আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আশরাফুলকে ধন্যবাদ, বিপিএলকেও!

ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন টালমাটাল, মনে পড়ে যাচ্ছে প্রায় ১৩ বছর আগের সেই সন্ধ্যা। পরদিন এশিয়া বনাম বাকি বিশ্ব একাদশের প্রদর্শনী ম্যাচ। ঢাকায় বিশ্ব ক্রিকেটের রথী-মহারথীদের ভিড়। উৎসবের সেই আবহের মধ্যেই এল সবাইকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো এক খবর—হানসি ক্রনিয়ে ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে জড়িত!
উড়ো কোনো অভিযোগ নয়। টেলিফোনে আড়ি পেতে রেকর্ড করা বুকিদের সঙ্গে ক্রনিয়ের কথোপকথনও ততক্ষণে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে দিল্লি পুলিশ।

শেন ওয়ার্ন ও টিম মের অভিযোগের সূত্র ধরে সেলিম মালিকের কুকীর্তি তত দিনে প্রকাশিত। ফিক্সিং যে অনেক দিনই ক্রিকেটে শিকড় ছড়িয়েছে, সেটিও অজানা কিছু নয়। তার পরও এই পূতিগন্ধময় জগতের সঙ্গে ক্রনিয়ের সম্পৃক্ততা বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। তিনি হানসি ক্রনিয়ে, মাঠে ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড়ি শুদ্ধতার প্রতীক, ক্রিকেটের মহান দূত...ধেৎ, এটা হতেই পারে না। এই অবিশ্বাস ও পরদিনের তারকাখচিত ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনায় প্রথম আলোতে ক্রনিয়ের খবরটা যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, ততটা পায়নি।

যখনই তা ভাবি, একটু লজ্জা পাই। বড় একটা শিক্ষাও।
হানসি ক্রনিয়ে ক্রিকেটের বড় একটা ক্ষতি করেছেন, সঙ্গে বড় একটা ‘উপকার’ও! ক্ষতির ব্যাপারটা তো বোঝাই যাচ্ছে। উপকার কীভাবে? উপকার—এর পর থেকে ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আপাত-অবিশ্বাস্য কোনো নাম উচ্চারিত হলেও সেটিকে আর উড়িয়ে দিই না। উড়িয়ে দিতে গেলেই মনে পড়ে যায় ক্রনিয়ের কথা।

ক্রনিয়ে যদি পারেন, তিনি কেন নন?
মোহাম্মদ আশরাফুলের ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরই যেমন হতাশা-দুঃখ-ক্ষোভ যতটা মনে খেলা করেছে, বিস্ময় তার চেয়ে অনেক কম। ক্রিকেট-বিশ্ব যেখানে অনেক দিনই এই ফিক্সিং-বিষে নীল, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কীভাবে ব্যতিক্রম হন! তাই বলে মোহাম্মদ আশরাফুল? এই প্রশ্নটা মনে বুদ্বুদ তুলেই হারিয়ে গেছে হানসি ক্রনিয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায়।
তার মানে কি কাউকেই আর বিশ্বাস করা যায় না? ফিক্সিংয়ের সবচেয়ে সর্বনেশে দিক এটাই। শুধু ক্রিকেটার নন, ক্রিকেটের ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা। ক্রিকেটের অনন্ত আকর্ষণের মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর তো অনিশ্চয়তার হাতছানিই।

যে কারণে জেতার জন্য হাতে ৫ উইকেট নিয়ে কোনো দলের ১০ ওভারে ৪৫ রান প্রয়োজন থাকলেও আমরা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকি। ক্রিকেটে কিছুই বলা যায় না, এখানেও নাটকীয় কিছু ঘটতে পারে।
শচীন টেন্ডুলকার ফুল টস বল শর্ট কভারের হাতে তুলে দেবেন, ডেল স্টেইন এক ওভারে তিনটি ছক্কা খেয়ে যাবেন, বিশ্বসেরা ফিল্ডার লোপ্পা ক্যাচ ফেলে দেবেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ বছর কাটিয়ে ফেলা দুই ব্যাটসম্যানও স্কুলের বাচ্চাদের মতো এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে রানআউট হয়ে যাবেন—ক্রিকেট খেলায় সবই সম্ভব। সব সম্ভব বলেই তো ক্রিকেট এমন মজার খেলা। কিন্তু এখন আপাত-অসম্ভব কিছু ঘটলেই ফিক্সিংয়ের বিষবাষ্পে নিঃশ্বাস নিতে থাকা দর্শকদের মনে সন্দেহ জাগে।

