আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অস্ত বেলায়

সত্য অপ্রিয় হলেও সুন্দর

বার বার চেষ্টা করেও আগুন ধরাতে ব্যর্থ হচ্ছে তালেব আলী। আধভেজা কাগজে আগুন ধরছে না, শুধু ধোয়া হচ্ছে। ধোয়ায় বুজে আসছে তালেব আলীর ধুসর চোখ। আজ পাচঁদিন ধরে তার জ্বর সারাটা দিন ঝুপড়িতেই পরে ছিল সে। বাইরে গেলে হ্য়তো চেয়ে চিন্তে কিছু খাবার পেয়ে যেত।

কিন্তু শরীরের যে অবস্থা দাড়াতেই পারছে না। দাড়াতে গেলে মনে হচ্ছে সারা দুনিয়াটা বন বন করে ঘুরছে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। মোড়ের অসুধের দোকান থেকে বিশ টাকার অসুধও কিনেছে সে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না জ্বর যেমন ছিল তেমনই আছে। কি জানি কি অসুধ দিয়েছে দোকানদার? এত করে বললাম বাবা আমি ভিক্ষুক মানুষ টাকা পয়সা নাই কিছু অসুধ দাওনা।

দোকানদার এক কথায় বলে দিল আমি অসুধ ভিক্ষা দেই না লাগলে একটাকা দিচ্ছি নিয়া বিদায় হও। জমানো যা টাকা ছিল তা এই কয়েক দিনেই শেষ হয়ে গেল জ্বর যদি আরো কিছুদিন থাকে তাহলে কি যে করবে ভেবে পায়না তালেব আলী। মড়ার জ্বরও ছাড়ছে না, ভিক্ষায়ও বাইর হইতে পারতাছিনা। আসলে বয়স হইছেতো তাই বুড়া শরিলে অসুধও কাম করে না। তালেব আলী ভাবছিল আর তার তিন ইটের তৈরি চুলায় ফু দিচ্ছিল।

নাহ্‌! আগুন ধরেনা, কাগজ গুলান ভিজা গেছে ঝুপড়ির ফুটা দিয়া পানি পইড়া । শালা আগুন ধরে না কি যন্ত্রনা! তালেব আলী কিছুটা বিরক্ত হয়ে ওঠে আধ ভেজা কাগজ গুলোর ওপর। দুপুরেও খাওয়া হ্য়নি তালেব আলীর। মাথার যন্ত্রনায় উঠতেই পারেনি বিছানা থেকে। এখন যদি রান্নাটাও না করতে পারে তবে রাতেও উপোষ থাকতে হবে।

এত কষ্ট আর সহ্য হয় না খোদারে কত কই আমারে নিয়া নেও তাও নেয় না। তালেব আলী বিলাপ করে আইজ যদি আমার কেউ থাকতো তাইলে আমার এত কষ্ট করন লাগত না, আহারে যদি আইজ জয়নব বাইচ্যা থাকতো ! জয়নবের কথা মনে হতেই তালেব আলী কেমন উদাস হয়ে যায়। তালেব মরচে পরা স্মৃতি হাতরে ফেরে। ছায়া ছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠে অতীতের দিন গুলো। তালেব আলী আর জয়নব একই গেরস্থ বাড়িতে কাম করতো।

তালেব আলীর তিন কুলে কেউ ছিল না তা। বাপ নিরুদ্দেশ হয়েছিল ছোট বেলায় আর ফিরে আসেনাই। তালেবের যখন আট বৎসর বয়স তার মাও হঠাৎ কইরা মইরা গেল কি এক অজানা রোগে। জয়নবেরও তিন কুলে কেউছিল না। গেরস্থ আজিজ মিঞা তালেবরে তার বাড়িত নিয়া গেছিল।

তারপর থিকা ঐ বাড়িই হইল তার ঠিকানা। তালেব আজিজ মিঞারে নিজের বাপের মতন দেখ। আজিজ মিঞা ও তারে খুব আদর করত। আজিজ মিঞার সংসারকে সে নিজের সংসার মনে করত। খাটা খাটনি করত ভুতের মতন।

দুই কামলার কাম সে একাই করতে পারত। তালেব আলী তখন যুবক একদিন আজিজ মিঞা ডাইকা কইল তালেব, বাজান বিয়ার বয়সতো হইয়া গেলো বিয়া করবানা? তালেব লজ্জা পাইয়া মাথা নিচা কইরা রাখছিল। আজিজ মিঞা কইল আইচ্ছা জয়নবরে তোমার কেমুন লাগে? তোমারও তিন কুলে কেউ নাই জয়নবেরও নাই। তালেব আস্তে কইরা কইছিল আপনে হইলেন আমার বাবার লাহান আপনে যা ভালা মনে করেন। আসলে জয়নবরে তালেব আলীর ভালই লাগত।

এর কিছু দিন পরেই তালেব আলীর সাথে জয়নবের বিয়া হইয়া যায়। তার এখনও মনে আছে বাসর ঘরে জয়নব লাল শারি পইড়া বইয়া আছিল তালেবের কাছে মনে হইছিল আসমান থিকা যেন পরি নাইমা আইছে। আজিজ মিঞা একটা ঘর তাদেরকে দিয়া দিছিল। সুখেই কাটছিল তালেবের দিন। দেখতে দেখতে একদিন জয়নব পোয়াতি হইয়া গেলো বাবা হওয়ার স্বপ্নে তালেব আলীর খুশি আর ধরে না।

