আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাশের পাহাড়ে মিসর

ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সমর্থকদের ওপর সামরিক বাহিনীর অভিযানে মৃতের সংখ্যা ৫০০ জন ছাড়িয়ে গেছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সাড়ে তিন হাজারের বেশি। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে মুরসিপন্থি মুসলিম ব্রাদারহুড। এদিকে বিক্ষোভ এলাকা রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ার থেকে সাময়িক সরানো গেলেও ফের সেখানে অবস্থান নিয়েছেন হাজার হাজার মুরসি সমর্থক। তারা বলছেন, কারফিউ, জরুরি অবস্থা বা হত্যাযজ্ঞ_ কোনো কিছুই দমাতে পারবে না তাদের।

বিভিন্ন জায়গা থেকে মুরসি সমর্থকদের শান্তিপূর্ণ যাত্রা শুরু হয়েছে রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ারে। হাজার হাজার লোক অংশ নিয়েছেন এই যাত্রায়। অন্যদিকে আগামী এক মাস দেশটিতে জরুরি অবস্থা থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী এল বারাদি পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে মুরসি-সমর্থকদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর এমন রক্তক্ষয়ী অভিযানের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

মিসরীয় বার্তা সংস্থা আলইয়াওমুস সাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুহাম্মাদ ফাতহুল্লাহর বরাত দিয়ে জানায়, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মুরসিপন্থিদের সংঘর্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী কায়রোর রাবেয়া স্কয়ারে নিহত হয়েছে ১৩৭ জন, নাহদা স্কয়ারে ৫৭ জন এবং হালাভনে মারা গেছেন ২৯ জন। বাকিরা মারা গছেন মিসরের বিভিন্ন প্রদেশে। এ ছাড়া সংঘর্ষে ৪৩ জন পুলিশ নিহতের দাবিও করেছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়।

আর সরকারি হিসাবে বিভিন্ন এলাকায় আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৭২ জন। তবে এ পরিসংখ্যান ভিত্তিহীন হলে উড়িয়ে দিয়েছেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতারা। তারা বলছেন, সরকারি পাণ্ডাদের হামলায় নিহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি। শুধু রাবা আল আদাবিয়া সংলগ্ন মসজিদের পাশ থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে তিন শতাধিক মৃতদেহ। এদিকে উচ্ছেদের নামে মিসরের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে, বিশ্বব্যাপী এর নিন্দা অব্যাহত রয়েছে।

বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী বুধবার ব্যাপক রক্তক্ষয়ী অভিযানের মাধ্যমে রাজধানী কায়রোর দুটি অবস্থান থেকে মুরসির সমর্থকদের সরিয়ে দিয়েছে। খুব সকালে কায়রোর ওই অভিযানের পর রাজধানীর বাইরেও ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা। রাবা আল-আদাবিয়া ও নাহদা স্কয়ার ঘিরে ফেলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। প্রথমে তারা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে।

নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল দ্রুত তুলে নিয়ে উল্টো তাদের দিকে তা নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীরা। এর পরই দুই পক্ষে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। একপর্যায়ে নাহদা স্কয়ার থেকে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয় নিরাপত্তা বাহিনী। সেখানকার অস্থায়ী তাঁবুগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর অন্যান্য অংশেও।

বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভকারীরা। এদিকে হত্যার দায় কাঁধে না নেওয়ার কথা জানিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এল বারাদি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশে জরুরি অবস্থা এক মাস অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে রাজধানী কায়রো এবং ১৩টি প্রদেশে, যা বলবৎ ছিল গতকাল ভোর ৬টা পর্যন্ত। সংঘর্ষের ঘটনার পরপর গ্রেফতার করা হয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, রাবা আল-আদাবিয়া ও আল-নাহদা স্কয়ার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় আটক করা হয়েছে বহু বিক্ষোভকারীকে। তবে সরকারি বাহিনীর এই অভিযানকে 'গণহত্যা' আখ্যা দিয়ে মুসলিম ব্রাদারহুড দাবি করেছে, এ ঘটনায় নিহত হয়েছে দুই হাজারের বেশি আর আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে পাঁচ হাজারের বেশি। এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। তবে পূর্ব কায়রোর রাবা আল-আদাউইয়া মসজিদের বাইরে যেখানে ব্রাদারহুড সমর্থকরা অবস্থান নিয়েছিলেন তার কাছাকাছি দুটি অস্থায়ী হাসপাতালে উপস্থিত বিবিসির একজন সংবাদদাতা বলছেন, তিনি নিজে অন্তত ৫০টি মৃতদেহ গুণে দেখেছেন।

