আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রিক মিথ: আর্টেমিস

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আর্টেমিস। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর জমজ বোন এবং গ্রিক পুরাণের শিকার ও অরণ্যদেবী। এ কালের নারীবাদীরা প্রাচীন এই গ্রিক দেবীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

তার অবশ্য কারণ আছে। আর্টেমিস তাঁর বাবা দেবরাজ জিউসকে যা যা বলেছিলেন তাতে এ যুগের নারীবাদীদের উৎফুল্ল হওয়ারই কথা। আর্টেমিস দেবরাজ জিউসকে বলেছিলেন মেয়েরা যে ঐহিত্যবাহী লম্বা টিউনিক (পেপলস) পরে তাতে নানা অসুবিধে। আমি আমার টিউনিক ছোট করে ফেলতে চাই, এতে আমার চলাফেরার যেমন সুবিধে হবে তেমনি আমার শিকার করতে সুবিধে হবে। আমি গয়না পরব না।

আমার কাছে এসব ভারি অসহ্য বোধ হয়। আর আমি আমার ভাই অ্যাপোলোর মতো সমান ক্ষমতাশালী তীর/ধনুক চাই। এসব বিস্ফোরক প্রশ্নের কারণেই একালের নারীবাদীরা আর্টেমিসকে নিয়ে এত আগ্রহী। ভেবে বিস্মিত হই ... প্রাচীন গ্রিসের পুরাণরচয়িতারা এমন প্রথাবিরোধী এক তেজস্বিনী চরিত্র কেন কল্পনা করেছিলেন- ... মানচিত্রে এফিসাস নগর এফিসাস নগরটি ছিল প্রাচীন গ্রিসে (বর্তমানে তুরস্কে, অর্থাৎ, প্রাচীন আইওনিয় গ্রিসে) .... সুপ্রাচীনকালে এফিসাসবাসী বৃহৎ এক এশিয়াটিক মাতৃদেবীর আরাধনা করত। অনেকের মতে এই এশিয়াটিক মাতৃদেবীই আর্টেমিস-এর উৎস নিহিত ।

অবশ্য আর্টেমিস চিরকুমারী হলেও এফিসাস নগরের বৃহৎ মাতৃদেবী ঠিক সেরকম ছিলেন না; তার কারণ, এফিসাসের সমাধিগাত্রে বহু স্তন বিশিষ্ট বৃহৎ মাতৃদেবীর একটি চিত্র আবিস্কৃত হয়েছে, যাতে মনে হয় তিনি গর্ভধারণ করতেন। যা হোক। পরবর্তীকালে গ্রিক সমাজে পুরুষতান্ত্রিক অলিম্পিয়ান (বা হোমারিয়) দেবতাকূলের উত্থানকালে প্রাচীন বৃহৎ মাতৃদেবীর ক্ষমতার পরিধী হয়ে পড়ে সীমাবদ্ধ। এককালে যে বহুস্তন বিশিষ্ট মাতৃদেবী প্রবল দাপটে বিরাজ করতেন, পরবর্তীকালে তাকে দেখা গেল সীমিত ক্ষমতার অধিকারী আরণ্যক কুমারী দেবী হিসেবে! ডেলোস দ্বীপ। টাইটান হলো গ্রিক দেববংশ এবং মানবজাতির পূর্বপুরুষ।

লেটো হলেন গ্রিক পুরাণের একজন অন্যতম টাইটান। দেবরাজ জিউসের অন্যতম প্রণয়িণী ছিলেন লেটো। যার ফলে জিউস ও লেটোর মিলনের ফলে লেটো গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং জিউসপত্নী হেরা ভয়ানক ক্রদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি লেটোকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, “সূর্যের আলো যতদূর প্রতিফলিত হয় ততদূর পর্যন্ত কোনও স্থানে তুই সন্তানপ্রসবে জায়গা পাবি না!” যথাসময়ে লেটোর প্রসববেদনা উঠল। কিন্তু, সন্তান প্রসবের জন্য কোনও স্থান পেলেন না লেটো।

