আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতঃপর ! আমি বন্ধু-হারা, আমরা বন্ধু-হারা-২

কাতর প্রভাত যাতনা ভারে যখনই হইবে ভারী, এক পেয়ালা কুয়াশা তুলিয়া চলিব রাতের বাড়ি।

অতঃপর! আমি বন্ধু-হারা, আমরা বন্ধু-হারা-১ পুলিশ অপেক্ষা করছিল ঘাটেই। আমরা সবাই উঠে আসলাম উপরে। শুরু হলো সাধারণ মানুষ, পুলিশ আর সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ। ক্লান্ত হয়ে গেলাম।

আর পারছিনা কেউ। পুলিশকে বললাম, আমারা রাঙ্গামাটিতে একটা হোটেলে উঠেছিলাম সেখানেই আমাদের কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা সবকিছু। শীতের রাত পাহাড়ি এলাকা অথচ আমাদের সবার গায়েই পাতলা জামাকাপড় । তাই আমাদের কে রাঙ্গামাটি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। আমরা তিনজন যাবো, লাগেজ নিয়েই আবার চলে আসবো।

কারো পকেটে তেমন টাকাও নেই যা ছিল তা জেলেদের দিয়েই শেষ। পুলিশ জানালো এখন যাওয়াটা বিপদজনক না যাওয়াটাই ভালো হবে। কিন্তু আমাদের কোন উপায় নেই যেতেই হবে। অনুমতি পেলাম যাওয়ার। কিন্তু কোন সি, এন, জি যেতে রাজি হচ্ছে না।

(সি, এন, জি ছাড়া বিকল্প আর কোন যান নেই। ) সে রাস্তায় নাকি এখন কিছুতেই যাওয়া যাবেনা। অবশেষে এক বড়ভাইয়ের সহায়তায় একটা সি, এন, জি পেলাম সে মোটামোটি জোড় করেই সি, এন, জি চালককে আমাদের সাথে পাঠালো। আর এক মূহুর্তও দেরী করলাম না। রওনা দিলাম আমরা তিনজন।

ঘুটঘুটে অন্ধকার, আঁকাবাঁকা, ভাঙ্গা পথ। মানুষ দূরে থাক একটা কুকুরও রাস্তায় নেই। তিনজনের মনেই আতঙ্ক। কিন্তু কেউ কোন কথা বলছিনা শীতে গুটিসুটি হয়ে বসে আছি সি, এন, জির ভেতরে। কিন্তু শীত কিছুতেই মানছেনা।

চালককে আগেই বলে নিয়েছি কেউ সি, এন, জি থামাতে চাইলে কিছুতেই থামানো যাবেনা। পরে যা ঘটার ঘটবে। আবার টেনশন হচ্ছে পুলিশের হেফাজতে বাকিদের না জানি কি অবস্থা। হঠাত সামনের দিকে একটা বাতি জলতে দেখলাম কোন সিগন্যাল মনে হচ্ছে। ড্রাইভার বললো আর্মি ক্যাম্প।

ঠিক আছে থামাও। সি, এন, জি থামতেই দেখলাম চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলা হল। একজন আসলো কাছে। কোত্থেকে এসেছেন এত রাতে, কোথায় যাচ্ছেন? জ্বী! আমরা আজকেই ঢাকা থেকে এসেছি। রাঙ্গামাটি হোটেলে উঠেছিলাম কিন্তু কাপ্তাইতে আমাদের এক আত্মিয়ের বাড়িতে যাওয়ার পর কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছেনা।

(এই মিথ্যেটা তখন বলতেই হল) আমরা ১০ জন এসেছি। বাকিরা সেখানেই আছে। আমরা হোটেল থেকে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে আবার এখনই চলে আসবো। আপ্নারা কয়টা পর্যন্ত ডিউটিতে আছেন? আমাদের কিছুই না বলে চালককে ধমকানো শুরু করলো! এই গাধা তুই যে এদের এই পথে এই রাতের বেলা নিয়ে আসছিস এখন কোন দূর্ঘটনা ঘটলে এর দায় কে নিবে, তুই নিবি? ড্রাইভারতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। না স্যার আপ্নারাতো আছেনই আর আমরা এখনই আবার চলে আসবো।

