ট্যুর। আমি, অ্যালেক্স আর আজিজ তৎক্ষনাৎ রাজি।

রাতের মধ্যে ফোন করা হল আরো তিনজনকে, তার মধ্যে দুইজন (সাইফুল এবং সৌ্মেন) রাজি। ঠিক হল এই পাঁচজন সকাল সাতটায় একসাথে রওনা দিব। বাসায় ফিরেই বসলাম সামুতে। সাহায্য চেয়ে পোস্ট দিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যে রুশো ভাই (কাউসার রুশো) আর ‘নীল ভোমরা’ তাদের বান্দরবান ট্যুরের লিঙ্কগুলো দিলেন।

সেগুলো পড়ে নীলগিরি’র বদলে বগালেক আর কেওক্রাডাং যাওয়ার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। বান্দরবানের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়ে রওনা হলাম শুক্রবার সকালে। বহদ্দারহাট থেকে বাসে উঠলাম সকাল দশটায়। বাসের মধ্যেই সবাইকে বললাম বগালেক আর কেওক্রাডাং এর কথা। কেওক্রাডং এর কথা শুনে সবাই রোমাঞ্চিত।

এও বললাম ট্যুরের মেয়াদ হয়ত আরো একদিন বাড়তে পারে। আজিজ ছাড়া সবাই রাজি। সবাই একটু বুঝিয়ে আজিজকেও রাজি করালাম। এরপর শুরু হল পরিকল্পনা। কিন্ত পরিকল্পনা’র বুকে হরতাল দিয়ে বান্দরবানের ১০ কিমি মতো আগে বাস এর চাকার হাওয়া ফুডুৎ।

আধঘন্টার মতো এই বিরতিতে রাস্তার পাশের এক দোকানের ছোলাভুনা আর কলার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেল। চাকা বদলানোর পর বাস আবার চলতে শুরু করল পাহাড়ী পথে। অবশেষে দুপুর দেড়টায় পৌছালাম বান্দরবানে। হেঁটে চলে গেলাম রুমা বাস স্টেশনে। এবারের গন্তব্য ৪৩ কিমি দূরবর্তী কইক্ষ্যাংঝিরি।

যাওয়া মাত্র যে বাসটা ছাড়ল তাতে সিট পেলাম না। কি আর করা!!! অপেক্ষা পরের বাসের জন্য। সে বাস ছাড়ল দুপুর আড়াইটায়। এরই ফাঁকে চলল প্রাথমিক ঔষধ কেনাকাটা আর ক্যারম খেলা। প্রথমে বাসের সিটে বসে যাওয়ার প্ল্যান হলেও আমার আর আজিজের দেখাদেখিতে বাকিরাও উঠে এল বাসের ছাদে।

পাহাড়ী খাড়া পথে দুলকি চালে সেই বাসের চলা যেকোনো স্নায়ুদুর্বল লোকের জন্য বিপজ্জনক। অসাধারাণ পাহাড়ী সৌ্ন্দর্য দেখার সাথে সাথে চলল আদিবাসী বোমাং কিশোর মন্টু’র সাথে গল্প। এত মজার মধ্যেও অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত যখন খাড়া রাস্তার দুই পাশের শত শত ফুট গভীর খাদ দেখতাম। বিপজ্জনক সব বাঁকে এবং সরু রাস্তায় বাসচালকের ‘কুছ পরোয়া নেহি’ গাড়ী চালানো দেখে মনে হল যদি ভালভাবে কইক্ষ্যাংঝিরি পৌছাতে পারি তবে তা হবে একটা বোনাস লাইফ। তবে এত উদ্বেগের মাঝেও গান চলল, চলল ছবি তোলা।

প্রায় তিন ঘন্টা পর বাস পৌছাল । বাস ভাড়া মিটিয়ে এবার উঠলাম নৌকায়। সন্ধ্যার আলো আঁধারীর মধ্যে সাংগু নদীর ওপর নৌকা ভেসে চলল। মাঝপথে নৌকা থামিয়ে চাঁদের আলোয় রিপোর্ট করলাম আর্মি ক্যাম্পে। তারপর আবার শুরু নৌকা ভ্রমন।