এর মধ্যে টাকাপয়সার কোনো ব্যাপার নেই তো!
এত দিন বাংলাদেশের একটা গর্ব ছিল। মাঠের পারফরম্যান্সে মাঝেমধ্যেই বিব্রত হওয়ার কারণ থাকলেও অন্তত অন্ধকার ওই জগতের সঙ্গে আমাদের ক্রিকেটারদের কোনো যোগ নেই। সেই গর্ব ভেঙে গেল বলে আপনার মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্রিকেট তো অনেক দিনই এই দেশে শুধুই একটা খেলা নয়। ক্রিকেট একটা আবেগের নাম।

সমস্যাকণ্টকিত এ দেশের মানুষের জন্য ক্রিকেটই বয়ে আনে ‘দুদণ্ড শান্তি’। নিত্যদিনের টানাপোড়েন ভুলে একসঙ্গে হেসে ওঠে পুরো বদ্বীপ। সেই আবেগের সঙ্গে প্রতারণায় রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু ‘সত্য যে কঠিন’। ‘সেই কঠিনেরেই ভালোবাসিলাম’ বলতে পারাটা সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও যে নেই।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এই ‘কঠিন’-এর মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য মোহাম্মদ আশরাফুলের একটা ধন্যবাদও প্রাপ্য। আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগ, আকসুর কাছে আশরাফুলের স্বীকারোক্তিই তো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এত দিন আমরা আসলে সুখস্বপ্ন দেখছিলাম। যে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে এই ঘোর বাস্তবতা—ফিক্সিংয়ের বিষ অনেক দিন আগেই ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের শিরায়-উপশিরায়।
ভারতে আইপিএলের দেখাদেখি বাংলাদেশেও যখন তড়িঘড়ি করে বিপিএল নামিয়ে দেওয়া হলো, অস্বস্তির একটা কাঁটা নিরন্তর খচখচ করছিল মনে। সেটি নানা জায়গায় প্রকাশ করায় ‘বিপিএলবিরোধী’ তো বটেই, ‘প্রাচীনপন্থী’ বলে একটা ‘অপবাদ’ও জুটে গিয়েছিল।

তার পরও নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসার কোনো কারণ দেখিনি। এই আইপিএল-বিপিএল জাতীয় টুর্নামেন্টে খেলার বাইরের বিষয়-আশয় এমন মুখ্য হয়ে যায় যে খেলার মূল সুরটাই তাতে কেটে যায়। খেলার নৈতিকতাবোধও মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে।
শুরুটা হয় যা দিয়ে, সেই খেলোয়াড় নিলামের কথাই ধরুন না। ক্রিকেটাররা পেশাদার, খেলাটাই তাঁদের জীবিকা।

এই অর্থে টাকার জন্যই খেলেন তাঁরা। কিন্তু আইপিএল-বিপিএল সেটিকেই খেলার একমাত্র কারণ বানিয়ে ছাড়ে। খেলোয়াড় নিলাম যেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ক্রীতদাস-প্রথার সেই অন্ধকার যুগে। একেকজন খেলোয়াড়ের নাম ওঠে আর চলে দামাদামি—শেষে আসে কুৎসিত এক ঘোষণা, ‘অমুককে অত টাকা দিয়ে কিনেছে অমুক দল। ’
‘টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া’ ক্রিকেটারের সঙ্গে তাই মালিক-কর্মচারীর সম্পর্কই হয় ফ্র্যাঞ্চাইজির।

ইচ্ছা হলে কাউকে খেলাবে, ইচ্ছা হলে বসিয়ে রাখবে, দুর্বলচিত্ত ও লোভী খেলোয়াড়দের দিয়ে অনৈতিক কাজ করিয়ে নিজের পকেট ভারী করবে। বাংলাদেশের বাজারের সঙ্গে বাস্তবতাবিবর্জিত কোটি কোটি টাকার বিপিএলের দুর্নীতির আখড়া হয়ে ওঠাটা একরকম অবশ্যম্ভাবীই ছিল। আকসুর তদন্তে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের দুই মালিক ও প্রধান নির্বাহী অভিযুক্ত হওয়ায় এই ফ্র্যাঞ্চাইজিটিতে ফিক্সিং যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, সেটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। তবে এটা মনে করার কোনো কারণই নেই যে বাকি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো সব ধোয়া তুলসীপাতা। বাতাসে নানা রকম কথাই ওড়ে এবং তার সবই মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়ারও কোনো কারণ দেখি না।


এখন অবশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিপিএলের একটা বড় অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে। এই বিপিএলের কল্যাণেই তো আলোয় এসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ। আশরাফুলের ধন্যবাদ প্রাপ্য বলছিলাম, ধন্যবাদ প্রাপ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও। আকসুকে নিয়োগ দেওয়া এবং তদন্তে সর্বাত্মক সহযোগিতা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিসিবির ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষিত নীতি বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে বলে শোরগোল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিশ্ব ক্রিকেটে বিসিবির ভাবমূর্তি বরং এতে আরও উজ্জ্বলই হয়েছে।
হ্যাঁ, একটু লজ্জা তো লাগেই। লজ্জা পাওয়ার মতো আরও অনেক কিছুই হয়তো এখনো উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন আশরাফুল। প্রথম ঘটনাটি সেই ২০০৪ সালের।

