আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ কি উৎসর্গ করিলে মা তুমি !!! বাধিলে আশোধযোগ্য ঋণে, এই অধম আমায়

ইহা কঠোরভাবে একটি রাজনীতি মুক্ত ব্লগ । । অতি ব্যস্ততার মাঝেও সামুতে ঢুকে দেখি সবাই মাকে নিয়ে লিখছে, সবার মা তার তার কাছে পৃথিবীর সেরা মানুষ। আসলে পৃথিবীর সব মা শ্রেষ্ট মা। এই দিবসটা আসলে আলাদা করে পালন করার ইচ্ছে কখনও হয়নি।

মাকে ভালবাসা জানানোর জন্য একটি মাত্র দিন আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারিনা। আমেরিকার ভার্জিনিয়ার অ্যানা জারভিস, যার ছয় বছরের প্রচেষ্টায় ১৯১৪ সালে তার মায়ের স্মৃতি মুলক এই দিবস কে ছুটীর দিন হিসাবে গৃহীত হয়েছিল যা পরবর্তীতে একটি দিবস হিসাবে সারা পৃথিবীতে গৃহিত হয়। যদিও এই দিবসের বানিজ্যিক ব্যাবহার দেখে তিনি নিজেই খুব হতাশ হন। আমার কাছে ৩৬৫ দিনই মা দিবস। সো, আলাদা ভাবে পালন করার কোন ব্যাপার দেখিনা।

মাঝে মাঝে আমার মায়ের ডেডিকেশন নিয়ে ভাবি, হিসাব মিলাতে পারিনা। কত পরিশ্রম করে গেছে সারাটা জীবন, নিজের সখ, আহ্লাদ, স্বপ্ন বলে কিছু ছিলনা তার। মানে আমরা ভাই বোন কখনও দেখিনি। আমি যখন খুব ছোট তখন দেখেছি আমার খালাদের মত আম্মার মাথার চুল ছিল প্রায় হাটু সমান ঘন কাল এক রাশচুল। আম্মার পিছনে এসে ছুলের ভিতরে আমার ছোট্ট মাথা লুকিয়ে রাখতাম।

আম্মা ছিলেন যেমন উঁচু লম্বা তেমন সুন্দরী, কিন্তু তার কখনও ছিলনা কোন আবদার আমার আব্বার প্রতি। অযত্ন-অবহেলায় আজ তার সেই চুল হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে জৌলুস। স্বল্প বেতনে চাকরী করা আব্বার উপর হয়ত চাপ হয়ে যাবে বলে কখনও তার মনের ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। কখনও সাজতেও দেখিনি তাকে আর আমার দেওয়া গহনা পরার আগে, মনে পড়েনা আম্মাকে আমি কখনও গহনা পরতে দেখেছি। পার্শবর্তী নিজের বাপের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও কখনও যায়নি আমাদের ছেড়ে।

নিজের ভাইগুলো মানুষ না হওয়াতে আম্মার একটা ভয় ছিল তার ছেলে দুইটিও বুঝি মামাদের মত হবে। মফস্বলের পরিবেশে আমাদের বড় করে তোলা তার জন্য ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা দুই ভাই যেন বিকালে বা ছুটীর দিনগুলোতে এলাকার ছেলেপেলে দের সাথে না খেলতে যাই সেজন্য আম্মা ঘরের ঊঠানে আমাদের সাথে খেলত বিভিন্ন প্রকার খেলা- যেমনঃ দড়িলাফ, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ী উড়ানো। এমনকি আম্মা আমাদের ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জাও মেরে দিত। একটা সময়ের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিত না আমাদের দুই ভাইকে।

আর আব্বাতো সারাদিন, স্কুল, টিউশনি পরবর্তীতে ছোটখাট ব্যবসা নিয়ে ব্যাস্ত থাকত আমাদের দিকে খেয়াল রাখার অতটা সময় পেত না। আর একটি দৃশ্য এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। আমরা থাকতাম ছোট্ট একচালা এক মাটির ঘরে । বর্ষাকালে অতি বৃষ্টিতে আমাদের ঘরের মেঝে পানিতে ডুবে যেত। পানি নেমে গেলে মেঝেতে প্যাচ পেচে কাদা জমে থাকত যার মধ্যে কিল বিল করত জোঁক ও কেঁচো।

