আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মার বন্ধন



অনেকদিন ধরেই কিছু লিখতে পারছিল না নীল। কাগজ কলম হাতে নিয়ে বসে থাকে... মনের মধ্যে হয়ত কবিতার দু'এক লাইন গুন গুন করে ওঠে... তারপর নিজেই বিরক্ত হয়ে যায়। নিজের ভিতরে জমে থাকা কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই বুঝি কাগজটাকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে নীল। এই ঘটনা আজকাল প্রায় ঘটায় সে। কখনও কাগজ ছেড়ে, কখনও কলমটাকে ভেঙ্গে ফেলার বৃথা চেষ্টা করে... এখন আর নীলের কীবোর্ড থেকে খটখট শব্দের ঝড় ওঠে না...লিখতে ইচ্ছা করে না নীলের।

মনে হয়, গল্প, কবিতা লেখার মত হাস্যকর প্রহসন আর কিছু হতে পারে না... বাস্তবের সাথে প্রহসন! অর্ণব বেশ কিছু দিন ধরেই বলছে... এবার তোকে কিছু লিখতেই হবে। এই ছেলেটার কথা ভাবলেও নীলের অবাক লাগে। নীল বুঝতে পারেনা... আসলে অর্ণব কি চায়! কেন সবসময় ছায়ার মত ওর পাশে থাকে! নীলের মধ্যে যে ক্ষ্যাপাটে মানুষটা বাস করে... সেই মানুষটার কোন ঠিক ঠিকানা নেই... ইচ্ছা হলে খাবে, না ইচ্ছা হলে খাবে না। হয়ত কাল পরীক্ষা, কিচ্ছু পড়বে না, পায়ে একজোড়া চটি জুতো গলিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পরবে। মাথাটা নীচু করে একা একা হাঁটতে থাকবে... কাল কি হবে, সেই ভাবনা আজ সে ভাবে না... অন্যের কথা ভাবলেও ভাবতে পারে... কিন্তু নিজের ব্যাপারে পুরো উদাসীন সে।

সেই নীলকে কিনা ইদানীং অর্ণবের কথা ভাবতে হচ্ছে। ছেলেটা তাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলছে। নীলের সবকিছুতে তার এতো খেয়াল, মনে হচ্ছে অর্ণবের আন্তরিকতার কাছে সে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারে না নীল। যে ছেলে নীলের চোখের বিষন্নতা কেড়ে নিতে চায়, তাকে কি করে সে বলবে, "আমার কথা তোর ভাবতে হবে না"।

নীল তো চায় না পৃথিবীর একজন মানুষকেও কষ্ট দিতে। অর্ণব একটু স্বার্থপর টাইপের ছেলে হলে নীল খুশি হত। তাহলে অন্তত সে নীলের মত ছন্নছাড়ার বন্ধু হত না সে। অর্ণব এখন নীলের কাছে রীতিমত এক বিস্ময়। একবার সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে প্রায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল অর্ণব, চট করে হাত ধরে ফেলেছিল অচেনা নীল।

পা মচকে সিড়িতেই বসে পড়েছিল অর্ণব। ওর আবার একটা অদ্ভুত সংস্কার আছে, কখনও কাউকে পা ছুঁতে দেয় না, নিজেও কারোর পা ছোঁবে না। নীলকেও নিষেধ করেছিল। নীল একটা ঝাড়ি দিয়ে বলেছিল, পায়ে মনে হয় বেশ ভালই ব্যাথা পাইছো, বেশী বকবক করো না। তোমার পা ছুঁলে কি আমার জাত যাবে নাকি? ওই ঝাড়ি খেয়ে আর কিছু বলার সাহস হয়নি অর্ণবের।

বিপদ হয়েছে নীলের, একটা ছায়াসংগী জুটেছে! অর্ণব মাঝে মাঝেই রক্তের খোঁজে এ রুম ও রুমে ছোটে। নীল বুঝে না... এই কাজে ও এতো কি আনন্দ পায়! এটা মনে হয়, কাজটা ভাল... কিন্তু অর্ণব মনে হয় কাজটাকে ভালোবাসে! এটা কি আসলেই ভালোবাসার মত কোন কাজ? ও যেভাবে এক হলে রক্তের খোঁজ না পেলে অন্য হলে খোঁজ নেয়, সেখানে না পেলে আরেক হলে... ওহ, এতোটা করার কথা ভাবে না নীল। কাউকে রক্তের খোঁজ দিতে না পারলে অর্ণব যেন রোগীর আত্মীয় স্বজনের চেয়ে বেশী নিরাশ হয়ে পড়ে! অর্ণব বলে, যারা একসাথে বাঁধন এ কাজ করে, তারা সবাই নাকি এইরকম। এভাবেই বাঁধন এর কাজের সাথে ওদের আবেগ জড়িয়ে গেছে! সেইবার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার জন্য জোর করে ধরে নিয়ে গেল অর্ণব! মহা বিরক্ত হয়েছিল সেদিন নীল । এমনিতেই রক্ত দেখলে ওর ভেতরটা কেমন গুলিয়ে ওঠে।

