আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবসান

www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
ওরা বলে, জীবনের কোন এক ক্ষণে, কোন এক অবিনাশী মুহূর্তে, কোন এক অশনি বাতাসের দোলায়, তোমার হারিয়ে যাওয়া সব দিনগুলো তোমায় আলতো পরশ বুলিয়ে যাবে, শেষবারের মতন। মাটির চুলার দিন ফুরিয়েছে আজ। লঘুচাপের বায়ুবৎ পদার্থের ইন্ধনে খাদ্যদ্রব্য পাক হয় ঠিকই, কিন্তু এর উপাদানসমূহ মাটির মমতা হারায়। হাড়ির উপরের ব্যতিব্যস্ত বাষ্প মৃত্তিকার স্পর্শ বোঝেনা, ফলে কী এক উচ্চাকাঙ্খায় ওরা ঊর্ধ্বমুখী হয়, অতঃপর সেমিপাকা ঘরের নিচু ছাতের আবদ্ধ কামরায় ছটফট হতাশায় ভোগে পরিশেষে; হয় নৈরাশ্যবাদী। ঠিক এমনই এক দিনে, মধ্যাহ্নের ঠিক আগে, যখন উপজেলার এই অনগ্রসর কিন্তু উন্নয়নশীলতার বিষমবাক্যে পরিপুষ্ট জনপদ কিঞ্চিত ক্লান্তিতে ভোগে, ক্ষণিকের জন্য থেমে যায় সবকিছু, থেমে যায় পাশের ঐ সাইকেলরিক্সা মেরামতের টুঙটাং, পাশের উত্তরণশালা কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় ভোজ্য-আহার্যের হাঁকডাক, গলিপথে শুধু শোনা যায় কোন এক অজানা পথিকের পা টেনে চলা, তখন বদ্ধ ঘরের এই কুটিরে বসে তুমি শুনবে ভাদ্রের হাহাকার, বসন্তের কোকিল কুহক।

পৌষের চাদরখানি জড়িয়ে নিতে নিতে তুমি বৃথা অপেক্ষায় থাকো শ্রাবণধারার। কার্তিক আজকাল ভুলে গেছে ধানের গন্ধ, কারণ জৈষ্ঠের তাপদাহে পিষ্ট হয়ে গেছে আষাঢ়। বৈশাখের লু হাওয়া তাই তোমার কর্ণকুহরে ফিসফিসিয়ে বলে যায় কিছু, আর তুমি বুঝে যাও শরতের ফুল তোমার এই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের সামর্থ্যের বাইরে। তুমি তাই শুধু অপেক্ষায় থাকো সাদামাঠা মধ্যাহ্ন আহারের। তোমার ঘরগৃহস্থালির তত্ত্বাবধায়ক কেউ বসিয়ে গেছে শর্করা ও শ্বেতসার, সাথে থাকতে পারে কিছু আমিষ ও স্নেহ জাতীয় বিলাসিতা।

এক পলকে কাঠের জানালার শার্সির উপর বসে থাকা এক কাকের শব্দহীন বাকবিমুখতা দেখে তোমার মনে পড়ছে ওদের কথা। হ্যাঁ, ওরা অনেক কিছুই বলে। ওরা শব্দ নিয়ে খেলে। বাক্য গঠন করে। ওগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয় অর্থপূর্ণ স্বেচ্ছাচারিতা।

ব্যক্ত করে অভিপ্রায়। ব্যাখ্যা করে জীবন। মনন। মানস। অথচ ওরা শুনতে পায়না শব্দদের অট্টহাসি।

বিদ্রূপ উপহাস। পার্থিব ধ্বনিসমষ্টির তালে ওরা খেলতে চায় অতীন্দ্রিয় খেলা। ব্যাকরণ দিয়ে বুঝতে চায় প্রকরণ। নির্বোধ। আত্মতুষ্ট।

ওরা ব্যাখ্যা করে মৃত্যু। অতঃপর মনোযোগী হয় জীবনের প্রতি। নির্বোধ। পথভ্রষ্ট। আজ সকাল হতেই তাই ক্ষণে ক্ষণে যখন ভেসে উঠছিলো কিছু, ভেসে উঠছিলো সাদাকালোরঙিন কিছু অর্থহীন মুহূর্ত, ভেসে উঠছিলো ছোট্ট আঙুল, রাঙা ঠোঁট, চুড়ির শব্দ, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ, তখন তুমি দ্বিধাচিত্তে কলম নাড়াচাড়া করছিলে, ভাবছিলে বন্দী করবে চূড়ান্ত মুহূর্ত।

