আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বলধা গার্ডেন কিংবা এক বলদের গল্প



আমাকে পরিচিতজনরা গোয়ার হিসেবেই জানে। একটি ঘটনার বিবরণ দিলেই বুঝতে পারবেন আমি কেমন প্রকৃতির মানুষ। ঢাকা শহরে আছি প্রায় ৮ বছর। কোনো দিন যাদুঘর, চিড়িয়াখানা কিংবা শিশুপার্কে যাইনি। গ্রামের বাড়ি থেকে একমাত্র আদরের ভাগ্নি মাইসা বাসায় বেড়াতে এলে সে নানা জায়গায় ঘুরতে যাবার বায়না ধরে।

এবং অবশ্যই আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে। সাধারণত তার কোন আবদার ফিরিয়ে দেই না। কিন্তু আদর্শগত কারণে কিছু আবদার আজকাল রক্ষা করতে পারি না । তখন নানা অজুহাতে নিজেকে ব্যস্ত দেখাই। যেমন একদিন সে বায়না ধরেছে যাদুঘরে যাবে।

আমি যাইনি। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়েছি। আপনারা হয়তো ভাবছেন কেন যাইনি। এবার আসল কারণটা বলি- প্রত্যেক বিষয় নিয়ে আমার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যেখানে আমার সঙ্গে অমিল সেখানে আমি পারতপক্ষে পা মাড়াই না।

যেমন যাদুঘর, চিড়িয়াখানা কিংবা শিশুপার্ক নিয়ে আমার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এ নিয়ে পরিচিত মহলের লোকজন হাসাহাসি করলেও আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। আমি মনে করি যাদুঘরে যেতে টিকেট লাগবে কেন? এর ভিতরে যে সব জিনিস প্রদর্শন করা হচ্ছে এগুলো তো আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এগুলো পূর্ব পুরুষের সম্পদ। আমরা যে জাতি হিসেবে অচ্ছুত নই।

কিংবা আমাদের যে গৌরবের ইতিহাস আছে এটা আমাদের সন্তান বা আগামী প্রজন্মকে টাকা খরচ করে দেখাতে হবে কেন? বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি কী টাকা দিয়ে ভোগ করি? এখানে যেতে টাকা লাগবে কেন? এগুলো কিসের আলামত? আমাদের সন্তানদেরকে ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার? নাকি মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সবখানে বাণিজ্য চালু করার নতুন কৌশল। বন্ধুরা এ নিয়ে আমাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে। তাদের বক্তব্য সরকারের এতবড় অর্থনীতি নেই যে, সব জায়গায় ভূর্তুকি দেবে। টিকেটের টাকায় যদি ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ হয় তাহলে সমস্যা কোথায়? আমি তর্কজুড়ে দেই, টাকাটা আপাতত বেশি মনে হচ্ছে না কিন্তু টিকেট নেয়ার রীতি যখন চালু হয়েছে তা একদিন যে বাড়তে বাড়তে অনেক বেশি হবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? আর এখন যে টাকায় টিকেট বিক্রি হচ্ছে তা কেনার সামর্থ কী সবার আছে? রাস্তায় যে মেয়েটা ফুল কুড়িয়ে মালা তৈরি করে ভদ্দননোকের কাছে বিক্রি করে সে কী একটা টিকেট কেনার সামর্থ রাখে? আমি নিশ্চিত রাখে না। কিন্তু এগুলোর ওপর কী তার কোনো অধিকার নেই? আছে।

কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না। আমরা যে অন্ধ হয়ে গেছি। বন্ধুরা এ ধারনাকে গোয়ার্তুমি মনে করে। গোয়ারকে যে বুঝানো যায় না এটা ধরে নিয়ে তারা কোনো কথা বলে না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বর্ষা।

সে আমার মতবাদ বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে এবং কখনো এ বিষয়ে তর্ক জুড়ে বসে না। শিশুপার্ক নিয়ে আমার মতবাদটা নিজস্ব পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্য হলেও তারা নিরূপায় হয়ে তাদের বাচ্চাদের পার্কে ঘুরতে নিয়ে যায়। আমার সোজা কথা, আমরা এ শহরটাকে শিশুদের অনুপযোগী করে তুলেছি। অথচ জন্মের পর একটা শিশু প্রকৃতির আলো-ছায়ার মধ্যে বড় হওয়ার অধিকার রাখে। আমরা সে অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করেছি।

