আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উৎসর্গ সবাক কে

পাখি এক্সপ্রেস

চীনের কুনমিং শহরের এক বাংলাদেশী গেষ্ট হাউজের "হাউজ বয়"। শরীর তার "শরীর" বিষয়টাকেই ধারণ করে না। এতো চিকন চাকন ছেলে আমি খুবই কম দেখেছি। জন্ম তার সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানায়। তাও তার শোনা কথা।

জন্মের পর বেড়ে ওঠা নিয়ে তেমন কোন স্মৃতিচারণ করতে রাজি হয়নি। শুধু বলেছে, "অনেক লাত্থি ওষ্ঠা খাওয়া মানুষ আমি"। ২৬ নভেম্বর ২০০৬ জীবনের বুলডোজার কুনমিং বিমানবন্দরে। ইমেগ্রেশন ঝামেলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখি, একটি ছেলে মোটা একটি কাগজ হাতে দাড়িয়ে আছে, যাতে লেখা "বাংলাদেশীদের জন্য আমি আছি"। তাকে জিজ্ঞেস করলাম বিষয়টা কি? পরে জানলাম তাদের একটা গেষ্ট হাউজ আছে যেখানে আমি ইচ্ছে করলে থাকতে পারি।

যেহেতু আমি নতুন তাই আর দেরি করিনি। তার সাথেই গেলাম। পথে জানলাম, প্রতিদিন তার মালিক স্বয়ং আসে। আজ তাকে পাঠিয়েছে। নাম জানলাম- সবাক।

আমার চাইতে উন্নত পোশাকে দেখে ছেলেটাকে অধিক সুখী ভাবি। ঢাকা শহরের শনির আখড়া এলাকার টোকাই ছিলো সবাক। তখন বয়স হবে, ১৪। এক ভদ্রলোক তাকে খুব আদর করতো। কখনওই খারাপ কিছু পায়নি ওই ভদ্রলোকের চাল চলনে।

এই ভাবে কাটে প্রায় দেড় বছর। সবাকের পিছনে এই দেড় বছরে অন্তত ৩০ হাজার টাকা চালান দিলেন ওই ভদ্রলোক। তার পর একদিন লাভ বুঝে নেয়ার হিসেব কষলেন। সবাককে মালয়শিয়া নেবেন বলে কথা দিলেন। সবাকের মনে খুশির নাচন কে দেখে।

দিন গুনতে থাকে সবাক, কবে মালয়শিয়া যাবে। অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষে একদিন আরও ১৫ টা নানান বয়েসী বালকের সাথে উড়াল দিলো। কিন্তু বিমান গিয়ে থামলো চীনে। সবাকসহ ১৬ জনকে একটি শহর থেকে বলবো বাসে করে দূরে কোথায় নিয়ে একটি পাহাড়ী অঞ্চলে এক লোকের জিম্মায় রেখে ভদ্রলোক ১দিনের কথা বলে কোথায় যেন গেলেন। তখনও সবাক বুঝতে পারেনি, আসলে কি হচ্ছে।

কিন্তু প্রায় ১০ দিন চলে যায় ভদ্রলোকের কোন খোজ নেই। একদিন পুলিশ এস হানা দিল। কি যেন কি ভেবে পুলিশে ধরনা না দিয়ে সবাক গেল পালিয়ে। বরাবর ১৫ দিন শুধু কলা খেয়ে এক বিশাল কলা বাগানে লুকিয়ে ছিলো সবাক। অবশেষে ধরা পড়লো বাগান মালিকের হাতে।

কিন্তু লোকটি খুব ভালো। যদিও তার কোন কথায়ই বুঝতে পারে না সবাক। বোবার মতো থাকতো। এভাবে ২ মাস। আবারও সমস্যা, আবারও পুলিশ।

এবারও পালিয়ে গেল সবাক। ভাগ্যিস পকেটে ছিলো ২০০০ আরএমবি/ইয়েন (চায়না মুদ্রা)। এবার মোটামুটি সুখেই যাচ্ছে। শহরে গিয়ে জামা কাপড় পাল্টিয়ে পুরা মাইকেল হয়ে গেল। এবার আর পুলিশও সন্দেহ করে না।

চলে এলো কুনমিং। হয়ে গেল রাত। এবার থাকবে কোথায়? হোটেলে থাকলেতো মহা সমস্যা। টাকা শেষ হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তবে কি পথেই থাকবে? তাও করা যাবে না।

কারণ পুলিশী ঝামেলা। তবুও পথেই পড়ে রইলো। রাস্তার পাশে একটি সেঞ্চুরী গাছের সাথে হেলান দিয়ে ভাবনায় মশগুল ছিলো তখন। হঠাৎ কানে এলো কিছু কথা। যার মর্মার্থ হলো " এক বাংলাদেশী গেষ্ট হাউজের জন্য আকটি বাংলাদেশী ছেলের দরকার"।

বুদ্ধি করে সবাক গিয়ে তার আগ্রহের কথা জানালো এবং তার চীনের কাহিনীও বললো। ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন। ঠাঁই হলো এখানে, আমি তাকে যেখানে পেলাম। আমি সেখানে ৩দিন ছিলাম। প্রতিরাতেই সে আমাকে গান শুনাতো।

অসম্ভব সুন্দর তার গানের গলা। জীবনে এতো অবহেলা পেয়েও নষ্ট হয়ে যায়নি সবাক। তার জীবনের কথা শুনে আমি জগৎ সম্পর্কে ভিন্ন একটা ধারণা পেলাম। একটা মানুষ জানে না তার বাবা-মা কে? এবং সত্যিকার অর্থে তার কোন আত্মীয় এ পৃথিবীতে আছে কিনা, তাও সে জানে না। জন্ম পরিচয়হীণ একটি ছেলে পৃথিবীর বুকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে কি আপ্রান চেষ্টায় দিনানিপাত করছে।

আমি চীন থেকে চলে আসার প্রায় ২ মাস পরে তার মালিকের কাছে ফোন করে জানতে পারলাম সে আবার পালিয়েছে, কারণ পুলিশ টের পেয়ে গেছে। আমি তাকে বলেছিলাম বিয়ে করে ফেলতে, তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সে কেন যে করে নি? চীনে পা রাখার আগে আমার জীবনটা একটা ছোট্ট গন্ডির মধ্যে ছিলো। চীনের সে ক'দিনে অনুভূতি ছিলো অন্যরকম। একেবারেই অন্যরকম।

প্রচুর বাংলাদেশীর সাথে দেখা হলেও সবাকের জীবনের দর্শন আমাকে আলোড়িত করেছিলো। জীবনকে অনেকভাবে তার কাছে শিখেছি। হি ইজ এ্যা গ্রেট ম্যান। তখনকার মারাত্মক আবেগী আমি তার মাঝেই নিজেকে খুঁজতে শুরু করি। শত হতাশার মাঝেও আজ আমি সুখে থাকি, সামনে থাকে সবাকের অতীত বর্তমান।

সবাককে নিজের মাঝে ধারণ করার প্রয়াসেই সবাক নিকে ব্লগিং করা। সবাক কেমন আছে জানি না। সে তার মতো থাকুক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।