‘প্রথম’ বলতে আশরাফুলের প্রথম। কে জানে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে হয়তো এই ঘুণপোকা আরও আগে থেকেই বাসা বেঁধেছে। আশরাফুলের স্বীকারোক্তিতে ফিক্সিংয়ে জড়িত বলে সাবেক তিন ক্রিকেটারের নাম এসেছে। বিপিএলে ফিক্সিংয়ে ‘কেঁচো’ খুঁড়তে গিয়ে যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিক্সিংয়ের ‘সাপ’ বেরিয়ে এসেছে, সেটির তদন্তে আরও অনেক নক্ষত্রপতনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সেই ভূমিকম্প এমনও হতে পারে, যেটির কাছে বিপিএলে ফিক্সিং কেলেঙ্কারি ‘মামুলি’ বলে মনে হবে।

আশরাফুলের স্বীকারোক্তির আন্তর্জাতিক অংশটুকু নিয়ে তদন্তের ব্যাপারে আইসিসির নীতি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে রাজি হননি সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী ডেভ রিচার্ডসন। সেটি না বলুন, আকসু যে এ ব্যাপারেও আটঘাট বেঁধেই নামছে অথবা নেমে গেছে, এটি নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।
একটা সময় বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা রসিকতা চালু ছিল। বাংলাদেশকে হারার জন্য বুকিরা কেন টাকা দেবে, বাংলাদেশ তো এমনিতেই হারে। ফিক্সিং যে অনেক দিনই শুধু ম্যাচ জেতা-হারায় সীমাবদ্ধ নেই, এটা কারও মনেই ছিল না।

একজন, দুজন বা তিনজন খেলোয়াড়কে ‘কিনে ফেলা’ই ম্যাচ হারার নিশ্চয়তা দেয় না। যে কারণে এখন সবচেয়ে বেশি বাজি হয় ব্যাটসম্যানের স্কোর আর নির্দিষ্ট তিন বা চার ওভারে কত রান উঠবে এ নিয়ে। বুকিদের পরিভাষায় দ্বিতীয়টির নাম ‘ব্র্যাকেট ফিক্সিং’। বিপিএলে এটি আকছার হয়েছে বলেই গুঞ্জন। আর আশরাফুল তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই ‘ব্র্যাকেট ফিক্সিং’ করে ২৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা নিজেই স্বীকার করেছেন আকসুর কাছে।


টেলিভিশনে সম্প্রচারিত যেকোনো ম্যাচ নিয়ে এত হাজার হাজার কোটি টাকার বাজি হয় যে ক্রিকেটারদের জন্য পদে পদেই পাতা থাকে লোভের ফাঁদ। আর ‘লোভ’ জিনিসটা মানুষের এমনই মজ্জাগত যে বুঝে না-বুঝে কারও না-কারও সেই ফাঁদে পা দেওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘না-বুঝে’ কথাটা লেখা ঠিক হয়নি। যারা এসব করে, বুঝেশুনেই করে। অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়েও ফিক্সিং নিয়ে আকসুর নিয়মিত ব্রিফিং হয়।

যেকোনো টুর্নামেন্ট বা সিরিজের আগে তো হয়ই। বুকিদের কর্মপদ্ধতি নিয়েও বিস্তারিত বর্ণনা থাকে তাতে। কখনো ওরা আসে ব্যাটের স্পনসর হয়ে, কখনো বা নিছক ভক্ত সেজে—কোনো কিছুই তাই আধুনিক ক্রিকেটারের অজানা নয়। তার পরও যদি কেউ এই অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়, সেটি জেনেশুনে লোভের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছু নয়। সেটির শাস্তি শুধু ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করায় সীমাবদ্ধ না রেখে জেল-জরিমানা পর্যন্ত বিস্তৃত করার দাবিও তাই উঠছে।

ফিক্সিং অনেক দেশেই ফৌজদারি অপরাধ বলে বিবেচিত। ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারদের ফিক্সিংয়ের রাহুমুক্ত রাখতে বাংলাদেশেও এই আইন প্রণয়নের সময় এসে গেছে।
ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হওয়াটাও বড় শাস্তি, তবে গায়ে ‘জেলখাটা আসামি’র দাগ লেগে যাওয়ার ভয়টা একটু বেশিই হওয়ার কথা।
উৎপল শুভ্র: সাংবাদিক।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.