এখন যে দু‘একটা কৃত্রিম পার্ক তাদের জন্য তৈরি করেছি সেটা অপ্রতুল হলেও ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের সেখানে ফ্রি ঢুকতে দিতে হবে। আমার এসব ভাবনা নিয়ে বন্ধুরা নানা সময় হাসি ঠাট্টা করলেও শ্রদ্ধা ভক্তি দেখায়। প্রকাশ্যে গোপনে বলাবলি করে আমি নাকি ছোটখাটো একজন চিন্তাবিদ। আর মাঝে মধ্যে দু‘চার লাইন লেখা কোনো খবরের কাগজ কিংবা স্মরণিকায় প্রকাশ পেলে তো কথাই নেই। আজকাল এসব বিষয় মাথায় কেবল গরুর জাবর কাটার মতো ঘুরপাক খায়।

অফিসের কেরানিগিরী করতে গিয়েও মাঝে মধ্যে মাথা বিগড়ে যায়। সব সময় যে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি এমন নয়। তবে বেশির ভাগ সময় ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করি। যদিও কষ্ট হয় তারপরও করি, বর্ষার জন্য। কেন চেষ্টা করি সে বিষয়টি না বললে আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন।

ভাববেন আমি বুঝি বর্ষাকে যমের মতো ভয় পাই। বিষয়টি এমন নয়। তারপরও ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলি। আমি সবেমাত্র বর্ষাকে বিয়ে করেছি। সম্ভবত বিয়ের ২/১ বছর পার হয়েছে।

মতিঝিলে একটা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদনার কাজ করি। সারাদিন গতর খেটে দম ফেলার জো নেই। প্রশ্নোত্তর তৈরি করা থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হয়। কিন্তু বইয়ে আমার নাম যায় না। নাম যায় বেসরকারি কোনো এক কলেজ শিক্ষকের।

ঐ অথর্ব লোকটা একটা লাইনও লেখে না। এ নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ আছে। আমি চাই আমার নামটা সম্পাদক হিসেবে না যাক অন্তত সম্পাদনা সহকারি হিসেবে থাকুক। কারণ এতে করে আমার চাকরি বদলের একটা সুবিধা হবে। কিন্তু মালিক পক্ষ এ কাজ করতে রাজি নয়।

একদিন এ নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া বেধে গেল। এক পর্যায়ে বলে উঠলো- আরে ভাই, আপনি বলদের মতো কথা বলছেন কেন? আপনি কোথাকার কে? আপনাকে কি কেউ চেনে? আপনার নাম ছাপিয়ে আমি কী ব্যবসা লাটে উঠাবো? আমার মাথা বিগড়ে গেল। শালা বলে কী। সারাদিন কুলোর বলদের মতো কাজ করি। তাও আবার ঠিক মতো মাইনে পাই না।

সে কিনা বলে এ কথা। আমার নাম দিলে নাকি ব্যবসা লাটে উঠবে। এখন কার কাজ দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। সেদিন রাগে দুঃখে অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে আসি। আর কোনো দিন ঐ অফিসের পথ মাড়াইনি।

আমার দুঃখের কথা শুনে বর্ষা অনেক কষ্ট পেয়েছিল। বললো দরকার নেই এ চাকরির। তুমি চলে এসে ভালো করেছ। বর্ষার কথা শুনে একটু ভরসা পেলাম। কিন্তু মাস শেষে টের পেলাম চাকরি কি জিনিস! সংসারে টানাটানি।

সকালে, বিকালে, সময়ে অসময়ে বাড়িওয়ালা এসে ভাড়ার জন্য তাগাদা দেয়। মাথা নিচু করে বাড়িওয়ালার কথা শুনি। কিছুই করার নেই। প্রতিদিন আধপেটে বাসা থেকে বের হয়। আর কাজ খুঁজি।

কিন্তু কাজ কোথায়? সবখানে হাহাকার। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পত্রিকা স্টলে পত্রিকা কেনার ভান করে পাতা উল্টায়। উদ্দেশ্য কোথাও চাকরির বিজ্ঞাপন দেখা যায় কি না। কোনো সম্ভাবনা দেখি না। চোখে পড়ে বিশ্ব মন্দার খবর।

তবে কোথায় যাবো? কি করবো? কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। এরমধ্যে দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ক্ষমতায় আসলো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। চারদিকে ধরপাকড়। প্রতিদিনই চমকপ্রদ খবর আসছে।

মানুষ বলাবলি করছে ব্যক্তিগত আক্রোশও নাকি অনেকে এই সুযোগে মেটাচ্ছে। অবশ্যই প্রকাশ্যে নয়। সবই চলছে কানাঘুষার মধ্য দিয়ে। পত্রিকা আর টেলিভিশনে দেশ প্রেমের গান আর দুর্নীতির বিরোদ্ধে জনমত গঠন করার জন্য সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিরা হেলিকপ্টারে করে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছে। চারদিকে এই নিয়ে হাসাহাসি, তবে গোপনে।