স্বর্গমর্তের মাঝামাঝি কোনও স্থানে দাঁড়াবার যায়গা না পেয়ে প্রসব বেদনায় কাতর হয়ে লেটো হাহাকার করতে থাকে। গ্রিক পুরাণে সমুদ্রদেবতা পোসেইদোন। জিউসের অনুরোধে পোসেইদোন ডেলোস দ্বীপের ওপর বিশাল ঢেউ পাঠিয়ে ঢেকে দিলেন গোটা দ্বীপটি। সেই জলময় আড়ালের নীচে যমজ সন্তান প্রসব করলেন লেটো । একজন আর্টেমিস ও অন্যজন অ্যাপোলো ।

পরবর্তীতে অ্যাপোলো হয়ে উঠেছিলেন সূর্যের দেবতা এবং আর্টেমিস চন্দ্রের দেবী। রোমানপুরাণে অবশ্য আর্টেমিস ডায়ানা নামে পরিচিত। লেটো যমজ সন্তান প্রসব করায় ডেলোস দ্বীপটি পবিত্র স্থান বলে গন্য করা হয়। ডেলোস দ্বীপে অ্যাপোলো ও আর্টেমিস-এর দুটি উপাসনালায় নির্মাণ করা হয়েছিল। গ্রিক পুরাণমতে আর্টেমিস প্রথম জন্মেছিল এবং ধাইয়ের ভূমিকা নিয়েছিল।

তাঁর মাকে দেখেছিলেন অ্যাপোলোর জন্মের সময় অশেষ প্রসবযন্ত্রণা ভোগ করতে। সে কারণে সম্ভবত আর্টেমিস প্রত্যেক নারীর প্রসব বেদনা হ্রাস করার শপথ নিয়েছিল। এই কারণেই আর্টেমিসকে প্রসবকালীন দেবী বলা হয়। প্রাচীন গ্রিসে মনে করা হত যে, আর্টেমিসের নতুন জীবন আনার ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ ও স্ত্রী পশুর প্রসবকালীন সময়ে সাহায্য করেন আর্টেমিস।

প্রসবকালীন সময়ে প্রাচীন গ্রিসের নারীরা আর্টেমিস কে ডাকত। দেবী তাদের সাহায্য করত কিংবা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে তীর ছুড়ে দ্রুত মৃত্যু কার্যকর করত! এই কারণে কোনও নারীর মৃত্যুর হলে সেই নারীর কাপাড় আর্টিমিসস উপাসনালয়ে নিয়ে যাওয়া হত। আর্টিমিসকে চেনা যায় সহজে। পরনে শর্ট টিউনিক, পায়ে ফ্ল্যাট স্যান্ডেল, পিঠে ব্যাগ ভর্তি তীর । দেবী আর্টেমিসের পরিমন্ডলে অনেক বুনো পশুর দেখা যায়; যেমন ভালুক শূকর হরিণ ছাগল ও কুকুরের পাল ।

আর্টেমিস মূলত শিকারের দেবী। যে কারণে, মৃত্যু তীর-ধনুক এবং যৌবনের সহযোগী। কেবল শিকার নয় আর্টেমিসের তীরের বহুবিধ অর্থ রয়েছে। যেমন, অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়া কিংবা প্রসববেদনা উঠলে শর নিঃক্ষেপ করে বেদনা হ্রাস করা। আর্টেমিস বাঁকা চাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বাঁকা চাঁদের প্রতীক মাথায় পরে। গ্রিকসমাজে আর্টেমিস অত্যন্ত নির্মল দেবী বলে পরিচিত ছিল। যৌনসংস্রব থেকে সম্পূর্ন মুক্ত নিষ্পাপ কুমারী। তাঁর অনুসারীরা আজীবন কুমারী থাকার শপথ করত। আর্টেমিসের কুমারী থাকার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে, মা লেটোর প্রচন্ড প্রসবযন্ত্রনা দেখে আর্টেমিস সম্ভবত প্রসববেদনা এড়াতে চেয়েছিলেন।

যা হোক। নিষ্পাপ কুমারী ও হত্যা করতে পারে! অভিনব পন্থায় অ্যাকটিয়ন কে হত্যা করেছিলেন দেবী আর্টেমিস । বিখ্যাত শিকারী অ্যাকটিয়ন ছিলেন প্রাচীন গ্রিক নগরী থিবম-এর প্রতিষ্ঠাতা ক্যাডমাস-এর দৌহিত্র এবং মৌমাছির দেবতা অ্যারিস্টিউস এর পুত্র। একবার অ্যাকটিয়ন শিকারের উদ্দেশ্যে ঘুরছিল। সঙ্গে অনেকগুলি কুকুর।

