আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেড়ি কুকুরের চোখে বাংলাদেশে গণতন্ত্র

আমি কবি নই তোমাদের একজন, আমি কবি নই প্রেমিক তোমাদের...

আমি নেড়ি কুকুর। সাধারণত আমি ইন্টারভিউ দিয়ে থাকি। কিন্তু কোনো গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেয়ার ও মূল প্রবন্ধ পড়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম হচ্ছে আমার। আমার এই ধরনের অভূতপূর্ব উপস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন আজকের এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজক এনার্জি সলিউশন অব বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে ইএসবি নামে প্রতিষ্ঠান এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার কয়েকজন উদ্যমী সাংবাদিক। এরাই আমাকে নিয়ে এসেছেন আপনাদের মতো সুধী ও বিশিষ্ট মানুষজনের সামনে।

আপনারা জানতে চাইতে পারেন এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি কীভাবে ঘটল? কেন এমন একটি গুণী মানুষের সমাবেশে একটা নেড়ি কুকুরের আবির্ভাব ঘটল? আপনাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আমি এই ঘটনার পেছনের ঘটনাটির কথা বলছি। দিনপাঁচেক আগে আমি আমার অভ্যাস মতো খাবারের খোঁজে ডাস্টবিনের পাশে ঘুরঘুর করছিলাম। আমার দেশ পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ঘেরাও করে বললেন, শুক্রবার, তেসরা ডিসে¤¦রে, আমাকে, প্রেসক্লাবে একটা প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে, যার টাইটেল হবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। আমি তাদের বললাম, কুকুরজাতির মধ্যে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। কুকুরাধিকার বলে কিছু নেই এবং আমাদের কোনো কুকুর মাধ্যম বা কুকুরমিডিয়া নেই।

মোট কথা এ বিষয়টি সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান নেই। সুতরাং আমি প্রেসক্লাবে যাব না এবং কোনো প্রবন্ধ পাঠ করব না। ওই সাংবাদিকরা ছিলেন নাছোড়বান্দা। তারা খুব অনুনয়-বিনুনয় করতে থাকলেন। আমি তখন জানতে চাইলাম, কেন তারা কোনো মানুষকে দিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করাচ্ছেন না।

তাদের উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তারা এক বাক্যে বললেন, নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে মূল প্রবন্ধ লেখা ও পড়ার জন্য কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ ৩০ নভে¤¦রে বিরোধী দল বিএনপি আহূত হরতালের কারণে বহু বিশিষ্ট ও গুণী মানুষকে বাড়ির বাইরে কাটাতে হচ্ছে। যে কোনো সময়ে তাদের যে কোনো স্থানে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে, এই আতঙ্কে তারা সবাই নিজের শহরেই পলাতক জীবনযাপন করছেন। বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাড়িতে পুলিশ আগেভাগেই হানা দিয়েছিল।

তাকে তারা পায়নি। কিন্তু তার অভিজ্ঞতার পরে গণতন্ত্রকামী কিন্তু বিরোধী মতাবলম্বী অথবা ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষরা নিজেদের বাড়ির বাইরে থাকছেন। তারা সবাই ‘ঠিকানাবিহীন’ হয়ে গিয়েছেন। সুতরাং তারা আমার পার্মানেন্ট ঠিকানা, অর্থাৎ প্রযতেœ ডাস্টবিন-এ এসেছেন এবং আমাকে পেয়েছেন। তাদের এই দুর্গতি জেনে আমি রাজি হলাম।

তবে আমি আমার দুর্বলতা, অর্থাৎ গণতন্ত্র বিষয়ে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম। আমি বললাম, আমাদের কোনো কুকুরতন্ত্র নেই, কোনো কুকুরাধিকার নেই। আর বাকস্বাধীনতার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা তো কথা বলতে পারি না। আমরা শুধু ঘেউ ঘেউ করতে পারি।

সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমেদ নির্ভয় দিয়ে বললেন, আপনি আমেরিকার ষোড়শতম প্রেসিডেন্ট এব্রাহাম লিংকনের জীবনীটা পড়ে নেবেন। লিংকন ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি এক সন্ধ্যায় থিয়েটার হলে নাটক দেখার সময়ে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। বুঝলাম, প্রায় দেড়শ’ বছর আগে গণতন্ত্র আমেরিকায় যেমন বিপজ্জনক ছিল, ঠিক তেমনি এখন, প্রায় দেড়শ’ বছর পরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হলো।