আমি আরো অস্থির হয়ে উঠি। একে তো চাকরি নেই অন্যদিকে দেশের এই অবস্থা। আপনাদেরকে সে দিনগুলোর প্রকৃত অবস্থা বুঝানোর জন্য একটি ঘটনার কথা বলি। তাহলে বুঝতে পারবেন দেশ কোথায় যাচ্ছিল। আমার এক বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে।

বেশ কয়েক মাস দুজনের মুখোমুখি দেখা কিংবা কথা বলাবলি নেই। শেষে আমাদের কয়েকজনের মধ্যস্থতায় সম্পর্কটা একটু শিথিল হয়। তবে প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে নয়। বলা চলে এক ধরনের বন্ধুত্ব। আচ্ছা বলুন তো সম্পর্ক কী কখনো বলে কয়ে এক জায়গায় স্থির থাকে? তার ওপর আবার দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক।

ফলে মোবাইলে কথা চালাচালি হলেও ফাকে ফাকে প্রেম বা বিয়ে সংক্রান্ত কথা প্রায়ই উঠতো। কিন্তু বিপত্তি যত ওখানেই। এ বিষয়ে কথা উঠলেই প্রেমিকা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো। একদিন সে ফোনে প্রেমিকাকে জিজ্ঞেস করছে কী করছো? সে বললো কী করছি এ কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? তোমার সঙ্গে জরুরি অবস্থা চলছে যে মানে? মানে সোজা। তোমাকে যদি প্রেম বা বিয়ের কথা বলি তাহলে ফোনটা রেখে দেবে।

এ জন্য কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তাদের ফোনালাপ শুনার পর আমি হাসতে হাসতে একাকার। জরুরি অবস্থা চললে এ দেশের কী অবস্থা হয় তা আমার মতো আপনারা অনেকেও হয়তো দেখছেন। মিডিয়া পাড়ায় কোনো খবর নেই। পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্য আম কাঠালের গুণাগুন আর নায়ক নায়িকাদের বুক পাছার মাপের খবর ছাপছে প্রতিনিয়ত।

আর সুশীলের উল্লাস দেখলে তো লজ্জায় মাথা হেড হয়ে যাওয়ার অবস্থা। জেলা উপজেলায় সাদা মনের মানুষের খোজে সবাই ব্যস্ত। রাজনীতিবিদরা যেন অচ্ছুত! একদিন পত্রিকায় দেখি সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ গণতন্ত্রের নতুন শিক্ষা দিচ্ছেন জনগণকে। আমি তো হতবাক! এটা কোন ধরনের কথা। সরকারি চাকরি করে রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে মত দেয়া! অন্যদিকে জনগণকে আশস্ত করছেন এই বলে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কোনো ইচ্ছা নেই।

মাথা বিগড়ে গেল। কিন্তু কি আর করার। আমার মতো বেকার লোকের মেজাজে ওদের কি আসে যায়? বাসায় ফিরে বর্ষার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বললে দেখি, আজকাল ও আমার কথার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। বলে- আদার বেপারির জাহাজের খবর না নিলে হয় না। আমি খুব আহত বোধ করি।

ভেতরে কান্নার স্রোতধারা বইতে থাকে। বেকার বলে দেশ রাজনীতি নিয়ে ভাবতে পারবো না। দু‘চোখ জলে ভিজে আসে। আমার এ অবস্থা দেখে সেও কাদতে শুরু করে। এমন অসহায় মূহুর্তে আমি হঠ্যাৎ করে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি।

ভেঙ্গে পড়লে চলবে? একটা না একটা ব্যবস্থা তো হবে। সময়টা খারাপ। দেখছো না, ভয়ে কেউ কিছু করতে চাচ্ছে না। সেদিন সে বললো- তোমাকে একটা কথা বলবো, রাখবে? আমি বললাম বলো- চেষ্টা করবো। না, আগে কথা দাও রাখবে।

রাখবো। এরপর থেকে যেখানে চাকরি করবে অন্তত মাথাটা ঠাণ্ডা রেখো। দেখছো না চাকরি নেই বলে চারদিকের মানুষের কথা শুনতে হচ্ছে। এত অপমান সহ্য করার চেয়ে একটা জায়গায় অপমানিত হওয়া ভাল না। আমি আর কোনো কথা বলি না।

