আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন স্বাপ্নিক সঞ্জীব -- অন্তরঙ্গ আলোকে দেখা


ধন্যবাদ এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল । সঞ্জীবের মৃত্যুর সঠিক দিনটা উল্লেখ করায়। প্রকৃতপক্ষে সঞ্জীব এ মর্ত্যলোকর মায়া ত্যাগ করে সেই অজানা দেশে চলে গেছেন ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর। আজ সকাল থেকেই কেন যেন সঞ্জীব আমার ভাবনায় বার বার আসছিল এবং মনে হচ্ছিল আজই তার মৃত্যুদিবস। (বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গনে ধুমকেতুর মতনই আর্বিভাব ছিল তার।

ধুমকেতুর মতোনই সহসা হারিয়ে গেলেন দলছুট সঞ্জীব চৌধুরী। বন্ধুবর সঞ্জীবের আকষ্মিক মৃত্যুতে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিতে লেখা "একজন স্বাপ্নিক সঞ্জীব -- অন্তরঙ্গ আলোকে দেখা" প্রথম প্রকাশিত হয় মুক্তমনা ব্লগে তার প্রয়াণের পর পরই) এক যতোটুকু নৈকট্য, অন্তরঙ্গতা থাকলে মানুষ তার জীবনের গোপন কথা র্নিদ্বিধায় প্রকাশ করে থাকে, সঞ্জীবের সাথে আমার সম্পর্কের গভীরতা ঠিক ততোখানিই ছিল। সঞ্জীব চৌধুরী। সাংবাদিক, কবি, শিল্পী, গীতিকার, অভিনেতাবহুসত্তায় বিভাজিত সব্যসাচী প্রাণবন্ত এক যুবক। নতুন প্রজন্মের ভক্তদের কাছে দলছুটের প্রিয় গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সতীর্থ, ঘনিষ্ট বন্ধু সঞ্জীব। সঞ্জীবের সাথে ঠিক কখন আমার পরিচয় হয় তা আমার স্মরণে নেই। তবে তা নিশ্চয়ই ১৯৮১ সালে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনার প্রথম ভাগেই। সম্ভবতঃ মিতুর (কাজী শামীম সুলতানা, বর্তমানে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরঅধ্যাপক) মাধ্যমে ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। কী জানি, কি কারণে দ্রুতলয়ে আমাদের সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পঠিত বিষয় ভিন্নতর হওয়া সত্ত্বেও (আমার বিষয় ছিল পদার্থ বিজ্ঞান। আর ও শুরুতে গণিতে ভর্তি হলেও বিভিন্ন কারণে তা শেষ না করে পাস কোর্সে স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী করে সাংবাদিকতায়। ) আমাদের মেলামেশার মাত্রা সীমায়িত ছিল না। বুয়েট কোয়াটারে আমার তখনকার বাসায়, উর্দু রোডে ওর বাসায়,জগন্নাথ হলে, কার্জন হলে, টি. এস. সি-তে কখনো বা সোরওয়ার্দী উদ্যানে চলতো আমাদের নিত্যদিনের আড্ডা। কখনো বা দল বেধে, কিংবা কখনো শুধু সঞ্জীব আর আমি।

এসব আড্ডার সময় অসময় ছিল না। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কিংবা রাত। মনে পড়ে, একদিন রাত দশটা কিংবা এগারোটা-- সোরওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ ঘাসে শুয়ে শুয়ে সঞ্জীবের সুরেলা কন্ঠে গান শোনা আর তারা ভরা আকাশে গ্রহ নক্ষত্র চেনার অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা। তখন চলছে দানবীয় স্বৈরশাসন। সেলিম, দেলোয়ার, বসুনীয়া, ময়েজ উদ্দীন সহ একে একে অনেক স্বৈরাচার বিরোধী প্রতিবাদী মানুষের রক্তে স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের হাত রঞ্জিত।