কয়েকটা ঘাটে যাত্রী উঠানামা করে যখন নৌকা রুমা বাজারের ঘাটে থামল তখন প্রায় রাত আটটা। রুমা বাজারে নেমেই প্রথমে গেলাম হোটেল হিলটনে। রুমা বাজারে দুই হতে তিনটা হোটেল, তার মধ্যে হিলটন এ সবচেয়ে ভাল। কিন্তু হোটেল ম্যানেজার জানালেন কোনো রুম খালি নেই। তবে ভদ্রলোক পাশের এক হোটেলের সন্ধান দিলেন।

সেই হোটেলেই মিলল থাকার জায়গা। হোটেল কেওক্রাডং। বেড়ার ঘরকে ছোট ছোট খুপরি করে সিঙ্গেল আর ডাবল রুম বানানো হয়েছে। হোটেলে উঠেই মনে পড়্ল খাবারের কথা। রুমা বাজারে খাবারের ব্যবস্থা ভাল।

একটি রেস্টুরেন্টে নাশতা সারলাম। রেস্টুরেন্ট মালিকের সাথে কথা হল বারবিকিউ’র ব্যাপারে। ভদ্রলোক রাজি হলেন করে দিতে। সেটা দিয়েই রাতের খাবার সেরে নিলাম। এরপর সবাই বসলাম পরেরদিনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে।

রুমা থেকে বগালেক কিংবা কেওক্রাডাং এ যেতে অবশ্যই গাইড নিতে হয়। সবাই গাইড সমিতিতে গেলাম গাইডের জন্য। সমিতি মালেক নামের একজনকে দিল গাইড হিসেবে। গাইডের প্রাত্যহিক বেতন ৪০০ টাকা। ফর্ম পুরণ আর স্বাক্ষর করে জমা দিলাম গাইডের কাছে।

পরদিন সকাল ছয়টায় আসতে বলে বিদায় দিলাম গাইডকে। সেইসময় পরিচয় হল শোভনদের সাথে। শোভনরা পাঁচ বন্ধু মিলে ঢাকা থেকে এসেছে। তাদেরও কেওক্রাডাং পর্যন্ত যাওয়ার ইচ্ছা আছে। রুমা থেকে কেওক্রাডাং যেতে প্রায় ৩৫ কিমি পাহাড়ী পথ পাড়ি দিতে হয়।

এ পথে ১৬ কিমি মত যাওয়ার পর বগালেক। রুমা থেকে বগালেক যাওয়ার দুইটি পথ আছে। একটি ঝিরিপথ অন্যটি চান্দের গাড়ীর পথ। তবে গাড়ীর পথ দিয়ে বগালেক পর্যন্ত সম্পুর্ণ পৌছানো যায়না। ১০ কিমি মত গিয়ে বাকিটুকু হেঁটে যেতে হয়।

শোভনরা বলল তারা ঝিরিপথ ধরেই যাবে, আমরাও তাই। সকালে একসাথে যাওয়ার কথা বলে বিদায় নিলাম যার যার মত। রুমে গিয়ে কিছুক্ষন কার্ড খেলে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। পরেরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। নাশতা সেরে এবার রওনা হওয়ার পালা।

শোভনরা হাঁটা শুরু করল ঝিরি পথ ধরে। আমরাও হাঁটা শুরু করার প্রাক-মূহুর্তে অ্রালেক্স বলল যেহেতু বগালেক থেকে কেওক্রাডাং পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হবে সেহেতু এই পথটা গাড়িতে করেই যাওয়া যাক্। তাই চান্দের গাড়ি ঠিক করতে গেলাম। সেখানেই পরিচয় হল সিরাজ ভাইদের সাথে। সিরাজ ভাইরাও ৮ জনের একটি দল চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন।

আর্মি ক্যাম্প ও থানায় রিপোর্ট করে দুই গ্রুপ রওনা দিলাম একসাথে। পাহাড়ী খাড়া রাস্তা ধরে চান্দের গাড়ির ড্রাইভারের নির্বিকার গাড়ি চালানো দেখে আমরা সবাই বিস্মিত। ইটের রাস্তায় খাড়া উঠে যাওয়া গাড়ী থেকে যখন নিচের দিকে তাকাতাম তখনতো আত্নারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড়। যাওয়ার পথে কয়েকটি আধিবাসী পাড়ার দেখা মিলল। শ্বাসরুদ্ধকর সেই গাড়ি যাত্রাতে পাহাড়ি সবুজ আর তুলার মত মেঘ যেন ফোঁটা অক্সিজেন।