নিজের সঙ্গে মনে মনে যুদ্ধ করি। আদর্শ ব্যক্তিত্ববোধ এসবের কি কোনো মূল্য নেই। আমরা কি এভাবে জিম্মি হয়ে পড়বো কর্পোরেটদের কাছে? মনের ভেতর যুদ্ধটা প্রতিনিয়ত দানা বাধে। চোখের সামনে ভাসে বর্ষার চেহেরাটা। ভাবি যদি আমার আদর্শ এক জায়গায় জলাঞ্জলি দিয়ে চারদিক সামাল দেয়া যায় না হয় দিলাম।

তারপর থেকে আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে বিক্রি করার জায়গা খুঁজি। এবং একদিন তা পেয়েও গেলাম। এ জায়গাটা যে আমার অপরিচিত এমন নয়। দু‘চার লাইন লেখালেখির সুবাদে সংবাদপত্রের কিছু মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। তাদেরই একজনকে ধরে একটি পত্রিকার অফিসে কাজ জুটিয়ে নিলাম।

অফিসে প্রতিদিন আসি যাই। কোনো কিছু নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমার এ ধরনের নির্বিকার ভাব দেখে অন্য কলিগরা সুযোগ নিতে থাকলো। কোনো কাজের দরকার হলেই ওরা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। আমি চাকরি হারানোর ভয়ে ওদের সব আবদার গিলে খাই।

এভাবে চলছে প্রায় দুই বছর হলো। কিন্তু আজ সকালে অফিসে ঢুকেই আমি চাকরিটা হারালাম। বিশ্বাস করুন আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো মানুষ। আমার ভুল হতেই পারে।

তাই বলে ভুলের মাশুল হিসেবে চাকরি হারাব ভাবতে পারিনি। কিন্তু আমার এই ভুলটুকু শোধরানোর সময় কোথায় বসদের। ঘটনাটা একদিক থেকে দেখলে অনেক বড়। অন্যদিক থেকে তেমন কিছুই না । তারপরও বিষয়টা আপনাদের বলি।

আমি পত্রিকায় প্র“ফ রিডিং এর কাজ করি। প্রথম এবং শেষ পাতার ম্যাটার পড়ে দিই। গতকাল একটা নিউজ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবম শতকের দুটি মূর্তি পাওয়া গেছে। সুলতানপুর গ্রামে এক মেম্বারের বাড়ির পাশে পুকুরের পাড় অতি বৃষ্টির কারণে ভেঙ্গে গেলে মূর্তি দুটি বেরিয়ে আসে। ফাইনাল ট্রেসিং আউট করার আগে সাদা কাগজে আমি নিউজটি পড়ে দিই।

কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া শব্দটি ভুলে ব্রাক্ষণবাড়িয়া রয়ে যায়। আমার চোখে পড়েনি। এটি ছিল শেষ পৃষ্ঠার বক্স আইটেম। পরদিন অফিসে এসে দেখি তুলকালাম কাণ্ড। নিউজ এডিটর আমাকে ডেকে পাঠায়।

আমি তার কাছে করজোড় ক্ষমা চাই। কিন্তু তার এক কথা, কাল থেকে আমাকে যেন অফিসে না দেখে। আমার পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যেতে থাকলো। কি করবো বুঝে ওঠতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বিক্রি করেও চাকরিটা বাঁচাতে পারলাম না।

অফিস থেকে বের হয়ে এলোপাতাড়ি হাঁটতে শুরু করি। গন্তব্যহীন হাঁটা। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেট শেষ। ঘোরের মধ্যে সকালে কেনা পুরো প্যাকেটটাই শেষ করে ফেলেছি। ফুটপাতের একটি টং দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়ে খেয়াল হলো ভুল রাস্তা ধরে হেঁটে আসতে আসতে বলধা গার্ডেনের কাছে চলে এসেছি।

এখন আমার আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। অতিরিক্ত সিগারেট টানার কারণে মাথাটা কেমন যেন ঝিম ছিম করছে। সামনের দিকে একটু হেঁটেই দেখি গার্ডেনের গেট। পকেট থেকে খুচরা টাকা বের করে কাউন্টারে টিকেটের জন্য হাত বাড়াই। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে।

দ্রুত গার্ডেনের ভেতর প্রবেশ করি। এই প্রথম কোনো স্থানে টিকেট কিনে প্রবেশ করলাম। নিজের ভেতর নানা প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। কিভাবে বাঁচতে চেয়েছি কি ঘটছে। জীবন কী এমন আচরণই করে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে? আপসকামিতা কিংবা আদর্শবাদীতা সব কিছু কি কর্পোরেটদের করতলে? মেলাতে পারি না।