রক্তঝরা সেই দিনগুলোতে অতি কাছ থেকে দেখেছি সঞ্জীবের রাজনৈতিক কর্মকান্ড। ও ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক শাখার একজন সক্রিয়, পুরোধা কর্মী। রাজপথের মিছিলে, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঞ্জীবের ছিল দূর্বার উপস্থিতি। সম্ভবতঃ সঞ্জীবের প্রভাবেই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকান্ডে আমিও জড়িয়ে পড়ি, উৎসাহিত হই মাক্সীয় দর্শনে। দ্বান্দিকবস্তুবাদের কঠিন তত্ত্ব, মাক্সীয় অর্থনীতি, উদ্বৃত্ত মূল্য এবং উৎপাদন সম্পর্কের মতোন জটিল বিষয়সমূহ সঞ্জীবের প্রাঞ্জল বিশ্লেষণে গল্পের মতোই আমার কাছে হয়ে পড়তো সহজবোধ্য।

সঞ্জীবের রাজনৈতিক চেতনার পেছনে কাজ করতো গণমানুষের মুক্তি, সাম্যবাদের সুর। বাম রাজনীতির প্রথম শর্ত হচ্ছে, শ্রেনীচ্যূত হওয়া। সঞ্জীব সত্যি সত্যিই হতে পেরেছিল শ্রেনীচ্যূত। তাই আমি দেখেছি, সমাজের নীঁচুতলার মানুষ, যেমন জগন্নাথ হলের পিয়ন, সুইপার এদের সাথে সঞ্জীবের সহজ সরল আচরণ এবং ঘনিষ্ট মেলামেশা। এসব ক্ষেত্রে ওর মনে শ্রেনী চেতনা কাজ করতো না এতোটুকুও।

এ সময়েই কবি-লেখক হিসেবে বিভিনড়ব পত্রপত্রিকায়, লিটল ম্যাগাজিনে ওর আত্মপ্রকাশ হতে শুরু করে। ওর কবিতা প্রতিভার গুণমুগ্ধ শুধুমাত্র আমিই নই বরং সেই সূচনালগ্নে ওর লেখার প্রশংসায় উচ্চকিত ছিলেন প্রয়াত লেখক বুদ্ধিজীবি আহমদ ছফা। আমি হলফ করে বলতে পারি, আহমদ ছফার মতোন একজন রগচটা মানুষের স্নেহের প্রশ্রয় পেয়েছিল শুধমাত্র ওর লেখার সম্মোহনী মন্ত্রে। ছন্দের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সঞ্জীব সে সময় করছিল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কবিতার বহুরূপী ছন্দ -- অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত কিংবা পয়ারের ব্যাকরণ ওর প্ররোচনাতেই উন্মোচিত হতে শুরু করে আমার সামনে।

ও ছিল স্বভাব কবি। প্রকৃতি দত্ত তাৎক্ষণিক কবিতা লেখায় ওর ছিল অদ্ভূৎ পারদশীতা। এমনি একটি তাৎক্ষণিক লেখা ওর কবিতা আপন মহিমায় আজো আমার পুরানো ডায়েরীর পাতায় সাক্ষর বহন করছে। শিরোনামহীন ওর ঐ কবিতার পংক্তিমালা- কাঠের ভিতর শিল্প ছিল শিল্পী ছিল দূরে লরী বোঝাই কাঠ পোড়ছে মালিবাগের মোড়ে। রাজারবাগের মোড় ধোঁয়াটে জানালাগুলো বন্ধ শিল্পীরা নব নাক ধরেছে পোড়া কাঠের গন্ধ।

