আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেঁড়া মন .... এজীবন

আমার মন খারাপের পরেও, আমি আছিরে তোর পাশে...
অস্থির বোধ করছে নীনা। কোন কিছুতেই মন দিতে পারছেনা। রাকেশের আসার সময় হয়ে এলো। কি করে বলবে নীনা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। রাকেশের এই কথা শোনার মত এতটুকু প্রস্তুতিও যে থাকবেনা নীনা ভালো করেই জানে সেটা।

তবু ওকে বলতে হবে। রাকেশের সাথে দেখা করার ইচ্ছাই ছিলোনা ওর। কিন্তু অন্য কারো দ্বারা খবর পাঠালে রাকেশ কিছুতেই বিশ্বাস করবেনা জানে নীনা। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই টেবিলে আঙ্গুলের ঠুকঠুক শব্দে চমকে তাকায়। রাকেশের শান্ত-স্নিগ্ধ হাসিতে চোখ আটকে যায়।

বুকের ভেতর উত্তাল কান্নার ঢেউ আছড়ে পরে। সামলায় নিজেকে নীনা। ’আজকের পর তুমি আর আমার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করবেনা। ’ - নীনা হঠাৎ করেই বলে ফেলে.. .. রুক্ষ কন্ঠে। ছোট্র অফিস ঘরটাতে যেন বাজ পরে।

আশে-পাশের কলিগরা সচকিত হয়। ওরা এতদিনে নীনা-রাকেশ দুজনেরই ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। নীনা এই অফিসে আছে প্রায় তিন বছর। এর মধ্যে রাকেশ কম করে হলেও তিনশো বার এসেছে। রাকেশের চাইতে কলিগরাই বেশি উদ্বিগ্ন মনে হোল।

কেউ ভাবেনি নীনা এমন একটা সিদ্ভান্ত নেবে। সাতদিন আগে নীনা-র বাবা হঠাৎ করেই ধরাধাম ত্যাগ করেছেন। মধ্য বয়স্ক মা আর ছোট তিনটি ভাই ও দুটি বোনের দায়িত্ব নীনার উপরেই বর্তায়। কলিগরা সবই জানে। এতটুকু রাকেশও জানে।

এতটুকু জেনেই রাকেশ বলেছিলো- ”তোমার পরিবার কি আমার কেউ নয়? কেন তুমি আমাকে পর করে দিতে চাইছো? তুমি আর আমি একসাথে ওদের বড় করে তুলবো। কেন ভাবছো তুমি?” কলিগরা স্বস্তি পেয়েছিলো শুনে। কিন্তু তারপরের ঘটনাগুলো জানা হয়নি কারো। নীনা মায়ের কাছে রাকেশের কথা তুললে বাড়িতে শোকের মাতম শুরু হয়। মা মুখ ভার করে বসে থাকেন ঘরের চৌকাঠে।

ছোট ভাই-বোনগুলো মায়ের চারপাশে বসে থাকে শুকনো মুখ করে। তারা যেন মায়ের কথাটাকেই আবৃত্তি করে ”দিদি, তুইতো বিয়ের পর আমাদেরকে দেখবিনা। তখন আমাদের কি হবে? আমরা যে না খেয়ে মারা পরবো। ” নীনা তাদের কিছুতেই বোঝাতে পারেনা সে এখন যেমন করে তাদের দেখছে তখনও এমনি করেই দেখবে। নীনা-র উপর তাদের ভরসা হয়না।

বাড়ির এই পরিস্থিতি দেখেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। সকালে খাওয়া হয়নি কিছুই। দুপুরেও গলা দিয়ে কিছু নামাতে পারেনি। শুধু ভেবেছে কি করে রাকেশ-কে বলবে সে? অবশেষে কথাটা বলে ফেলার পর যেন আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে বেরিয়ে আসে। রাকেশের ঘাড়ে এত বড় বোঝা চাপিয়ে দেয়ার অধিকার তার নেই।

রাকেশের জীবন সে পাঁচ বছরের সম্পর্কের দোহাই দিয়ে নষ্ট করে দিতে পারেনা- এতটুকু বলে গুম হয়ে থাকে। নীনা-র জেদের কাছে রাকেশের জোড় মুখ থুবরে পরে। রাকেশ চলে গেলে কলিগরা সব শুনে নীনা-কে বারবার অনুরোধ করে নিজের জীবনটা এমন হাতে ধরে যেন নষ্ট না করে। কিন্তু নীনা তার সিদ্ধান্তে অটল। মারা যাবার সময় বাবা ছোট ভাই-বোনগুলোকে তার হাতেই তুলে দিয়ে গেছেন যে! এরপর কেটে যায় দিন, মাস, বছর।