কুকুরগুলি হরিণ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিড়েখুঁড়ে ফেলত। আর্টেমিন স্নান করছিলেন। সম্ভবত নগ্ন ছিলেন। অ্যাকটিয়ন কে দেখে ভয়ানক ক্রদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং যাদুবলে অ্যাকটিয়ন কে একটি হরিণে পরিনত করেন। অ্যাকটিয়ন এর কুকুরগুলি হরিণ দেখেই ঝাঁপিয়ে হরিণটিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

নিষ্পাপ কুমারীও ক্রদ্ধ হয়ে হত্যা করতে পারে! গ্রিক উপকথা এখানেই অনন্য। বিস্ময়কর। তাহলে আরও একটি বিস্ময়কর কাহিনী বলি। আর্টেমিস প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন শিকারী ওরিয়নের। এতে অ্যাপোলো বিব্রত বোধ করে।

ওরিয়নকে হত্যা করবে বলে ঠিক করল অ্যাপোলো। একবার। ক্রিট দ্বীপে ভাইবোন শিকার করছিল। ওরিয়ন দূরে সমুদ্রে সাঁতার কাটছিল। অ্যাপোলো ঠিকই ওরিয়নকে দেখে দেখে চিনতে পারল।

অ্যাপোলো বলল, আর্টেমিস? বল। ঐ দূরে কি দেখা যাচ্ছে না ... হ্যাঁ, তাই তো। তীর ছুড়ে লাগাতে পারবে? পারব। আর্টেমিসের অব্যর্থ নিশানায় ওরিয়নের কপালের এক পাশে শরবিদ্ধ হয়! আমরা অনেকেই জানি যে, প্রাচীন গ্রিসে সমকামীতা লুকোছাপা কোনও বিষয় ছিল না। যে কারণে গ্রিক পুরাণে আর্টেমিসের সমকামীরূপেরও উল্লেখ রয়েছে।

একবার ব্রিটোমারটিস নামে এক নারীকে ধষর্ন করতে উদ্যত হয় মিনোস (ইনি সম্ভবত ক্রিট দ্বীপের রাজা); আর্টেমিস ব্রিটোমারটিস কে উদ্ধার করেন এবং ব্রিটোমারটিস-এর সঙ্গে সমকামী সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আসলে গ্রিক মিথ একজন একটি নিদিষ্ট সময়সীমার মধ্যে লিখেননি। শত শত বছরের পরিক্রমায় গ্রিক উপকথা গড়ে উঠেছে। ফলে প্রক্ষিপ্ত অনেক বিষয় গ্রিক পুরাণে স্থান করে নিয়েছে। আর্টেমিস এর কুমারীরূপ যেখানে প্রবল করে তোলা হয়েছে, সেখানে আর্টেমিস প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন শিকারী ওরিয়নের! অন্যত্র আবার দেখলাম আর্টেমিস ছিলেন সমকামী! এসবই প্রক্ষিপ্ত রচনার ফল।

আর্টেমিস উপাসনালয়ের ধ্বংসস্তূপ প্রাচীন গ্রিসের শিকারীরা আর্টেমিসের আর্শীবাদের জন্য বুনো প্রাণি বলি দিত। ভালো শিকার পেলে ছাল আর শিং কৃতজ্ঞাসরূপ গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখত। শিকারী ছাড়াও আর্টেমিস ছিলেন কুমারী মেয়েদের আরাধ্য দেবী। বিয়ের আগের রাতে কুমারী মেয়েরা পোশাক, খেলনা আর পুতুল আর্টেমিস উপসনালয়ে রেখে কুমারীজীবনকে বিদায় জানাত। তারা দেবীকে সন্তুষ্ট করত চাইত, যাতে প্রসবকালীন যন্ত্রণা কম হয়।

কেবল মেয়েরা নয়, ছেলেরাও কুমারজীবন কাটানোর জন্য আর্টেমিসের নামে শপথ করত । আর্টেমিসের উপাসনালয়ের নারীপুরোহিত শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে পুরুষদের নির্বীর্য করত! তথ্যসূত্র: ১. ফরহাদ খান: প্রতীচ্য পুরাণ ২. Melissa Coffey এর লেখা Artemis নামে একটি নিবন্ধ ছবি ও মানচিত্র : ইন্টারনেট।
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।