আমাদের উদ্দেশ্যে, যান ১০ টার মধ্যে ব্যাক কর্বেন। (সময়টা অনুমান করতে পারলাম। এতক্ষন যাবত আমাদের কোন সময়ের হিসেব ছিল না। ) জ্বী আচ্ছা। কিছুদূর অগ্রসর হতেই আবার একই কাহিনী।

এবার বি, ডি, আর। সেখান থেকেও একই কথা বলে রক্ষে পেলাম। হোটেলে ফিরতেই নৌকার মালিক চলে আসলো। তাকে তার পাওনা টাকা দিতেই বললো, ভাই টাকা লাগবোনা। আপ্নেরা খুব বিপদে পরছেন।

আমি সব শুনছি। যান আল্লাহ ভরসা কোন সমস্যা হইবোনা। তার চোখের দিকে তাকাতেই দেখলাম একজোড়া দরদী চোখ। তার চোখে মায়া দেখতে পেলাম আর বুঝতে পারলাম কতটা অসহায় আমরা এই মুহুর্তে। এই টাকাটা না পেলে হয়তো তারও খাওয়া হবে না আজকে ।

তার নৌকাটাও এখনো পুলিশের হেফাজতে কালকে ভাড়া দিতে পারবে কিনা তারও কোন ঠিক নেই তারপরেও সে তার নিজের দিক চিন্তা না করে আমাদের বিপদটাই বড় করে দেখছে। চোখে পানি এসে গেল। তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার হাতে টাকাটা গুজে দিয়েই আমরা বেড়িয়ে গেলাম হোটেলের বিল পরিশোধ করে। সি, এন, জি তে উঠার আগে কিছু পরোটা আর সবজি কিনে নিলাম। সেই সকাল ৬.০০ টার দিকে নাস্তা করেছি এখন রাত প্রায় ১০.00 বাজে কারোরই কিছু খাওয়া হয়নি।

প্রচন্ড ক্ষুধা । কিন্তু কেউই ঠিক মত খেতে পারছিনা। কারোরই গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। আবার ও সেই ভয়ংকর পথ দিয়েই ফিরতে লাগলাম। এবার আর আর্মি বি, ডি, কেউই থামালো না তাদের ডিউটি কি শেষ নাকি চিনতে পেরে থামায়নি এটা বুঝলাম্না।

তার মধ্যে শুরু হল সি, এন, জি তে ঝামেলা। গাড়ি স্লো করলেই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। যেই ভাঙ্গা পথ স্লো না করেও উপায় নেই। আর একবার বন্ধ হলেই কমপক্ষে ৫ মিনিট। ড্রাইভারের হাতও অবশ হয়ে যাচ্ছে বার বার এই গিয়ার ঝামেলা মেরামত করতে করতে।

যাই হোক, সি, এন, জি চলছে মনের মধ্যে বিভিন্ন স্মৃতি বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগলো। তারই মধ্যে হঠাৎ সি, এন, জি থামিয়ে ড্রাইভার পেছন দিকে দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। নিশ্চিত বড় ধরনের কোন বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। তিনজন তিনজনের মুখের দিকে চেয়ে বের হয়ে দাড়ালাম ।

চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার আশে পাশে শুধু জঙ্গল চোখে পড়লো। তিন জন সিন্ধান্ত নিলাম। ড্রাইভারের সাথে যদি একজনও দেখি তবে যে যেখানে পারি দৌড়ে পালাবো। সতর্ক দৃষ্টি রাখলাম তার ফিরে আসার পথে আবছা আবছা কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। হ্যা আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে আমরা তিনজনও প্রস্তুত।