কেবল ঘোরপাক খায়। গার্ডেনের ভেতরে প্রবেশ করে হাঁটতে হাঁটতে শান বাধানো ঘাটে এসে বসলাম। প্রচুর লোকজন। বেশির ভাগই উঠতি বয়সী। গা ঘেষে ঘেষে বসে আছে বাগানের ঝোপের ভেতর।

কেউ কাউকে দেখে লজ্জাবোধ করছে না। একটা ছেলেকে দেখলাম তার বান্ধবীর বুকের উপর হাত মারছে। এখানে যে মানুষজন আছে সে সম্ভবত ভুলে গেছে। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীও আছে। ওরা নিশ্চয় এসেছে প্র্যকটিক্যাল ক্লাসের উপকরণ যোগাড় করতে।

আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে এ সব দৃশ্য দেখছি। নিজের উপর ভীষণ অভিমান হচ্ছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ঘাট থেকে নিচের দিকে গেলাম হাত মুখ ধুতে। পাশেই কয়েকটি ছেলে ঘাটের শেষ সিড়িতে বসে পানি ছিটাছিটি করছে।

আমি পানিতে হাত রেখে একটু সস্থি অনুভব করলাম। হঠ্যাৎ কানের মধ্যে একটি বিশ্রী শব্দ এসে বিধলো। মালটা খুব কড়া। দেখ দুধগুলো। আশেপাশে তাকালাম।

কোনো মেয়ে ছেলে চোখে পড়লো না। এমন সময় পুকুরের অপর পাড়ে চোখে পড়লো, কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে বয়স্কগোছের একজন ভদ্রমহিলা। হতে পারে ওদের মা কিংবা শিক্ষক। ভাবলাম ঐ মহিলার কানে শব্দটি গেলে কি প্রতিক্রিয়া হতো।

ইচ্ছে করছিলো উঠে দাঁড়িয়ে কানের উপর কষে দুটো চড় লাগায়। সাহস করতে পারলাম। মুখ ধুয়ে এসে ঘাটে বসলাম। বর্ষার কথা খুব মনে পড়ছে। বাসায় গিয়ে ওকে কি বলবো।

মনে পড়লো অনাগত সন্তানের কথা। ভাবছি ওকে পৃথিবীতে এনে কি ভুল করছি। নাকি চলমান দিনগুলো প্রত্যেক মানুষেরই এমন কঠিন যায়? পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলাম। গেটের ঢুকার সময় চোখে পড়েছিল ধূমপানমুক্ত এলাকা। কিন্তু ভেতরে দেখছি অনেকেই সিগারেট ফুকছে।

আইন মেনে কি লাভ! মানুষের কোলাহল বাড়ছে। আমার পাশ ঘেষে আরো কয়েকটি ছেলে মেয়ে এসে বসলো। বাদাম খাচ্ছে আর খোসাগুলো পানিতে ছুড়ে মারছে। দেখলাম মাছগুলো খোসাকে খাবার মনে করে খেতে চেষ্টা করছে। ছেলেগুলো এ দৃশ্য দেখে বেশ মজা পাচ্ছে।

আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস আমার একদম পছন্দ না। জীবন কি এ রকম মিথ্যা আশ্বাসের ওপর চলছে? আমাদের চোখের সামনে স্বপ্ন নামক যে মুলাটি ঝুলানো এটি চির সত্য? না কেবলি মোহ। এসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।

বর্ষার ফোন। হ্যালো কি করছো। বললাম কিছু না। তোমাদের পত্রিকায় তো দেখলাম একটা মেজর ভুল। কী ভুল? ব্রাহ্মণবাড়িয়া যে ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে আছে।

আমি কোনো কথা বললাম না। ফোনটা কানের কাছে ধরে রেখে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে একটি পরিচিত কণ্ঠের শব্দ শুনতে পেলাম। হাসান এই হাসান। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি নীলা।

আরে বাবা কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনতে পাচ্ছস না। বললাম না। তুই এখানে কি করে এলি? ভুল পথে, না ইচ্ছে করে। না ইচ্ছে করেই এসেছি। যাক শেষ পর্যন্ত নিজের চিন্তাধারা পাল্টালি।

কেবল মাথা নাড়ালাম। হ্যা বা না কিছুই বলিনি। ও বললো চল বাইরে কোথাও দাঁড়িয়ে চা খাই। বললাম তাড়া আছে অন্য একদিন। দ্রুত বের হয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।

চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে ব্রাক্ষণবাড়িয়া আর বর্ষার মুখ। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বর্ষাকে ফোন দিই। ওপার থেকে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে যায়। আবার চেষ্টা করি। এবার আর ফোন যায় না।

কেবল বাবার বেজে উঠছে আপনার আ্যকাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ... ১৫.০৯.১০ ঢাকা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.