লিংকন গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মানুষ মারা যাচ্ছে প্রাচীন অস্ত্র লাঠি-বৈঠা-লগির আঘাতে এবং আধুনিক অস্ত্র মোটরসাইকেল হামলায়। মানুষ মারা যাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। মানুষ মারা যাচ্ছে মফস্বল শহর নাটোরে। এমনকি মানুষ, যারা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, তারাও মারা যাচ্ছে ট্রেনে কাটা পড়ে, যেমন সিরাজগঞ্জে।

তাদের দুর্ভাগ্য, তারা বিরোধী দল বিএনপির আহূত একটি গণতান্ত্রিক সমাবেশের পাশ দিয়ে চলাচলকারী ট্রেনের কাছাকাছি ছিলেন। মানুষ মারা যাচ্ছে, মানুষ পিটুনি খাচ্ছে, মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকছে। কেউ কেউ ধরা পড়ছে। হাজতে থাকছে। রিমান্ডে নির্যাতিত অথবা বিবস্ত্র হচ্ছে।

জেলে থাকছে। এই হলো বিরোধী মতাবলম্বী এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের অভিজ্ঞতা বর্তমানের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে। এটাই কি গণতন্ত্র? তাহলে এব্রাহাম লিংকন কী বলেছিলেন যার জন্য মানবজাতি এত আকুলি-বিকুলি করে গণতন্ত্র চায়? খোঁজ নিয়ে জানলাম, ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ শহরে এব্রাহাম লিংকন একটি অনুপ্রাণিত ভাষণে বলেছিলেন, This nation, under God, shall hare a new birth of freedom : and that government of the people, by the people, and for the people, shall not perish from the earth. অর্থাৎ ঈশ্বরের অধীনে, এই জাতি তার মুক্তির একটি নতুন জন্ম পাবে : সেখানে যাকে জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার এবং এই জাতি পৃথিবীতে ধ্বংস হবে না। কেউ কেউ মনে করেন লিংকনের এই উক্তিই গণতন্ত্রের ডেফিনেশন বা সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।

বাংলাদেশের অবস্থা লিংকনের ডেফিনেশনের সঙ্গে তো মিলছে না! আরও খোঁজাখুঁজির পর বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে গণতন্ত্রের এমন ডেফিনেশনটি পেলাম। আইরিশ লেখক অস্কার ওয়াইল্ড, যার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১৯০০ সালে, তিনি ১৮৯৫-এ ‘The soul of Man Under Socialism’ নিবন্ধে লিখেছিলেন : Democracy means simply the bludgeoning of the people by the people for the people. অর্থাৎ গণতন্ত্র মানে, সোজা কথায়, জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণকে লাঠিপেটা করা। অস্কার ওয়াইল্ড সেই ১১৫ বছর আগে জানতেন না যে, বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হবে এবং সেখানে থাকবে আওয়ামী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল। যে দলটি সত্যিই লাঠিপেটানোর গণতন্ত্র চালু করবে। অস্কার ওয়াইল্ড জানতেন না যে ৩০ নভে¤¦র ২০১০-এ বিএনপি আহূত হরতালে তারই কথা আবারও বাংলাদেশে সত্য হবেÑপুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করবে।

কিন্তু এমন অবস্থাতেও যখন পুলিশের নিয়ন্ত্রক আওয়ামী লীগ সরকার তথা আওয়ামী লীগ দাবি করে, দেশে গণতন্ত্র আছে এবং তাদের দলই গণতন্ত্রের ধারক-বাহক, তখন আমি নেড়ি কুকুর, কনফিউসড্ হয়ে গেলাম। বিভ্রান্তিতে পড়লাম। আসলেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায়? বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ে জানলাম ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাতারাতি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির বদলে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান হন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয়।

সব দলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল নামে একটি মাত্র দল গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীতে আরও বলা হয়, জাতীয় দল (অর্থাৎ বাকশাল) গঠনের পর সব সংসদ সদস্যকে বাধ্যতামূলকভাবে এই দলের সদস্য হতে হবে। কেউ সদস্য না হলে, সংসদে তার আসন শূন্য হবে এবং জাতীয় দলের প্রার্থী না হলে তিনি প্রেসিডেন্ট বা সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। ১৯৭৫ থেকে ২০১০। ৩৫ বছর পর আবারও আওয়ামী লীগ সেদিকেই এগিয়ে গিয়েছে।