না ড্রাইভার একাই পাশে অন্য কেহ নাই। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কি ভাই হঠাৎ এভাবে দৌড় দিলেন ক্যান? আরে আমার মানিব্যাগ পইরা গেছিলো তাই মানিব্যাগটা তুলতে গেছি। ধুর! মিয়া কইয়া যাইবেন না। আমরাতো ভয় পায়া গেছিলাম।

ওহ! ভুল হয়া গেছে ভাই। আমার বইলা যাওয়া উচিত ছিল। যাই হোক চলেন। ইতিমধ্যে বিপদজনক পথ পেড়িয়ে আমরা হাইওয়ের পথে কিন্তু রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ি একটুও নড়ছেনা।

ঘটনা কি? নেমে জিজ্ঞেস করলাম। ট্রাকের সাথে এক সি, এন, জির মুখোমুখি সংঘর্ষ। এবং সি, এন, জি ভেতর ৪ যাত্রিই নিহত। বিপদ যখন আশে চারদিক থেকেই আশে। পুরো রাস্তায় পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম সি, এন, জির যে অবস্থা তাতে কেউ বেঁচে থাকার কথাও না।

হে খোদা আর কতরকম বিপদে পড়বো না জানি ঐদিকের কি অবস্থা এতক্ষনে পুলিশও নিশ্চই আর শান্ত নেই। ভাবলাম সামনে এগিয়ে দেখি এতক্ষন যেহেতু হয়ে গেছে কেউ হয়তো এগিয়ে এসেছে। দুজনকে রেখে হাটতে হাটতে সামনে গিয়েই পেয়ে গেলাম দুজনকে। আমাদের দেরী দেখে চলে এসেছে। যা ভেবেছিলাম তাই পুলিশ আমাদের রেখেই তাদের নিয়ে চলে যেতে চাচ্ছে।

কিন্তু কেউই তাতে রাজি হচ্ছেনা। তাই পুলিশ সবার সাথেই খারাপ ব্যবহার করছে। আমাদের সি, এন, জি ছেড়ে কিছুদূর গিয়েই তাদের নিয়ে আসা সি, এন, জি তে চলে এলাম। ইতমধ্যে অনেক মানুষের ভীড় গোটা এলাকা জুড়ে। মাসুদের এক মামাও চলে এসেছে চিটাগাং থেকে আর সে ভাগ্নের মৃত্যুর জন্য আমাদেরকেই দায়ী করছে আর বার বার ক্ষিপ্র গতিতে আমাদের আক্রমন করতে চাচ্ছে।

কিন্তু স্থানীয় লোকজনের বাঁধায় এগোতে পারছেনা। এরই মধ্যে সবার বাসায় খবর পৌছে গেছে যদিও কারো বাসায় আপাতত বলতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনা কিছুতেই চাপা রাখা যায়না। সবাই ইতিমধ্যে বাসায় যোগাযোগ করেছে। বলা হল আমাদের তিনজনকেও যোগাযোগ করতে।

বাসায় ফোন দিয়েই বুঝলাম সবাই কি রকম চিন্তায় ছিল এতক্ষন। বললাম আমরা ভাল আছি সবাই। কোন চিন্তার কারণ নেই। আমরা সবাই একটা খাবার রেস্টুরেন্টে বসলাম আর সামনে এলাকাবাসীর একটা দেয়াল তারা কাউকে আসতে দিচ্ছেনা আমাদের কাছে। এদিকে রেস্টুরেন্টের মালিক তাড়াহুড়ো করে আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলেন রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও।

সেই সকালের নাস্তার পর সবাই খেতে বসলো। আর ঠিক তখনই পুলিশ এসে বললো আর এক মুহুর্তও দেরী করা যাবেনা। উঠে দাড়ালাম সবাই। একে একে বসলাম পুলিশের গাড়িতে। আর লাশ তোলা হলো এ্যম্বুলেন্সে।

