আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষামন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

মৃত্যু বলে কিছু নেই..তুমি যাকে মরণ বল..সে শুধু মারবে তোমাকেই..

নাহিদ ভাই, আপনি আমাকে কখনো দেখেন নি। তবে আপনার সাথে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে একাধিকবার, আপনি মন্ত্রী হবার আগেই। আপনি একসময় যে ছাত্রসংগঠন করতেন, সেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলেক্ষ একটা লেখা চেয়েছিলাম। আপনার এক আত্মীয় দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় লেখাটি আপনি দিতে পারেন নি। তবু আমি কষ্ট পাই নি, কারণ আপনি নিজে থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, আপনার আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

এর পর আপনি মন্ত্রী হলেন, আপনার সাথে আর দেখা করার সুযোগ হয় নি, তবে আমার সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ গত শিক্ষা দিবসে শিক্ষানীতি সম্পর্কে আমাদের ভাবনা এবং প্রস্তাবনা আপনাকে জানিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। যথারীতি আপনি তাদের সাথেও অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন, এবং আমাদের প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছিলেন। আজ আমি আপনার উদ্দেশ্যে এই খোলা চিঠি লিখছি কোন ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে কিছু কথা তুলে ধরতে। এর অনেক কিছুই হয়তো আপনি জানেন। আপনার মার্জিত ব্যবহার, আপনার সাধারণ জীবনযাপনের ধারা আপনার প্রতি আমাদের প্রত্যাশাকে যেমন বাড়িয়ে তোলে আবার অন্যদিকে আমরা এও জানি, আপনার সরকার যে দল দ্বারা গঠিত, সেই দল কাদের শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে।

সুতরাং আকাশকুসুম প্রত্যাশা সে দিক বিবেচনায় আমাদের ছিল না। তবে একটি গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া সরকারের কাছ থেকেও ছাত্রসমাজ যতটুকু প্রত্যাশা করতে পারে, এখনও সেই প্রত্যাশা মেটেনি বলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি। সেই প্রত্যাশা মেটার কোন সুযোগ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। এ কারণেই এই খোলা চিঠি লেখা। কয়েকদিন আগে এইচ.এস.সিতে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরকে দেয়া এক সংবর্ধনায় আপনি উপস্থি'ত ছিলেন।

সেখানে একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে শিক্ষানীতির আন্দোলনে আপনার গৌরবোজ্জল অবদানের কথা স্মরণ করেছিলেন। আমরা জেনেছি, স্বাধীনতার পরেও ছাত্র ইউনিয়নের যে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি ছিল, তা রচনায় আপনার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটি গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক একই ধারার শিক্ষানীতির স্বপ্ন একসময় আপনিও দেখেছিলেন। অথচ, আপনার সময়ে যে শিক্ষানীতি আমরা পেলাম, সেই শিক্ষানীতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যে বিভিন্ন ধারা, তাকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। একই ধারার সার্বজনীন শিক্ষার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেছে।

রাষ্ট্রের দায়কে একরকম উপেক্ষা করে শিক্ষাক্ষেত্রে উৎসাহিত করা হয়েছে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপকে। এমনকী মৌলবাদীদের হুমকির কাছে মাথা নত কওে শিক্ষানীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি পর্যন্ত বাদ দেয়া হয়েছে। সে ব্যাপারে লিখতে আজ বসিনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে আপনি বলেছিলেন, আপনারা ক্ষমতায় গেলে পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করবেন। অবৈতনিক তো দুরের কথা, ইউজিসির কৌশলপত্রের কথা আমরা সবাই জানি, যেখানে ২০ বছরের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ খরচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে আদায় করার কথা বলা হয়েছে।

সেই লক্ষে বর্তমানে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যয়ভার যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে বারবার আন্দোলনে নামছেন সে বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ধিত ফি’র প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ন্যাক্কারজনকভাবে ঘটেছে পুলিশী হামলা, একদিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬০ জন ছাত্রকে। ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি তসলিম উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মাঠে নেমেছে, পুলিশের মার খেয়েছে, তারপর তাদের দাবি আপনারা মেনে নিয়েছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নাইটকোর্স চালুর প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে, আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছে প্রশাসন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ফুঁসছে এবং আন্দোলনের প্রস'তি নিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে ২২টি বিভাগে পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যিক সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা এবং প্রগতিশীল ছাত্রজোট মানববন্ধন করেছে, মিছিল সমাবেশ করেছে, রাস্তা অবরোধ করেছে, এমনকী তাদের ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে। অবশ্য ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত করার দরকার হয় নি, তার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সব বিভাগ তাদের সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত স্থ'গিত করলেও এখনো সিন্ডিকেটের সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয় নি।

এবছরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটে গবেষণাখাতে বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে কমানো হয়েছে, এবং বাজেটের ৮০% বরাদ্দই শিক্ষাক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ। এই বাজেটের জন্য বাড়ানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়, যা কিনা নানা প্রকারে ছাত্রদের কাছ থেকেই নেয়া হবে। তার অংশ হিসেবে পরিবহন ফি এর নামে ৮৩০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বছর বছর বাড়ানো হচ্ছে কোর্স ফি।

বিভাগ উন্নয়ন ফির নামে ছাত্রদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে, হল এবং বিভাগের উন্নয়ন ফি সহ যে পরিমান টাকা লাগে তা কোন গার্মেন্টস কর্মীর প্রায় ৩-৪ মাসের বেতনের সমান। সেই অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি আর পাবলিকের জন্য থাকছে? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে. নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যে পরিমান টাকা লাগে তার পরিমান কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই তুলনীয়। উচ্চশিক্ষার এই ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ, গোটা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসির নীলনকশা বাস্তবায়নেরই অংশ, এটি ছাত্ররা বুঝতে শুরু করছে এবং এর প্রতিবাদে লড়াই করছে। আপনি ভালো করেই জানেন- দেশের স্বার্থে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে, উচ্চশিক্ষার যে প্রকৃত দর্শন-তার স্বার্থে শিক্ষার সুযোগ সকলের জন্য উন্মুক্ত করা কতটা প্রয়োজন।

আমাদের ছাত্ররা সামান্য উৎসাহ পেলেই কী করতে পারে তা আপনারা দেখেছেন, তরুণ বিজ্ঞানীদের পরিশ্রমে উন্মোচিত হয়েছে পাটের জিনোম রহস্য। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের শতকরা ৮ ভাগ এবং মোট বাজেটের ২৫ ভাগ বরাদ্দ যদি নিশ্চিত না হয়, তা হলে শিক্ষাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা অসম্ভব। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতেই হবে, সেটা কীভাবে বাড়ানো সম্ভব-সেটা সরকারের বিষয়। প্রয়োজন হলে উচ্চ আয়ের মানুষদের জন্য ‘শিক্ষা কর’ ধার্য করা যেতে পারে, সেটা আপনারা বিবেচনা করবেন। শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন, গবেষণাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন।

কিন্তু' তা করতে গিয়ে শিক্ষার ব্যয়ভার বৃদ্ধি করা সঠিক পথ নয়। শিক্ষাকে পণ্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষা সংকোচনের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অংশ না হয়ে সরকারের উচিত শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। আপনাদের প্রতিশ্রুত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়তে হলে তো বটেই, দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। আপনাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনারা কোন পথে হাঁটবেন। মনে রাখবেন, আপনারা গত নির্বাচনে তরুণদের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন।

কিন্তু' সেই ছাত্র-যুব সমাজ যদি শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়, তবে পরবর্তী নির্বাচনে আপনাদের প্রতি তারা আস্থা রাখবে না। এই সুযোগে যুদ্ধাপরাধী এবং ধর্মীয় মৌলবাদীরা জল ঘোলা করার চেষ্টা করবে, যেমনটি আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষাভের সুযোগ নিয়ে শিবির চক্র ভাঙচুর করেছে, আন্দোলনকে নস্যাৎ করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা করছে। কিন' সেই বিষয়টিকে মুখ্য করে তুলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করলে তার সুযোগ প্রতিক্রিয়াশীলরাই নেবে। আর বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের ইস্যুকে এক করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।

কিন্তু এভাবে আন্দোলন দমানো যাবে না। এদেশের ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণা করে। তারাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নানা সময়ে আন্দোলনে শরীক হয়েছে। তবে তার পাশাপাশি তারা তাদের ন্যায্য অধিকারও বুঝে নিতে চায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই করতে হবে, কিন' তার অজুহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দমন করা হলে ছাত্রসমাজ তা মানবে না।

একজন ছাত্র হিসেবে, ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে ছাত্রদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ আমি পেয়েছি। ছাত্রদের দাবি, ছাত্রদের আবেগ, ছাত্রদের ‘কমন পাল্‌স’-কে তাই খুব কাছে থেকে বিশেস্নষণ করার সুযোগ আমার হয়। আর আপনিও ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন, ছাত্র আন্দোলন করে উঠে আসা যে গুটিকতক রাজনীতিবিদ এখনো আছেন, তাদের মধ্যে আপনি অন্যতম। সেই জায়গা থেকে এই খোলা চিঠির মাধ্যমে আপনাকে শিক্ষার ব্যয়ভার বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্রদের অবস্থানের কথা আপনাকে জানালাম। আমরা আশা করব, আপনারা আমাদের যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলোকে উপলব্ধি করবেন- শিক্ষাকে পন্যায়নের ইউজিসির কৌশলপত্র বাতিল করবেন, শিক্ষাখাতে আরো বেশি সরকারী বিনিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যয়ভার কমিয়ে শিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করবেন।

অভিনু কিবরিয়া ইসলাম শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.