কোনো বিরোধী মতামত গ্রাহ্য করা হচ্ছে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি সহ্য করা হচ্ছে না। বস্তুত ঠিক ৩৫ বছর আগের মতোই প্রধান বিরোধী দলটিকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা চলছে। তাই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের চর। কী আশ্চর্য ইতিহাস।

যিনি নয় মাস যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, তিনি হচ্ছেন নিন্দিত। আর যিনি পাকিস্তানে নয় মাস বন্দি ছিলেন শুধু তিনিই হচ্ছেন নন্দিত! শুধু তাই নয়, এখন বলা হচ্ছে বাকশালের একদলীয় শাসনও ছিল এক ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগেরই সহযাত্রী দল জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও প্রায় একই ধারণা করেন। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল এরশাদও মনে করেন, তিনিও ছিলেন গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ সেবক। তাই ৬ ডিসে¤¦র ১৯৯০-এ তার স্বৈরাচারী সরকারের পতন দিবসটিকে তিনি ঘোষণা করেছেন সংবিধান রক্ষা দিবস হিসেবে।

অর্থাৎ বাংলাদেশে জোর যার, গণতন্ত্রের ডেফিনিশন তার। ক্ষমতায় যিনি বা যারা থাকবেন, তারাই ঠিক করে দেবেন, গণতন্ত্রটা কী। আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও লেখক মি. মাহমুদুর রহমান বিরোধী অবস্থানে থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। তার জন্য আমি দুঃখ বোধ করছি। এক সময়ে তিনি ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে ছিলেন।

ভোল পালটে তিনি যদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভিড়ে যেতেন তাহলে তার এই দুঃসময় হতো না। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার মধ্যেই ভোল পালটানো মানুষ আছেন যারা এক সময়ে অন্য দল করতেন। সে যাই হোক, অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের কী অবস্থা জানার জন্য কিছু খোঁজখবর নিলাম। জানলাম ব্রিটিশ মডেল গণতন্ত্রে কোনো সংবিধান নেই। ব্রিটিশ প্রজাদের ভক্তি রাজতন্ত্রে।

তাদের আবেগ ফুটবলতন্ত্রেÑযদিও তারা গতকাল খুব হতাশ হয়েছে। ২০১৮-এর ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল তাদের দেশে করার প্রস্তাবটি ফিফা নাকচ করে দিয়েছে। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের প্রকাশ পার্লামেন্টে। আরও জানলাম আমেরিকান মডেল গণতন্ত্রে সংবিধান আছে। বস্তুত আমেরিকাই প্রথম সাংবিধানিক গণতন্ত্র চালু করেছিল।

সংবিধানটি রচনা করেছিলেন টমাস জেফারসন। যিনি ছিলেন আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। তবে বর্তমানে আমেরিকানদের শ্রদ্ধা ডলার ধনতন্ত্রে, লোভ মিডল ইস্ট তেলে এবং আসক্তি ফাস্ট ফুডে। তাদের গণতন্ত্রের প্রকাশ কংগ্রেসে। একদিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ও প্রাইম মিনিস্টার ফর্ম ডেমক্রেসি এবং অন্যদিকে আমেরিকান কংগ্রেস ও প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম ডেমক্রেসির মধ্যে রয়েছে বিশে¡র প্রায় সোয়াশ দেশে একেক ধরনের গণতন্ত্র।

কোনোটা স্ট্রং ডেমক্রেসি। কোনোটা উইক ডেমক্রেসি। কোনোটা লিবারাল ডেমক্রেসি। কোনোটা ইল-লিবারাল ডেমক্রেসি। এদেরই মধ্যে কোনো এক অবস্থানে আছে আজকের বাংলাদেশ।

যেখানে মাহমুদুর রহমান আছেন কাশিমপুর জেলখানায়। তার দোষটা কী ছিল? তিনি কিছু সত্য প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতি সম্পর্কে এবং কিছু বহুল প্রচলিত মতামত প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সাজানো আদালত সম্পর্কে। এসব কথা প্রকাশের অধিকার কি মাহমুদুর রহমানের ছিল না? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমি মানবাধিকার বিষয়ে খোঁজখবর নিলাম। পড়লাম ইউএনডিপি প্রকাশিত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রটি। আপনাদের হয়তো মনে পড়বে ইউএনডিপি বাংলাদেশের এক সময়ের অধিকর্তা মিজ রেনেটা লক-এর সঙ্গে মাহমুদুর রহমানের আদায়-কাচকলার সম্পর্ক ছিল।