নীনা তার দু’বোনকে অবস্থাপন্ন ঘরে পাত্রস্থ করে। তিনটি ভাই প্রতিষ্ঠিত হবার পর নিজেদের পছন্দে বউ ঘরে তোলে। নীনার বয়সটাও সময়ের হাত ধরে এগিয়ে যায় অনেকটাই। এতগুলো দিনের মধ্যে একটিবারের জন্যেও কেউ ভাবেনি সারাটা জীবন নীনা শুধু কারো মেয়ে আর দিদি হয়েই কাটিয়ে দিতে পারেনা। নীনা শহরে হোস্টেলে থেকে চাকরী করে।

ছুটি ছাটায় বাড়ি আসে। বাড়ির ভিটা-টা পৈতৃক। কিন্তু ভাগাভাগির সময় সেটা তিন ভাইয়ের নামেই যায়। মায়ের নামে যা ছিলো তা মা তার ছোট দুই মেয়েকেই দান করেন। নীনা চাকরী করে; স্বাবলম্বী।

দুই মেয়েকে যদি জামাইরা না দেখে তাহলে যেন মায়ের ওই সম্বলটুকুই ওদের সহায় হয় এই যুক্তিতে নীনা বাদ পরে মায়ের সম্পত্তি থেকে। নীনা-র তাতে কোন আক্ষেপ থাকেনা। তারতো আসলে এসবের দরকার নেই। ভাই-বোনের থাকা মানেই ওর থাকা। এক সময় ছুটিতে নীনার বাড়ি আসা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়।

ভাইরা তাদের মা-কে জানায় - ”দিদি যে হোস্টেলে থাকে এটা নিয়ে তোমার বউরা তাদের বাপের বাড়িতে কথা শোনে। শহরের হোস্টেলে কোন ভালো মেয়ে থাকে?” ”তুমি দিদিকে বলো মাসে একদিন-দুদিনের জন্যে বাড়িতে না এলে কি হয়?” ভাই-দের কথা পূনরাবৃত্তি করে বোনেরা। তারাও নাকি দিদির কারণে তাদের শ্বশুর বাড়িতে অপদস্থ হচ্ছে। দিদির বাড়িতে না আসাই ভালো। মা নীনা-কে বলেন বড় যেহেতু সে, ভাই-বোনের কিসে ভালো হয় তাতো তাকে দেখতেই হবে ।

নীনা বয়সে মায়ের সমান না হলেও জীবনভর খাটা-খাটনির কারণে মায়ের মতই চলাফেরায় অক্ষম হয়ে পড়েছে। মায়ের উপর অভিমান করেই সে বাড়ি ছাড়ে চিরকালের মত। মা-কে জিজ্ঞেসও করেনা চাকরী করার ক্ষমতা যখন তার থাকবেনা তখন সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!!! বৃদ্ধাশ্রমের প্রশস্ত বারান্দায় বসে সামনের গাছ-গাছালি ঘেরা পুকুরে দৃষ্টি মেলে নিজের জীবনটাকে অনেকদিন পর মেলে ধরেছিলো নীনা আশ্রমের কুড়ি বছর বয়সের তরুনি অ্যাটেনডেন্ট এর কাছে। অ্যাটেনডেন্ট এর কপোল ভিজিয়ে দেয়া চোখের জলের দিকে তাকিয়ে নীনা স্মিত হেসে উঠতে যাবে, দু’পা নিশ্চল হয়ে যায় পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধকে দেখে। বৃদ্ধের মুখে সেই চির চেনা শান্ত-স্নিগ্ধ হাসি।

স্নৃতির ফ্রেমে আটকে থাকা সেই হাসি যেন বৃদ্ধা-কে বলছে ”আমাকে হারিয়ে দেবে ভেবেছিলে!!” নীনা আর রাকেশ হাত ধরে টুকটুক করে আগাতে থাকে করিডোর ধরে। এর মাঝেই শুনে নেয় নীনা রাকেশের এই বৃদ্ধাশ্রমে আসার কাহিনী। নীনা-কে ছাড়া আর কাউকে জীবন-সঙ্গী করার কথা ভাবতে পারেনি রাকেশ। তাই চাকরী-বাকরী করে কামানো টাকা-পয়সা আর নিজের নামের সম্পত্তি সব ভাতিজা-ভাতিজিদের নামে বিলি বন্দোবস্ত করে নিজে চলে এসেছে এখানে। দুজন মানুষ - যারা নিজেদের দিকে কখনো ফিরে তাকাবার অবসরটুকু পাননি, তারা জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্যে উপলব্ধি করেন না পাওয়া সুখের প্রাপ্তিটুকু।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।