কাঠের ভেতর উঁই পোকারা মরণ জ্বালায় বিদ্ধ শিল্পী বলে মৃত্যুবাণে শিল্প হল সিদ্ধ। সেই তিরাশী সালে লেখা এই কবিতায় সঞ্জীব মৃত্যুর মাঝে শিল্পের সার্থকতা খুজেঁ পেয়েছিল। মৃত্যুর ওপাড়ে দাঁড়ানো ওকে আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, “মৃত্যুতে বিলীন হয়ে আজ তোর শিল্পীত জীবন হয়েছে কি সিদ্ধ? মনে আছে তোর, ঘোর অবিশ্বাসের মধ্যেও আমাদের মাঝে আলোচিত হয়েছিল জীবাত্মা আর পরমাত্মার মিলন প্রসঙ্গে। দোস্ত, ওখানে কি সত্যি সত্যিই রয়েছে ঐ সব ব্যাপার স্যাপার?” দুই তিরানব্বইর শেষভাবে আমার যুক্তরাজ্য গমন এবং সেখানে সুদীর্ঘ সময় বসবাসের কারণে ক্রমশঃ সঞ্জীবের সাথে আমার একধরণের বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়। নিবানব্বইয়ে দেশে ফিরে সঞ্জীবের সাথে মাঝে মধ্যে দেখা করি ওর কর্মস্থল পত্রিকা অফিসে।

ওর কাজের অবকাশে মাঝে মধ্যেই কথা হতো বিভিন্ন বিষয়ে। অতীত স্মৃতিচারণ এবং ভবিষ্যতের গল্প। জন্মগত ভাবেই ও ছিল একজন স্বাপ্নিক। নিজে স্বপ্ন দেখতো এবং অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসতো। ও সমাজতন্ত্রের কথা বলতো, বলতো মেহনতী মানুষের মুক্তির কথা।

বলতো সম্পদের সুষম বন্টনের কথা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধেও ও ছিলো সোচ্চার। ইতোমধ্যে সংগীত জগতে একজন উজ্জ্বল তারকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আমার বন্ধু সঞ্জীব। ওর ব্যস্তময় শিল্পী জীবন এবং আমার পেশাগত জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় একই শহরে থেকেও আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তবে মাঝে মধ্যে সিডিতে, টিভিতে ওর গান শুনতাম।

ভালো লাগতো ওর দরদী সুরেলা কন্ঠে গাওয়া গানের রেশে বুঁদ হয়ে থাকতে। হয়তো ইশ্বরের ইচ্ছে। ওর ক্লিনিকালী মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে ওর সাথে আমার কর্মস্থল এ. আই. ইউ. বি-র আয়োজিত ওর ব্যান্ড দলছুটের কনসার্টে দেখা। দেখা হলো সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য। আমাদের অনুষ্ঠান শেষ করে দলছুটকে যেতে হবে সেই সাতক্ষীরায়।

তাই অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতা। সহ শিল্পী বাপ্পার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সঞ্জীব শুরু করলো সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প। স্মরণ করিয়ে দিল তিরাশীর র্ফেরুয়ারীতে আমাদের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন মৈনাকের কথা। সময়ের স্বল্পতার কারণে আড্ডা জমে উঠেনি। দু’জনে মোবাইল নম্বর বিনিময় করে নিয়মিতযোগাযোগ রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম।

সম্ভবতঃ ইশ্বর সে সময় মুচকি হেসেছিলেন। দলছুট নামটা, আমার ধারনা সঞ্জীবেরই দেওয়া। সঞ্জীব নিজেই তো ছিল দলছুট। ওর বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা, প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনা, প্রথা বিরোধী কার্য্যক্রম ইত্যাদি কারণে ওকে যেন সমকালীন মানুষের সাথে ঠিক মানাতো না। সম্ভবত: মনে মনে সে ছিল ভীষণ একাকী, পৃথিবীর বুকে এক নিঃসঙ্গ পথিক।

এ বিষয়ে ও হয়তো ছিল সচেতন। তাই কি ও গেয়ে ওঠে- আমি তোমাকেই বলে দেব কী যে একা দীর্ঘরাত আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে আমি তোমাকেই বলে দেব সেই ভুলে ভরা গল্প কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায় ছুঁয়ে কানড়বার রং, ছুঁয়ে জ্যোছনার ছায়া।
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.