আমাদেরকে নেওয়া হলো রাঙ্গামাটি, কোতয়ালি থানায়। আর লাশ চলে গেলো মর্গে। থানায় তেমন কেহ ছিলনা। মাসুদের এক ফুফাতো ভাই আমাদের সাথেই আসলো। তার সহযোগিতা না পেলে হয়তো আমরা আরো অনেক ধরণের বিপদে পড়তাম।

সে বাইরে মাইক্রোবাসেই রাত পাড় করলো আর আমরা থানার ভিতরে। ক্লান্ত সবার চোখেই ঘুম কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো সবাই। কেউ চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে কেউ ভেতরে টুলের উপরে যে যেখানে জায়গা পেল। অফিসরুমে একটা ঘড়ি চোখে পরলো রাত ৪.০০ টা বাজে। তারপর আমিও একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ি।

সকাল বেলা ওসির সাথে কথা হলো। মাসুদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হলো আমাদের কোন প্রকার হয়রানি না করার জন্য। আর লাশ পোস্টমর্টেম না করার জন্য। থানার সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাদের ছাড়া হল দুপুর আনুমানিক ১.০০ টার দিকে। থানা থেকে বের হয়েই পেলাম দুজন বন্ধুকে তারা খবর শুনেই চলে এসেছে ঢাকা থেকে।

তাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম ঢাকা থেকে বন্ধুবান্ধব সবাই আসছে বাস রিজার্ভ করাও হয়েছে। এখান থেকে আমরা যাচ্ছি নোয়াখালি মাসুদের গ্রামের বাড়ি। তারাও সরাসরি নোয়াখালি চলে আসবে। নোয়াখালির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমরা মাইক্রোতে আর সামনে এ্যাম্বুলেন্স।

ঢাকা থেকে বন্ধুরা আমাদের আগেই পৌছে গেল। সর্বক্ষন আমাদেরকে পরিস্থিতি জানাচ্ছিল। বলা হল একটু সাবধানে প্রবেশ করতে গ্রামের লোকজন ক্ষেপে আছে। গ্রামে পৌছানোর সাথে সাথেই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হল। সবাই এ্যাম্বুলেন্সের পেছনে ছুটলো আমরা এ্যাম্বুলেন্স থেকে খানিকটা দুরত্ব রেখে প্রবেশ করেছি।

আমাদের মাইক্রোবাসটি থামার সাথেই সাথেই চারদিক থেকে বন্ধুরা ঘেরাও করে রাখলো যাতে আমাদের উপর কোন হামলা না হয়। পুরোটা এলাকা জুড়ে কান্নাররোল উঠলো। মাসুদের মা তখনো জানেন না তার বড় ছেলে আর পৃথিবীতে নেই। মাসুদ এ্যকসিডেন্ট করেছে এই বলে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু মায়ের মন।

তাকে যতই মিথ্যে বলা হোক তিনি অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন। এ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামানোর পরের ঘটনা আমি আর বর্ননা করতে পারছিনা। এশার পর জানাজা পড়া হলো । তারপর বাড়িতেই মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করে আমরা চলে এলাম ঢাকার পথে। হ্যা আমরা সবাই ভালোভাবেই পৌছেছিলাম।

আজো সবাই একসাথেই আছি। ভালোই আছি। আগের মতই আড্ডা জমে শুধু তুই নেই আমাদের মাঝে। তোর মৃত্যুর রহস্যটা আজো আমাদের মাঝে রহস্যই থেকে গেল। সাঁতার জেনেও একটা মানুষ কিভাবে পানিতে পড়েই ডুবে যায়? যে সাঁতার জানে না সেওতো কিছুক্ষন হাবুডুবু খায়।

প্রানপন বাঁচার চেষ্টা করে অথচ তুই একটিবারের জন্যও আমাদের দেখা দিলি না। তাহলে হয়তো আমরা তোকে বাঁচাতে পারতাম। এভাবে তোকে চলে যেতে দিতাম না। আমরা তোকে অনেক মিস করি। অনেক মিস করি সময় নিয়ে ঘুছিয়ে লিখতে পারিনি।

আশা করি ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।