আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধোঁকা

তোমাকে ছাড়া বাচতে পারবো না.....

-হ্যালো, শাহেদ সাহেব বলছেন? কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নারীকণ্ঠের মিষ্টি উচ্চারণ। শাহেদ বলল, জ্বি,বলছি। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠ বলে উঠলো, আমি সন্ধানী থেকে বলছি। একজন পেশেন্টের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বি নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন হচ্ছে। এই গ্রুপের রক্ত এই মুহূর্তে আমাদের কালেকশনে নেই।

আপনি যেহেতু আমাদের নিয়মিত ডোনার তাই . . . ‘না না ঠিক আছে। আমি অবশ্যই রক্ত দিতে যাবো। ’শাহেদ বলে ওঠে মেয়েটাকে থামিয়ে দিয়ে। এমনিতেই অবশ্য ওর নিয়মিত রক্তদানের সময় হয়ে এসেছে। একটা ঝামেলার কারণে যেতে পারছিল না।

এর আগে কখনো ওরা ফোনে ডাকেনি । নিশ্চয়ই খুব জরুরি কোন ব্যাপার হবে যাতে করে আর না ডেকে হয়তো পারেনি। শাহেদ মেয়েটার কাছ থেকে আর একটু বিস্তারিত জেনে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হল। সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে মেডিকেল গেটের দিকে রওনা হতেই উর্বশীর সাথে দেখা। হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো সে শাহেদকে দেখে।

‘তুমি এখানে কেন? কেউ কি অসুস্থ?’ প্রশ্ন করল শাহেদ, যদিও উর্বশীর দাঁতের বাহার দেখে তেমন কিছু মনে হল না। শাহেদের প্রশ্নের ধারে কাছে গেল না উর্বশী, হেসে হেসেই বলল, ‘কি ? কেমন বোকা বানালাম? -মানে? শাহেদের একটু বুঝতে সময় লাগলো, তুমিই কি একটু আগে সন্ধানীর নাম করে ফোন করেছিলে? খুব যেন মজা পেল উর্বশী ওর বোকামিতে, হাসি আরও একটু বিস্তৃত করে বলল, ‘বীর উত্তম হলে একটা প্রোগ্রাম ছিল। ভাল লাগছিল না তাই মনে হল তোমার সাথে একটু দূরে কোথাও ঘুরে আসি। তুমি যা পড়ুয়া এমনিতে তো বের হবে না তাই ফল্‌স্‌ কল দিয়ে নিয়ে আসতে হল। শাহেদের একটু মন খারাপ হল।

বলল, কাজটা কি ঠিক হল উর্বশী? এই মেয়েটাকে শাহেদ অসম্ভব ভালোবাসে। তাই এর বেশি কিছু বলতে পারল না। উর্বশী ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, বেঠিকই বা কি হল? শাহেদ আর কথা না বাড়িয়ে উর্বশীর পাশাপাশি চলতে শুরু করল। রুপিতে বসে মেনুতে চোখ বুলাতে বুলাতে একে একে বন্ধুদের সবাইকে ফোন দিতে লাগলো উর্বশী, যাকে বলে ফল্‌স্‌ কল-কাউকে বলল এ্যাম্বেসী থেকে বলছে, কাউকে কোন কোম্পানির ইন্টারভিউয়ের নামে কল করল, কাউকে বলল এফ এম রেডিও থেকে . . . শাহেদ ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল, বাধা দিল না কারণ উর্বশী সেটা মানবে না। তেমন খারাপ কোন উদ্দেশ্যে উর্বশী কাজটা করছে তা নয়।

সবাইকে একত্রিত করে একটু ঘুরতে বের হবে এই যা। কিন্তু সেটা এভাবে না করেও তো আয়োজন করা সম্ভব। কিন্তু উর্বশী সোজাসুজি না করে ফাজলামি করছে। এতেই তার রাজ্যের আনন্দ। অবশ্য বন্ধুরাও ত্যাঁদরের একশেষ, এই ধরনের ব্যাপারেই ওরা বেশি মজা পায়।

কিন্তু শাহেদ ভাবে কোনদিন যে নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়বে মেয়েটা। তখন হয়তো ওর মজা দেখার জন্যও বন্ধুরা কেউ কাছে থাকবে না। তবে মনে মনে যাই ভাবুক, সময়টা বেশ আনন্দেই কাটালো ওদের সাথে। সবাই মিলে পতেঙ্গা সাগর পাড়ে ঘুরতে গেল। সন্ধ্যার পর নেভালে জমিয়ে এক আড্ডা হল ।

বীচের পাশের এক রেস্তোরাঁয় বসে কাবাব-পরোটা খেয়ে এসেও সবাই মিলে গরম গরম পেঁয়াজু খেল । উর্বশী বায়না ধরলো সে কাঁকড়া ভাজা খাবে। ওর সাথে তাল দিয়ে অনেকেই খেলো , সাথে বিয়ার খেলো কেউ কেউ। বাসায় ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা। সারাদিন বই হাতে নেয়া হয়নি, সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে হল সারারাত পড়া-লেখা করে।