বাচ্চা মাইয়া হইব না পোলা হইব এইটা নিয়া প্রায়ই তাদের মধ্যে খুনসুটি হইত তালেব চাইত মাইয়্যা আর জয়নব চাইত পোলা। এই ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল তালেব জয়নবের কিন্তু তাদের সুখ বেশি দিন সইল না বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়া জয়নব মইরা গেলো। বাচ্চাটাও বাচল না। তালেবের বুকটা কেমন হু হু করিয়া উঠিল দুঃখ ভরা সেই স্মৃতি মনে করে। নিজের অজান্তেই দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তালেবের গাল বেয়ে।

জয়নব মারা যাওয়ার পর তালেব আর দ্বিতীয় বিয়া করে নাই। সারা দিন রাত কাজের মধ্যে ডুবে থাকত আর জয়নবের বিচ্ছেদের ব্যাথা ভুলতো। এর পর বছর গেল বছর এল আস্তে আস্তে সব কিছুই পরিবর্তন হইতে লাগলো আজিজ মিঞার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা আলাদা হয়ে গেল। তালেব তখন প্রায় বৃদ্ধ গায়ে আগের মত জোর নাই খাটতেও পারে না। আজিজ মিঞার ছেলেরাও তাকে বোঝা ভাবা শুরু করলো।

যাদেরকে সে কাধে পিঠে কইরা মানুষ করছে, যেই সংসারের জন্য তার জীবন যৌবনের স্বর্নালী সময় টুকু উৎসর্গ করেছে আজ তাদের কাছেই সে বোঝা সেই সংসারে সে আজ পরবাসী। আজিজ মিঞার ছেলেরা তাকে জানিয়ে দিল অনেক দিন ধরেইতো আছ এখন অন্য কোথাও দেখ। তালেবের বুকটা ভাঙ্গিয়া গেল পাহাড় সমান কষ্ট নিয়া সে তাহার এত দিনের পরিচিত আবাস ছাড়িয়া অজানার পথে পা বাড়াইল। একবারও কেউ জিগাইল না তালেব আলী তুমি এখন কই যাবা? হায়রে পৃথিবী কেউ কারো আপন নয়। এর পর একটা বাসে চড়িয়া সে এই ঢাকা শহরে আসে।

ঢাকায় আসার পর সে কাজ করার চেষ্টা করে কিন্তু বয়ষ্ক বলিয়া কেউ কাজেও নিতে চায় না। কাজ নাই তাই পয়সাও নাই কিন্তু পেট আছে তাই ক্ষিদাও আছে। না খেয়ে আর কতদিন থাকা যায় অবশেষে তালেব আলী মানুষের কাছে হাত পাতা শুরু করলো। তালেব আলীর কেউ নেই, সে আজ বড় গরীব, বড় নিঃস্ব। তালেব আলী ভাবে যদি তার বউ বেচে থাকত তার সন্তান বেচে থাকত তাহলে কি আজ সে এখানে থাকত? এইযে এই শহরে এত রং বেরঙের মানুষ কতইনা তাদের টাকা পয়সা কত জৌলুস কত সুখী মানুষ তাদের মত যদি তারও এরকম স্ত্রী সন্তান টাকা পয়সা সব থাকত তাহলে কার এমন ক্ষতি হত।

সে কি এই দুনিয়ারে কিছুই দেয় নাই? তাইলে আজ তার কিছুই নাই কেনো? আজ এই অস্ত বেলায় হিসেব মেলে না তালেব আলীর। হঠাৎ তার মনে পরে যায় অনেক দিন আগে এক ওয়াজ মাহফিলে শোনা এক মাওলানা সাহেবের কথা "যার যত ধন তার ততবেশি হিসাব দিতে হবে আল্লাহর সামনে, যে যত গরীব তার হিসাব তত কম, ভেস্ত পাওয়া তার তত সহজ হবে। এইটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের একটা বড় নিয়ামত। " তালেব আলী মনে মনে খুশি হয়। আমিতো গরীবেরও গরীব জীবনে কাউরে কোন দিন ঠকাই নাই তাইলে আমিও কি ভেস্তে যামু।

ভেস্তে নাকি খালি সুখ আর সুখ কোন কষ্ট নাই দুঃখ নাই। আইচ্ছা জয়নব ও তো খুব ভালা মাইয়্যা আছিল তাইলে তো হেও ভেস্তে গেছে। বেহেস্তে জয়নবের সাথে মিলিত হওয়ার কল্পনায় মোহিত হয় তালেব। হঠাৎ আকাশে মেঘের গর্জনে বাস্তবতায় ফিরে আসে তালেব আলী। মনে হয় কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।

রাতেও খাওয়া হবে না তার। বিদ্যুৎ চমকের আলো্য় আলোকিত হয়ে ওঠে চার পাশ। তালেব আলী ক্রুদ্ধ চোখে তাকায় আকাশের দিকে, বিড় বিড় করে কি যেন বলতে থাকে সে। সে কি অভিযোগ জানাচ্ছিল কাউকে নাকি অভিসম্পাত দিচ্ছিল ? কে জানে?.....................................................................

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।