লাভের ব্যাপার এই... রক্তের গ্রুপটা জানা গেল, AB+. অবশ্য না জানলেও তার কোন সমস্যা হচ্ছিল না। অর্ণবদের মনে হয় সমস্যা হচ্ছিল... লিস্টিং করতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে গেছে। এইতো সেদিন নীল হলে ফিরে দেখে টেবিলের উপর এক গুচ্ছ সাদা রঙের ফুল... সাথে ছোট্ট একটা রাইটিং প্যাড, একটা চিরকুট... তোর জন্য। কয়েকদিন দেখা হবে না... বাড়িতে যাচ্ছি। মা অসুস্থ।

নিজের খেয়াল রাখিস। --অর্ণব কি বলার আছে... অর্ণব মেয়ে হলেও না হয় বোঝা যেত... ব্যাপারটাকে প্রেম ট্রেম কিছু বলা যেত। তাও তো বলা যাচ্ছে না... সবকিছুই ঠিক ছিল... কিন্তু ওই ফুল দিয়ে যাওয়া কি মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি না! আচ্ছা এটা কি? এইসব শব্দতো ইদানীং মাথায় ও আসতে চায় না। শব্দগুলো কি হতে পারে? মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা... আচ্ছা বন্ধুত্ব ব্যাপারটাও কি এক রকমের ভালবাসা? নীল একমাত্র মা ছাড়া আর কারোর ভালোবাসাটা বুঝতে পারে না। ভাই, বোন, বাবাও ঠিক কতটা ভালোবাসে সে জানেনা।

আসলেই কি বাসে নাকি সংসারে একসাথে থাকলে এমনিতেই একটা অনুভূতি তৈরী হয়? কিন্তু মায়ের অনুভুতিটা যদি ভালোবাসা হয় তাহলে অন্যগুলো কি? নাহ মেলে না... ওগুলো হয়ত বন্ধন, কিন্তু সবগুলোই কি ভালোবাসা?... তা কি করে হয়... আজকাল মাথায় আর এসব জটিল জিনিস ঢুকে না। কেবল এখনও মায়ের ভালোবাসাটা বুঝে... মা এখনও ঘুমের মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়, খেতে গেলে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, কপালে চুমু দিয়ে যায়... কোনকিছু যখন খুঁজে না পায়... তখন পাশে এসে আস্তে করে বলে যায়, ওই যে, ওইখানে রেখেছিস, ভুলে গেছিস? আজ মা নেই বলেই হয়ত মায়ের অস্তিত্ব আরো বেশী করে টের পায় নীল। মাস চারেক আগে, এক সড়ক দূর্ঘটনা নীলের কাছ থেকে ওর মাকে কেড়ে নেয়। ওর মায়ের মুখের শেষ শব্দটা ছিল, নীল......! মা যদি আর একবার এসে ওকে বলত... নীল, তোর নতুন কবিতাটা আমাকে শোনাবি না? তাহলে কি নীল না লিখে পারতো!? অর্ণবের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলের। এই ভোর বেলায় অর্ণব! --আরে, তুই না বাড়িতে ছিলি, আসলি কখন? --ওসব কথা পরে হবে, তুই এখন রক্ত দিতে পারবি? মা অপারেশন থিয়েটারে... AB+ রক্ত লাগবে, কাউকে পাচ্ছি না! আমার মা মনে হয় বাঁচবে নারে নীল! বলেই অঝরে কাঁদতে শুরু করে দিল অর্ণব... যেন অনেক জল ওর চোখে জমা হয়ে ছিল... কিন্তু এসব দেখার সময় নেই নীলের।

ওর মাথায় ঘুরছে কেবল একটা কথা, "মা মনে হয় বাঁচবে নারে নীল!!" অর্ণবের কাঁধে হাত রাখে নীল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে অর্ণবের মা, মাথার কাছে বসে আছে নীল, পাশে অর্ণব। অপারেশনের পর ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। এ যাত্রা বেঁচে গেছেন তিনি... কিন্তু আরেকটু দেরী হলে কি হত বলা মুশকিল! কি মায়াবী, প্রশান্ত চেহারা অর্ণবের মায়ের! একি শুধু অর্ণবের মায়ের মুখ! নীলের মায়ের মুখও তো একই রকম ছিল!... নীলের মনে হচ্ছে, এক্ষনি মা ঘুম থেকে উঠে বলবে, নীল, তোর নতুন কবিতাটা আমাকে শোনাবি না? নীল কি না শুনিয়ে পারবে? তার রক্ত যে আজ নতুন কবিতা লিখেছে... কবিতার নাম "আত্মার বন্ধন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।