আর মাত্র দুটো সপ্তাহ্‌ পর ফাইনাল পরীক্ষা। শাহেদ পণ করল যাই ঘটুক, এ ক’টা দিন সে ঘর থেকে বের হবে না। ফোন সাইলেন্ট থাকবে। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কল রেজিস্টার চেক করবে। সবগুলো মিসকলের কলব্যাক করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবে।

উর্বশীর সাথেও পরিমিত সময়েই কথা শেষ করবে। একান্ত প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো ছাড়া পড়ার টেবিল থেকে উঠবে না। যেহেতু শাহেদ ব্যাচেলর কোয়ার্টারে থাকে, খাবারের জন্য কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে বলে রাখল, ওরা সময়মতো খাবার বাসায় দিয়ে যাবে। ব্যাস! নো বাজার-সদাই, নো বুয়া, নো বদারিং। ফার্স্ট ওকে হতেই হবে।

নিজের জন্য হয়তো শুধু ফার্স্ট ক্লাসই মেনে নিত শাহেদ কিন্তু উর্বশীকে পেতে হলে ওর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট না হয়ে উপায় নেই। কোটিপতি বাবার খেয়ালী এই দুলালীকে নিশ্চয়ই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের চাকরি খুঁজতে খুঁজতে পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয় করতে থাকা বেকার যুবকের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে না। সেক্ষেত্রে এই সার্টিফিকেটটাই হয়তো অন্ধকারের বুকে আলোকশিখা হবে। শাহেদ বোঝে না মানুষে মানুষে সমতা কেন টাকার অংকে মাপা হয়! তবু যা বাস্তব তাকে তো অগ্রাহ্য করা যায় না। সেজন্যই বিকল্প পথ খুঁজতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে সে।

অবশ্য ওর এই প্রচেষ্টায় উর্বশী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ভূমিকা রাখে না বরং সব সময় চেষ্টায় থাকে কিভাবে ওর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানো যায়। শাহেদ ওর এই অন্যায়গুলো মেনে নেয় কারণ সে জানে ভালোবাসলে ক্ষমা করতে হয়। সে এও জানে উর্বশী এই কাজগুলো না বুঝে করে। শাহেদের বাস্তবতা সে বোঝে না, হয়তো কখনো বুঝবেও না। তবু শাহেদ ওকে ছাড়া নিজের জীবন কল্পনা করতে পারে না।

শাহেদ মন লাগিয়ে পড়তে চেষ্টা করে পরীক্ষার আগের মুহূর্তগুলোয় আর উর্বশী স্বভাবসুলভ দুষ্টুমী প্রয়োগ করতে থাকে শাহেদের উপর। শাহেদ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল তাই নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়লো না উর্বশীর এই ধরণের আচরণে। বরং অতিরিক্ত পড়া-লেখাজনিত একঘেয়েমী দূর করে দিল উর্বশীর সাথের কাথাপকথন। পরীক্ষাগুলো বেশ ভালো হলো। আগামীকাল লিখিত পরীক্ষা শেষ।

এরপর গ্যাপ দিয়ে শুরু হবে ভাইভা। সেখানে যদিও ফেল করার সুযোগ নেই কারো কিন্তু শাহেদের জন্য ভাইভা খুব রিস্কি একটা জোন। একটু এদিক-ওদিক হলে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে প্রথম স্থান। যার কারণে ভাইভার ব্যাপারেও খুব সচেতন হতে হচ্ছে ওকে। তার আগে আগামীকালের পরীক্ষার প্রস্তুতি শেষ বারের মতো ঝালিয়ে নিতে হবে।

এশার নামাজ শেষ করে আবার পড়ার টেবিলে যাবে ভাবছে শাহেদ, এমন সময় উর্বশী ফোন করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ওর উদ্বেগগ্রস্ত কণ্ঠস্বর, হ্যালো শাহেদ। আমাকে দুটো বাইক ফলো করছে। . . . ’শুরু হলো উবর্শীর নতুন নাটক!!! হাসল শাহেদ মনে মনে, এতো চমৎকার করে কণ্ঠের কাজ করতে পারে মেয়েটা - একদম সত্যি মনে হয় ওর বর্ণনাগুলো। শাহেদের জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যেত কিন্তু সে হাসি হাসি মুখ করে ওর কথা শুনল।

উর্বশী যা কিছু বর্ণনা করলো যার সারমর্ম হলো - সে ভার্সিটি থেকে সিএনজি ট্যাক্সি করে বাসায় ফিরছিল। মেডিকেল হোস্টেলের কাছাকাছি আসতেই সে খেয়াল করে কতগুলো ছেলে ওর সিএনজির পিছু নিয়েছে। ওরা দুটো মোটর সাইকেলে তিনজন করে মোট ছ’জন আছে। উর্বশী খুব ভয় পাচ্ছে। কি করবে বুঝতে না পেরে তাকে ফোন করেছে।

