আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নামাজের নেশা ।

আমি জানি আমি জানি না

নামাজের নেশা । ছুটি শেষে এবার রাত্রিকালীন বাস-এ ঢাকা ফিরছিলাম । সকালে অফিস করতে হবে এই নিয়ে টেনসনে ছিলাম ঠিক মত পৌঁছাব কিনা । কয়েকজন অসুস্থ যাত্রী ছিলেন –মাঝে মাঝেই তারা যন্ত্রনাকাতর চীৎকার কর বাসযাত্রীদের কাতর করে তুলছিল । আরও ছিল বেশ কয়েকটি পরিবার শিশু ,তাদের সঠিক পরিচর্যার ও খাদ্যজনিত অসুবিধার কারণে চাইছিল বাসটা গন্তব্যে তাড়াতাড়ি যেন যেতে পারে ।

এর মধ্যে এক মাঝবয়সী মুরব্বী-আরবদেশীয় ইসলামী ড্রেস পরা, কিছুক্ষণ পর পরই ড্রাইভারের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাচ্ছিল , যেন ফজরের আজানের সাথে সাথে কাছাকাছিই কোন মসজিদের কাছে গাড়ী থামায় । উনি ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতের সাথে পড়বেন । ভোরের আজান যখন হচ্ছিল,-আজকাল পশ্চিমা ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র অনেক সুবিধেও দিয়েছে - কেবল দ্রোন নয় , মোবাইল থেকেই আযান এর আওয়াজ ভেসে উঠলো । বাসের বেশীর ভাগ যাত্রী আধো ঘুম আধো জাগরণে । বাস থেমে গেল একটি মসজিদের কাছে ।

তিনি নামাজ পড়তে গেলেন । বাসের সমস্ত মানুষকে বসিয়ে –যাদের মধ্যে আমার মত অফিস জয়েন করা মানুষ সহ অনেক অসুস্থ , ভ্রমনে ক্লান্ত মানুষ ছিলেন । কিন্তু সেই নামাজ পড়া মানুষটির কাছে নিজের ধর্ম পালনটিই জরুরী ছিল –অন্য মানুষের অসুবিধা সমূহকে কোন আমলে না এনে তিনি নিজের আখের গোছানর কাজে লাগালেন । বাসটি প্রায় কুড়ি মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল । লোকজন বিরক্ত প্রকাশ করলেল কেউ কিছু বলছিল না-কিন্তু আমি ভীষন বিরক্ত হচ্ছিলাম ।

নামাজী ভদ্রলোক ফিরে এলে অনেক সাহস নিয়ে , কিছুটা বিরক্তির সাথে বললাম –‘ হুযুর ,এই যে বাস থামিয়ে নামাজে গেলেন , এতগুলো মানুষের বাড়তি বিড়ম্বনার সৃষ্টি করলেন এইটা কি ঠিক হল ?’ উনি প্রথমে বুঝতেই পারছিলেন না যে ,বাস থামিয়ে নামাজ পড়ার জন্য তারা কোন অন্যায় কাজ হয়েছে । বরং ভাবখানা তার এই এবাদতে সহযোগীতা করতে পেরে বাকী বেনামাজীদের বরং কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ । ফলে আমার প্রতিবাদ উনি এতই উত্তেজিত যে প্রায় তোতলাতে থাকলেন এবং আমাকে প্রায় নরকের অগ্নিকুন্ডে ফেলেই দিলেন যেন । কোনমতে তাকে থামান হলো । এইভাবে প্রকাশ্যে , স্থান কাল বিবেচনা না করে যে ধর্মাচরণ-এর মাশালাটা কি? নামাজের সময় হলেই সব কিছু থামিয়ে নামাজ পড়তে হবে বা পড়তে দিতে হবে? এইটা তো মিশ্রিত সমাজ ।