এর আগে বিবিসির একজন সংবাদদাতা জানিয়েছিলেন, বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে ঢিল ছুড়ছে। তবে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে টিয়ার গ্যাসের পাশাপাশি তাজা বুলেট ব্যবহার করছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, শহরের আল-নাহদা স্কয়ার থেকে ব্রাদারহুড সমর্থকদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকদের আবারও রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। পুলিশ এ ধরনের একটি গ্রুপকে হটিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে কায়রোর পশ্চিমে একটি মসজিদের বাইরে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এখানে পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কায়রোর দক্ষিণে ফাইয়ুম নামক স্থানে দুটি গির্জায় হামলা হয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের বিক্ষোভ কায়রোর সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়ায় মুরসি সমর্থকরা সড়ক অবরোধ করেছেন।

বেশ কিছু সড়ক বন্ধ হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় আসওয়ানে শহরে শত শত বিক্ষোভকারী স্থানীয় গভর্নরের অফিসের সামনে জড়ো হয়েছেন। তবে বিক্ষোভকারীদের দিকে নিরাপত্তা বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে গিজা, আসিউত ও মিনিয়া শহরে নিরাপত্তা বাহিনী ও ব্রাদারহুড সমর্থকদের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক মুরসিপন্থিদের ওপর সহিংসতার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিবের দফতর থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মিসরীয় কর্তৃপক্ষ বল প্রয়োগের পথ বেছে নেওয়ায় বান কি মুন মর্মাহত। ইইউর পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান ক্যাথেরিন অ্যাশটন মিসরে সহিংসতার ঘটনায় কড়া নিন্দা জানিয়ে সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বুধবারের অভিযানকে উল্লেখ করেছেন 'ভয়াবহ' বলে। একই সঙ্গে সহিংসতার ঘটনাকে দেশটির রাজনৈতিক সংস্কার উদ্যোগের জন্য সত্যিকার অর্থেই একটি ধাক্কা বলে বলে অভিহিত করেছেন তিনি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, সহিংসতায় কোনো সমাধান আসবে না।

সত্যিকার অর্থে ক্ষমতার রদবদল ও গণতন্ত্রের জন্য সব পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। অবিলম্বে দমন-পীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ফ্রান্স। মিসরে সহিংসতার ঘটনাকে 'অত্যন্ত বিপজ্জনক' বলে অভিহিত করেছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুইডো ভেস্টারভেলে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান সহিংসতাকে বলেছেন গণতন্ত্রে ফেরার আশার ওপর 'মারাত্দক আঘাত'। আর ইরান সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মিসরে গৃহযুদ্ধ শুরুর ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার নিন্দা করেছে কাতার। এদিকে মিসরের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হাজেম আল বেবলাউয়ি মুরসির সমর্থকদের সরাতে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়ে গতকাল টেলিভিশনে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, অভিযান চালানো ছাড়া কর্তৃপক্ষের কোনো বিকল্প ছিল না। তবে প্রাণহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছেন, যত শীঘ্র সম্ভব জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হবে। ৩ জুলাই মুরসির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে আটক করে সেনাবাহিনী।

এর পর থেকে তাকে পুনর্বহালের দাবিতে কায়রোর রাবা আল-আদাবিয়া মসজিদের পাশে এবং রাজধানীর কেন্দ্রস্থল নাহদা স্কয়ারে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে আসছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মী-সমর্থকরা। তাদের হটাতে এর আগে ২৭ জুলাই রাবা আল-আদাবিয়া মসজিদের পাশে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে প্রায় ৮০ জন নিহত হন। এর পরও সরকার সেখান থেকে তাদের সরাতে পারেনি।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.