যে লেখা কেউ লিখে যেতে পারেনি। যে লেখা লেখার আগেই থেমে যায় লেখক। যে লেখার নেই কোন সর্বশেষ পূর্ণযতি, বিরামচিহ্ন... খুব গভীর মগ্ন নিমগ্ন নিবিষ্ট তন্ময়চিত্তে স্থির হলে তুমি বুঝে যাবে অনেককিছু। তোমার বস্তুগত শরীর খোলস পালটাবে, ঝেড়ে ফেলবে অবাঞ্ছিত অনাবশ্যক অস্থিরতা। তুমি শুনবে মাকড়সার হেঁটে যাওয়া শব্দ, দলছাড়া পিঁপড়ের আর্তনাদ।

শুনবে হাজারবছর আগের কোন এক শিশুর ক্রন্দন, টের পাবে জননী কোলের উষ্ণতা। কোন এক মরমী পর্দার ফাঁক গলে তুমি দেখবে অনমনীয় প্রোথিত ভবিতব্য, উত্তরকাল। তখন ঘটনাপ্রবাহের এই মর্মবাণী শব্দের ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করতে গেলেই তুমি টের পাবে তোমায় টেনে ধরেছে অদৃশ্য লজ্জিত তন্তু। করুণাপ্রত্যাশী। তোমায় তখন বুঝতে হবে মহাকাল তোমার কাছে সমর্পিত করেছে এক আধিদৈবিক রহস্য।

সর্বজনবিদিত মূল্যহীন করতে নেই ওটা। আর তখনই তুমি চুপ হয়ে যাবে, তোমার হাত হতে খসে পড়বে গ্রাফাইট কিংবা কালির দোয়াত। শব্দগুলোকে ছুড়ে ফেলবে তুমি। হয়ে যাবে নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। বলবেনা কোন কথা, শুধু দেখে যাবে, হবে এক নির্লিপ্ত দর্শক।

বুঝে যাবে, তোমার দেহসাধনার ত্রুটি সহ্য করে না অচিনপাখী। অন্যথায় মৃদু হাওয়ায় শুধু দুলবে শূন্য খাঁচা। এখন তুমি স্থির। শান্ত। সুসমাহিত।

প্রসন্নচেতা নির্বিকার। সৌম্য তুমি শুধু অপেক্ষায়। সময়ের কলরব। বাল্যকালে কোন এক মেঠোপথ দিয়ে সন্ধ্যালগ্নের জোনাকপোকা আর পিতার সাথে হেঁটে যাওয়ার সময় তোমার শুধু মনে পড়ে ছোট্ট তুমি বারবার এসে দাঁড়াতে দীর্ঘকায় মানুষটির সামনে। বাবা...কোলে...কোলে...পা ব্যথা...আর পারি না।

মনে পড়ছে, তার মৃদু উষ্ণ হাসি। মনে পড়ছে, তিনি তোমায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন। মনে পড়ছে, তোমার সন্তান। ছোট্ট আঙুল। রাঙা ঠোঁট।

এই মুহূর্ত-অনুভূতিগুলোর অস্তিত্ব কোথায় আজ, এই ক্ষণে? তুমি তাই ভাবতে থাকো আর সময়-গুঞ্জরনের ফাঁকে শত-হাজার-কোটি সংখ্যাতীত শব্দ-দৃশ্যাবলী ছাপিয়ে শুনতে পাও এক নিঃশব্দ পদশব্দ। তোমার ঠোঁটের কোনে মৃদুহাসি, তাকিয়ে থাকো দোয়াত ছলকে পড়া কালির দিকে। তুমি অকৃতজ্ঞ নও। তুমি প্রকাশ করোনি। তুমি চেপে গেছো মায়ার খেলা।

তুমি হৈহৈরৈরৈ দেখাওনি বায়স্কোপ। ভাতের মাড় উপচে পড়ছে। উন্নয়নশীলতার বিষমবাক্যে পরিপুষ্ট জনপদের মধ্যাহ্ন বিরতি সমাপ্ত। কোন এক শালিকের চোখের ক্ষণিক বিষণ্ণতাকে মৃতের শোকাবহতা ভেবে ভুল কোরো না। বৃষ্টিকে ভেবোনা শোকের ক্রন্দন।

তুমি অকৃতজ্ঞ না হলেও এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোমার কাছে ঋণী নয়।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।