একই জায়গায় নানা কিসিমের, বিশ্বাসের লোকজন তাকে । সে সব জায়গার পবিত্রতা, সে সব ভিন্ন ধর্মাবলীদের অথবা সাধারণ মানুষের কোন অসুবিধা করছে কিনা কিছুই মানা হবে না ? নামাজ বা সালাত হচ্ছে ঈশ্বর স্মরণ-সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপণ । সে সব করার জন্য নিজের প্রস্তুতি ছাড়াও প্রয়োজন একটি শান্ত নির্জণ পবিত্র জায়গা । এভাবে নেহাৎ যান্ত্রিক ভাবে তা পালনে মধ্যে কতটুকু ঈশ্বর স্মরণ হয় ,আর কতটুকু নিয়ম রক্ষা – বা আদৌ হয় কিনা সন্দেহ । আমি সেদিন বাসে প্রতিবাদ করছিলাম মানবিক ও সিভিক যুক্তি দেখিয়ে ।

ঘরে ফিরে ধর্মীয় পুস্তক ঘাটতে ঘাটতে কিছু ধর্মীয় যুক্তিও পেলাম- মেশকাত এর একটি হাদিস আছে। হযরত ইবনে সালাম বলেন- ‘এমন সময়ে নামাজে মনোনিবেশ করবে যখন লোকেরা নিদ্রা মগ্ন থাকে। ’ অর্থাৎ কোন মানুষকে কষ্ট না দিয়ে নির্জনে নিবিষ্ট চিত্ত এবাদত করবে। ’ কিন্তু আমাদের সবকিছুতে উল্টা । আমরা ধর্ম পালন করি সাড়ম্বরে –সবাইকে জানিয়ে, দেখিয়ে ।

একধরনের দেখানেপনা আছে আমাদের ধর্মপালনের মধ্যে এবং এর সবটাই যে ধর্মীয় রীতি মেনেই করা হয় সেটাও না । নামাজ বা এবাদত, প্রার্থনা এসব স্রষ্ঠার সাথে মানুষের নিভৃতালাপ , তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন- এর জন্য ধ্যানমগ্নতা প্রয়োজন । কিন্তু আমরা যে ভাবে ঘুষ খেতে খেতে, গাড়ী চালাতে চালাতে,বাজার করতে করতে নামাজের আজান শুনলেই দৌড়ে নামাজটা সেরে আসি এ কাছে মনে হয় - শুধু এক কর্তব্য পালন,সত্যিকার ধর্মপালন নয় । এই দেখানেপনার চুড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করি রমজানের মাসে । বলা হয় এই মাস সংযমের ।

কিন্তু বাস্তবে ঠিক যেন পাল্লা দিয়েই পালন করা হয় অসংযমের । এই মাসে মুসলমানরা কে কত রকম আইটেম কত ভাবে কি পরিমান খেতে পারে তারই এক ধুন্ধুমার আয়োজন । এই মাসে গোটা ঢাকা শহর যেন হয়ে যায় এক হোটেল । সারাদিন ধরে সবাই আয়োজন করতে থাকে খাবারের । তারপর সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় খাওয়ার মোচ্ছব ।

সেটা চলতে থাকে সেহেরি পর্যন্ত । আজকাল তো আবার শুরু হয়েছে বড় হোটেলে এফতার আর ভোর রাতে সবাই ছুটছে সোনার গাঁয়ে ,ওয়েস্টিনে শেহরী পার্টি । কি দুর্দান্ত সংযম মাস । রমজানে সব জিনিষের দাম বাড়ে । সবাই দোষ দেয় ব্যবসায়ীদের ।

আমি বলি সত্যি যদি আমরা সংযম করি,সত্যি যদি কৃচ্ছতাই হয় সায়েম’র মূলমন্ত্র –তবে জিনিষের দাম বাড়বে তো নাইই, বরং কমবে । সংযমের মাসে সব চ্যানেলে শুরু হয় রান্নার আইটেম আর কত শোভনীয় লোভনীয় খাবার খাওয়া যায় তার প্রতিযোগীতা । সংযম কোথা ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।