কিন্তু তার চেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ওই সর্বজনীন মানবাধিকারগুলোর অধিকাংশ কমবেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার বলতে বোঝায় . ন্যায্য দামে খাবার অধিকার। . নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার। . বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও সার পাওয়ার অধিকার। . পড়াশোনার অধিকার।

. চাকরির অধিকার। . চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার। . নিজের বাড়িতে নিরুপদ্রবে থাকার অধিকার। . ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার। . ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার।

এসব অধিকারই এখন হয়েছে খর্ব, উপেক্ষিত অথবা অপহৃত। যেমন : . চালের দাম ঘুরছে ডেঞ্জার জোন পঁয়ত্রিশ টাকা কেজি থেকে চল্লিশ টাকার মধ্যে। . আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। প্রমাণ, যে কোনো দৈনিক পত্রিকার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা এবং মফস্বল সংবাদ পৃষ্ঠা। . পল্লী বিদ্যুৎ নেই।

শহর বিদ্যুৎ স্বল্প। চুলায় গ্যাসের চাপ কম। গ্যাস স্টেশনে সময় সীমিত এবং ল¤¦া গাড়ির লাইন। শহরে পর্যাপ্ত পানির অভাব। গ্রামে প্রতিশ্রুত বিনামূল্যে সার নেই।

. স্কুলের সময় নিয়ে পরীক্ষা, ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য ও লটারি এবং পাঠ্যবই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা চলছে। . ঘরে ঘরে প্রতিশ্রুত চাকরি হয়নি। বরং গতকালের একটি দৈনিক পত্রিকার হেড লাইন রিপোর্টের মতে, গত ১০ মাসে ৪০,০০০ শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। পাশাপাশি এটাও বলা হয়েছে যে একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদেরই নতুন চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা আছে। . সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।

সেখানেও ডাক্তারদের নিয়ে নির্লজ্জ দলীয়করণ চলছে। . প্রায় ৪০ বছর থাকার পরে নিজের বাড়ির অধিকার হারিয়েছেন বিরোধী নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে, তিনি কেন তার উচ্ছেদের বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলতে গিয়ে কাঁদলেন? এই অভিযোগটি উঠছে তাদেরই কাছ থেকে যারা, ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ স্লোগানে অভ্যস্ত এবং যাদের নেত্রী ইনস্টান্ট কান্নাতে পারদর্শী! . ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার মানুষ হারিয়েছে। মোবাইল ফোন কম্পানি, ব্যাংক, ইলেকশন কমিশন প্রভৃতির দৌরাÍ্যে এই দেশের মানুষকে তাদের অনেক গোপনীয়তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘটনাটি ঘটেছে ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার পরে এবং উচ্ছেদকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী সেই বাড়ি সিলগালা করার পরে।

তারপর নির্ধারিত সাংবাদিকদের দেখানো হয়েছে ওয়াইন বটল, সফট ড্রিংকস ক্যান, গার্লি ম্যাগাজিন ইত্যাদি। চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনও বিটিভিতে সেই চেষ্টা চলছে যে বিরোধী নেত্রী বিলাসী এবং অসংযমী জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। নেড়ি কুকুর হিসেবে যেহেতু আমার যাতায়াত কিছুটা সহজ, এমনকি ক্যান্টনমেন্টেও, আমি জানতে পেরেছি, খালেদা জিয়া মিনারাল ওয়াটার দিয়ে গোসল করেন সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক ক্রেইট মামস মিনারাল ওয়াটার বটল তার বাড়িতে নেয়া হচ্ছিল। সেগুলো পথেই মিসিং হয়ে যায়। তারেক রহমানের ঘরে একটা বার ছিল, সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক বটল হুইস্কি-জিন এবং কয়েক ক্যান বিয়ার পাঠানো হচ্ছিল।