উর্বশীর বাসা লালখানবাজারে। আই আই ইউ সি থেকে চট্টেশ্বরী রোড দিয়ে দামপাড়া হয়ে প্রতিদিন নিজস্ব গাড়িতে চড়ে বাসায় ফেরে সে। আজ হঠাৎ সিএনজিতে কেন? কোন কারণে যদি আসতেও হয় ও একা তো আসবে না। সাথে কেউ না কেউ থাকবে আর সুনসান রাস্তা দিয়ে সে এভাবে কেনই বা আসতে যাবে,অন্য কোন রুট বেছে নেবে। এতোটুকু সেন্স উর্বশীর না থাকার কথা নয় ।

গত সাত দিনে কম করে হলেও পাঁচবার এ ধরনের সিরিয়াস দুষ্টুমী করেছে উর্বশী ওর সাথে, বিশ্বাস করবে না করবে না করেও যখনই শাহেদ বিশ্বাস করে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে, উর্বশী হাসতে শুরু করে মজা পেয়ে। শাহেদ বুঝতেই পারছে এখন যা বলল তার সবকিছু উর্বশীর বানানো গল্প, তবু বুকের ভেতর ধক্‌ করে উঠলো একবার। কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না উর্বশীকে। ফোন রেখে পড়ায় মন দিল শাহেদ, কালকের পরীক্ষার প্রস্তুতি শেষ হয়নি ওর । আর ফোন করলো না উর্বশী ।

শাহেদ বুঝল রেগে আছে উর্বশী ওর উপর। রাতের খাবার শেষ করে ঘুমাতে যাবার আগে একবার রিং দেয়ার চেষ্টা করল উর্বশীকে। ভেবেছিল একটু সময় নিয়ে মান ভাঙাবে কিন্তু কনট্যাক্ট করতে পারল না- উর্বশীর সেলফোন বন্ধ। রাগটা বোধহয় একটু বেশীই করেছে উর্বশী। সেটা শাহেদকে যতটা না ভাবালো তারচেয়ে বেশি ভাবালো ওর পাঠানো একটা এসএমএস।

চার অক্ষরের ছোট্ট একটা শব্দ - ঔণফয যার অর্থ হেল্প। যখন ফোন করেছিল তার কিছুক্ষণ পরেই মেসেজটা পাঠিয়েছে উর্বশী। সত্যি কোন বিপদে পড়েনি তো মেয়েটা? না-কি ওর নাটক বাস্তবসম্মত করার জন্য এমন করলো ? উর্বশীর উপর প্রচন্ড রাগ হল শাহেদের । ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার! না চাইতেও রাজ্যের অশুভ চিন্তা ভর করতে থাকলো মাথায়। সে মজা করেছে-ঠিক আছে, তাই বলে ফোন অফ করে রাখবে কেন? ওর বাসার ল্যান্ডফোনে রিং করল শাহেদ।

কেউ রিসিভ করলো না। সারারাত ঘুমাতে পারল না শাহেদ অস্থিরতায়, ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল। তাতেই পরীক্ষার হলে যেতে দেরী হয়ে গেল। পরীক্ষা ভালোই হল । তবে উর্বশীর ব্যাপারটা সুরাহা হলো না।

সকালে বের হবার আগে যখন ট্রাই করছিল তখনও অফ ছিল ওর নাম্বার। ওর বন্ধুদের মধ্যে দু’জনের নাম্বার ছিল শাহেদের কাছে। ওদেরকে ফোন করে কোন খবর পাওয়া গেল না। উর্বশী যেমন ওর সঙ্গী-সাথীরাও তেমন, কারো কোন ব্যাপারে সিরিয়াসনেস নেই। ওর ভার্সিটির দিকে একবার যাবে ভাবছিল শাহেদ, এমন সময় উর্বশীর বান্ধবী রিয়া ফোন করলো।

সাথে সাথে ছুটে গেল শাহেদ সিএমসির কমপাউন্ডে। মনে-প্রাণে প্রার্থনা করল রিয়া যা বলেছে তা যেন ঠিক না হয়। উর্বশীর প্রতিটি ধোঁকার মতো এটাও যেন ধোঁকা হয়। কিন্তু ওর শেষ কথাটা ধোঁকা ছিল না। গতরাতে ওর গাড়ি না থাকায় সিএনজি ট্যাক্সি করে বাসায় ফেরার পথে কে বা কারা উর্বশীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে যায় ওয়ার সিমেট্রির সামনে। কিভাবে মেডিকেলে পৌঁছেছে উর্বশীর জীবন্ত লাশ পরিচিতরা কেউ বলতে পারলো না। পত্রিকা থেকে আসা একজন রিপোর্টার দেখা গেল উর্বশীর আত্নীয়-স্বজনদের সাথে কথা বলছে, পুলিশও দেখা যাচ্ছে কাছে-পিছে। কারা কাজটা করেছে এর কোন হদিস এখনো বের হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে সিএনজি চালক এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিল।

অবশ্য এসব তথ্য শাহেদের ভেতরে কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে না, সে পাথর হয়ে গেছে যেন। সে কেবল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে, তার উর্বশী-বেলীফুলের মতো ফুটফুটে মেয়েটা কিভাবে দলা পাকানো টিস্যু পেপারের মতো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।