আর তাতেই নিঃশ্বাসটা যেন ধারাবাহিকতার রসদ পেল। ১১ খিল নামক একটি জায়গায় যখন নামিয়ে দেয়া হল তখন সবাই গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে সাক্ষাত করলাম আমাদের জীবন নিয়ে খেলা (!!!) ‘পাইলট’ ভাইএর সাথে, এরপর শুরু পথচলা। পাহাড়ি পথে কিছুক্ষণ হাঁটার পর পেয়ে গেলাম ঝিরিপথ। বড় বড় পাথরের মধ্যে দিয়ে এবং স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে লাগলাম। ঝর্নার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন কায়দায় ছবিও তোলা হল।

হল। ঝিরিপথে ঘন্টা দেড় হাঁটার পর এই পথ ছেড়ে এক পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে লাগলাম। পথমধ্যে এক আধিবাসী পাড়ার উঠোনে বসে পরলাম। আরও একটি উঁচু পাহাড় পেরিয়ে যখন স্বচ্ছ জলের দেখা পেলাম তখনি বুঝলাম গন্তব্য সমাগত। পাহাড়ের ঢাল কেঁটে বানানো পথ পেরিয়ে পৌছে গেলাম বগালেকের মূল সীমানায়।

ভূ-পৃষ্ট থেকে হাজার ফিট উপরে কয়েকটি পাহাড়ের মাঝখানটায় সূষ্ট এই বগালেক। অতীতের কোনো এক সময় আগ্নেয়গিরির লাভা উদগিরণের পর পরিত্যাক্ত জ্বালামুখে এই লেকের উৎপত্তি বলা হলেও স্থানীয় আধিবাসীদের বিশ্বাস অন্যধরণের। তাদের মতে এটি এক সময় ড্রাগনদের রাজ্য ছিল। বড় বড় পাথর ভর্তি আর স্থান ভেদে কয়েক’শ ফুট গভীর এই উপত্যকা’র সাথে লাগোয়া সমতল ভুমিতে গড়ে উঠেছে পর্যটন বসতি। ৫-৬টি দোকান, একটি স্কুল, কয়েকটি বেঁড়ার গেস্টহাউস নিয়ে গড়ে উঠা এই জনপদের মুল মালিক এবং পরিচালনাকারী আধিবাসীরাই।

অদূরেই পাহাড়ের উপর আর্মি ক্যাম্প। সেখানে গিয়ে রিপোর্ট করলাম সবাই। নাম, ঠিকানা, স্বাক্ষর শেষে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত আমরা উঠলাম এক গেস্ট হাউসে। বগালেকের নীলাভ পানিতে গোসল সেরে গোগ্রাসে গিললাম। দুই ঘন্টার পাহাড়ী পদভ্রমনে ক্লান্ত সবাই তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।

সন্ধ্যায় যখন সেই রাজ্য থেকে ফেরা হল তখন গেস্ট হাউসের বাইরে বেরিয়ে আবিষ্কা্র করলাম আর এক রাজ্যের। আবছা কুয়াশা, চাঁদের আলো আর নীল জলে উপত্যকাটি অদ্ভুত মায়াবী লাগছিল। ঈদের সময় হওয়াতে পর্যটকের আগমনও ছিল বেশি। আর তাই রুপালী আলো আর কুয়াশায় সেই সমতল জায়গাটাতে ছায়ামানুষের অভাব হলনা। এক কোণায় সবাই মিলে আগুন জ্বালালাম।

সেই আগুনের চারপাশে বসে আড্ডা হল, গান হল আর চলল খাওয়া। গভীর রাতে একসময় সবার মনে হলে আমদের ঘুমাতে যাওয়া উচিত, কারণ কালকে খুবভোরেই পথচলা শুরু হবে, রোড টু কেওক্রাডাং। অল্পকিছুক্ষনের মধ্যে তাই সবাই স্বপ্নরাজ্যের অধিপতি…………

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.