সেগুলোও পথিমধ্যে মিসিং হয়ে যায়। খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পরপরই তার বেডরুম থেকে মিসিং হয়ে যায় বহু কসমেটিক্স সামগ্রী, যেসব পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী পৌঁছে দেয়া হয় মন্ত্রিসভার একাধিক মহিলা মন্ত্রীদের কাছে। হয়তো তারা ভেবেছেন, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি হতে হলে, ইউনিলিভারের নয়। খালেদা জিয়ার কসমেটিক্সকেই নির্ভরযোগ্য মনে করতে হবে। এ রকম বহু অপ্রকাশিত ঘটনার উল্লেখ আমি নেড়ি কুকুর করতে পারি।

আপনারা হয়তো বলবেন, আমার এসব কথা মিথ্যা, এসব প্রপাগান্ডা। আমার উত্তর হবে আইএসপিআর যা বলেছে, বিটিভি এবং তার সহযোগী কিছু মিডিয়া যা প্রচার করে চলেছে সেগুলো কী? অকথ্য-অশ্লীল, অসত্য-অসভ্য প্রপাগান্ডা? . মানবাধিকার প্রসঙ্গে শেষ কথা হলো মানুষ এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার হারিয়েছে। মাহমুদুর রহমান কি ন্যায়বিচার পেয়েছেন? যে অর্থদণ্ড তার ওপর আরোপিত হয়েছে, সেটা কি সঠিক? তার জেলদণ্ডের মেয়াদ কী? জেলে থাকার ছয় মাস তো আজ পূরণ হলো। তিনি কি মুক্ত হয়ে আমাদের মাঝখানে আসতে পেরেছেন? ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে আমি বিশেষত দুটি দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এক. রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে বিবস্ত্র করা, যেমনটা মাহমুদুর রহমানকে করা হয়েছিল এবং নৃশংস নির্যাতন করা এখন কালচারে পরিণত হয়েছে।

যাকে বলা যায় টর্চার কালচার। এই কালচারের পরিণাম হচ্ছে মৃত্যু। গতকালও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নরসিংদীর রায়পুরা থানা পুলিশের নির্যাতনে ৩০ বছর বয়স্ক আসামি সিরাজ মিয়ার মৃত্যু হয়েছে। এই টর্চার কালচার বিষয়ে বাংলাদেশের অতীতের সুশীল কিন্তু বর্তমানের কুশীল সমাজ নীরব আছেন। আমার অনুরোধ, আপনারা সবাই টর্চার কালচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন।

তবে কুকুর জাতির বিবস্ত্র হওয়ার সমস্যা নেই। মানুষের মতো সভ্য হয়ে আবার অসভ্য আমরা হইনি। আমরা সর্বক্ষণই বিবস্ত্র থাকি। ন্যাংটার আবার ডিবি পুলিশের ভয় কী? আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে গণসমন জারি করা। ওয়ান-ইলেভেনের পর সেনা-সমর্থিত সরকারের সময়ে টর্চার কালচার চালু হওয়ার পাশাপাশি গণসমন জারি শুরু হয়েছিল।

সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে। আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিকদের টাইট রাখার লক্ষ্যে প্রায় ১০০ অজ্ঞাতনামা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। অন্য এক্সট্রিম বা মেরুতে সিরাজগঞ্জে কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছে। এই গণসমন কালচারের বিরুদ্ধেও আপনারা সোচ্চার হোন। আমি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা এতক্ষণ বলেছি।

তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আমাকে বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। এ বিষয়ে এখন যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। কারণ, বাকস্বাধীনতার অভাব হয়েছে বলেই মাহমুদুর রহমান কাশিমপুরে, বাংলাভিশনের উপস্থাপক কাজী জেসিন অদৃশ্য। দিগন্ত টিভিতে উপস্থাপক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী অনুপস্থিত। সুতরাং বাকস্বাধীনতার বিষয়ে বেশি কিছু আর বলব না।

আপনারাই বুঝে নিন। আমি শুধু আমেরিকার সংবিধান রচয়িতা টমাস জেফারসনের একটি উক্তি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। টমাস জেফারসন বলেছিলেন, When injustice becomes law, Resistance becomes duty. অর্থাৎ, অবিচার যখন হয় আইন, তখন প্রতিরোধ হয় কর্তব্য। ধন্যবাদ সবাইকে এতক্ষণ শোনার জন্য। ঘেউ ঘেউ।

– জাতীয় প্রেসক্লাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ । # শফিক রেহমান #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.