আমরা পিঠাপিঠি ছোট তিনভাই বোন ভয়ে খাটের ঊপর বসে থাকতাম জড়াজড়ি করে। আম্মা সেই কাদার মধ্যে বসে রান্না করত, হাটাচলা করত, আমাদের বাথরুমে নিয়ে যেত কোলে করে। আমাদের মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে, তারপর যেত গোসল করতে। তিন ভাইবোন দেখতাম জানালা দিয়ে, কলপাড়ে আম্মা হাত দিয়ে টেনে টেনে পা থেকে জোঁক ছাড়াচ্ছে। এই দৃশ্যটা আমি সারা জীবন ভুলবনা।

একবার আম্মার বুকে পান বা সুপারী বেধে এক ভয়ংকর অবস্থা। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। আমরা ভাবলাম আম্মা বুঝি মারা যাচ্ছে। আমি আম্মার হাতটা আমার গালের সাথে সজরে চেপে ধরে রাখলাম। আম্মা সুস্থ হল, কিন্তু আমার হাত সহজে কেউ ছাড়াতে পারল না।

যখন বড় হলাম, কলেজে ভর্তি হয়েছি, আম্মা আমাকে বলল শার্ট ইন করে পরিপাটি হয়ে যেতে। মাঝে মাঝে টাইও পরতে বলত। আম্মাকে যেহেতু যমের মত ভয় পেতাম, সো বন্ধুরা টিটকারী মারলেও সেই কলেজ থেকেই আমি ছিলা হ্যান্ডসাম শুকনা বাবু। আমার ইঊনিভার্সিটি পাশ করে স্কলারশীপ পেয়ে বাইরে ছলে যাচ্ছি। মফস্বলের সেই বাস কাঊন্টারে আমার আব্বার হাউমাউ কান্না।

কিন্তু আম্মা কঠিন, সে বলল আমার ছেলে বড় ডিগ্রী নিতে যাচ্ছে এখানে কান্নার কি আছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বিদায় দিল। আমিও বেশী করে মায়ের গায়ের ঘ্রাণটা নিয়ে নিলাম। আই ঘ্রান ছেড়ে আমার দীর্ঘদিন ভিনদেশে থাকতে হবে। একবার অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লাম, বিদেশের মাটিতে ভাল শশ্রুষা পাওয়া কঠিন, রাতে বিছানায় ছটফট করতাম আর ভাবতাম একটি বার যদি আম্মার গায়ের ঘ্রাণটা পেতাম তাহলে সুস্থ হয়ে যেতাম।

তখন সঙ্কল্প করেছিলাম, যখন দেশে যাব তখন আম্মার একটা শাড়ি নিয়ে আসব সাথে করে যদিও সেটা করা হয়নি আর। আমার আম্মা সম্রাট নেপোলিয়ন কে ভুল প্রমান করেছে। সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছেন, ‘যদি তুমি আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব। ’ আমার আম্মা বেশী শিক্ষিত না, কিন্তু তিনি তার সব সকল্প নিয়ে তার সব সন্তানদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। তার মেয়েরা সরকারী চাকুরি করে, তার ছেলে এই আমি জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকে স্যাটেলাইট-জি আই এস এর এক্সপার্ট হিসাবে দেশ বিদেশে চাকুরি করি।

আর তার ছোট ছেলেটা এখন কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবি, কিভাবে নিজের শখ, ভালোলাগা বিসর্জন দিয়ে আমার মা তার সন্তান দের গড়ে তুলেছেন, তার স্বপ্নকে সত্যি করেছেন !!!! মনে মনে বলি, "এ কি উৎসর্গ করিলে মা তুমি !!! বাধিলে আশোধযোগ্য ঋণে, এই অধম আমায়" হয়তো কিছুদিনের মধ্যে আমার মা রত্নগর্ভা মা হিসাবে পুরস্কার পাবেন। এমন মায়ের সন্তান হয়ে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয়। বয়সের ভারে মা কিছুটা রুগ্ন হয়ে পড়েছে, বাসা বেধেছে শরীরে অনেক রোগ। আগামী শুক্রবারে তার চোখের অপারেশন।

এই মা দিবসে সকল ব্লগার ও পাঠকের কাছে অনুরোধ রইল-আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন সবাই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৬ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।