আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পৃথিবীতে যে লোকগুলি নিজে দেখতেছে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করবে তারপরও অপরের জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টারত থাকে তাদের মত বড় মনের আর কেউ হতে পারে না

ভুল করেছি,প্রায়শ্চিত্য করবো না, তা তো হয় না 1. রানা প্লাজার ভিতরে ভয়াল অভিজ্ঞতায় আমার বিশ মিনিট!!! [এমদাদুল হক তুহিন ভাই] এর ব্লগ থেকে হাতে লাইট, মাথায় সাদা কাপড় ও মুখে মাস্ক লাগিয়ে একদম ধ্বংসস্তূপের এক হাত দূরে যেয়েই জানতে পারলাম ভিতরে একজন মহিলা আছেন। বের করার শত চেষ্টাতেও বের করা সম্ভব হচ্ছে না, যারা এতক্ষণ ভিতরের গিয়েছেন তারা সবাই ক্লান্ত। ভিতরে প্রবেশ করার মত বিন্দুমাত্র শক্তি বা সাহস তাঁদের আর অবশিষ্ট নেই। ও দিকে ভিতরে মহিলাকে উদ্ধারের জন্য একজন প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুজনের জন্য খাবার পানি, স্যালাইন পানি, ও জুস নিয়ে যেতে হবে।

কেউ সাহস করে এগিয়ে ভিতরে যেতে চাচ্ছেন না। না সেনাবাহিনী, না রেডক্রস! তারা অন্যদিকে ব্যস্ত( ভবনের বাহিরে)। সাহস করে আমি বললাম- আমি ভিতরে যেতে চাই। সেনাবাহিনীর এক ভাই আবাস দিলেন যেতে পারবেন তবে প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে জীবন বাজি রেখেই ভিতরে যেতে হবে। আবেগের কাছে সাহস আবার কি! আমি সাধারণ মানুষ, অভিজ্ঞতা শুন্য।

অক্সিজেন মাস্ক বা মাথায় হেলমেট লাগিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে তা জানা স্বত্বেও মুখে সাধারণ মাস্ক, হাতে লাইট, প্যান্টের পকেটে মোবাইল, ও বা হাতে দুই তিনটি বোতল নিয়ে ঢুকতে শুরু করলাম। শরীরের দিক দিয়ে মোটাসোটা না হওয়ায় অতি সহজেই প্রথম শরীরে প্রথম অংশের সহিত অন্য অংশও ঢুকে গেল। মাথা ভিতরে ঢুকানোর পরই দেখি শুধু অন্ধকার , নাকে আসতে শুরু করে অপরিচিত এক গন্ধ। প্রথমে বিম থেকে সোজা এক হাত ঢুকার পর বা দিকে যেতে হয়, কিন্তু বা দিকে কোন ভাবেই যেতে পারছি না। আমার লক্ষ্য বাঁচার অপেক্ষায় মানুষটি ১০ থেকে ১৫ হাত ভিতরে মানে দেড় বিম পরিমাণ স্থান।

শরীর কোন ভাবেই না ঢোকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধার যেমন মাটিতে বুক বর করে এগিয়ে গিয়েছিল ঠিক একই রকমে আমিও এগিয়ে যেতে লাগলাম। ভিতরের জনকে লাইট দিয়ে ঈশারা করায় উনিও প্রত্যুতর দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম কোন দিকে আসতে হবে, উনি বললেন সোজা আসেন; কিন্তু খুব সাবধানে। মাথা উপরের দিকে উঠাইয়েন না। আমি বা হাতের পানির বোতল উনাকে নিক্ষেপ করলাম ঠিক উনার হাতে, স্যালাইনের বোতলও উনার হাতে পৌঁছাতে পারলাম কিন্তু জুসের প্যাকেট মিলে দেওয়ার পর দেখি ঠিক স্থানে যায় নি।

আমাকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই শরীর একদম ছাদের সাথে লেগে গেল। পাশে একটা সেলাই মেশিন, ওটাকে ধরে নিঃশ্বাস-হীন চুপ মেরে থাকলাম দু তিন মিনিট। আরেকটু এগিয়ে নিচের ফ্লোরের টাইলস ভেঙ্গে রাস্তা করা হয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। ছাদে মাথা ছুঁইছুঁই, শরীর লেগে আছে, চারদিকে উৎকট গন্ধ, সম্বল শুধু হাতে থাকা টর্জ লাইটের আলো।

এগিয়ে যেতে লাগলাম, শরীররে বুক দিকের অংশ পেট থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত বালুর ঘর্ষণে মনে হচ্ছিল ছিলে যাচ্ছে। কিন্তু মনে প্রচণ্ড বেগ, আমাকে সামনে যেতেই হবে। অন্ধকারে চশমা চোখেও আবছা দেখছি সব। ভিতরের ভাইকে বললাম, খালা কোন দিকে, উনি বললেন এদিকে। পিলার কাটতে হবে, কাটা যাচ্ছে না, আমিও কথা বলার সাথে সাথে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

বললাম পিলার কাটেন যেভাবেই হোক। এবার আমি একদম খালার কাছে, খালাকে বললাম খালা শুনতে পাচ্ছেন? উনি বললেন- “বাবা, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। ” আর কিছু বললেন না দু তিন মিনিট, ইতোমধ্যে মনে হচ্ছিল কথা আমার কথা বলার শক্তিও যেন কে কেড়ে নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করি, আপনার নাম? তিনি বলেন- মমতাজ, আমাকে বাচাও। আমি চেষ্টা করি, টানাহেঁচড়া করি।

কোন কিছুতেই কিছু করতে পারছি না। শরীরের জোরে টান দেওয়ার বিফল চেষ্টা, কিন্তু উনার হাত ও কব্জার এক সাইট বিমের নিচে। আলোক স্বল্পতায় ঠিক মত বোঝাও যাচ্ছিল না কোথায় ধরে কিভাবে টান দিব। অন্যদিকে পাশের ভাইটি পুরো তালে চেষ্টা করছেন, কাজ হচ্ছে না। টপটপ করে আমার শরীর থেকে ঘাম ঝরছে, মাথা থেকে চুল থেকে পানি পড়তে পড়তে চশমা ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে এই যেন আমার উপরও ছাদের বিম স্পর্শ করছে প্রায়।

যেন প্রতি সেকেন্ড কয়েকশ বছর, প্রতিটি মিনিট কয়েক লক্ষ বছর! প্রচণ্ড রকম ভয় পেয়ে গেলাম, অন্য দিকে খালার জীবন। জীবিত মানুষের আকুতি! বাঁচার তীব্র আর্তনাদ! ড্রিল কার্টার দিয়ে বিম কাটার বিফল চেষ্টা করতে লাগলেন পাশের ভাই। (অবশ্য পাশের ভাইয়ের নাম ভুলে গেছি, মনে থাকাটা খুব দরকার ছিল!) হাতুড়ি দিয়ে উনি বিমকে আঘাত করছে কিন্তু যত বেগে হাতুড়ি চালাচ্ছেন, তার অর্ধেক বেগও প্রয়োগ হচ্ছে না দেওয়ালে। আমি খালার দিকে তাকিয়ে রইলাম, কান্না চলে আসছে, কিছুই করতে পারছি আবার নিজের জীবন। উৎকট গন্ধে এমন সময় আমি বমি করে দিলাম, আমার অবস্থা দেখে যে ভাইটি ভিতরে ছিলেন তিনি বললেন আপনি বের হয়ে যান।

কিন্তু আমি আসতে রাজি হচ্ছিলাম না আরও পাঁচ মিনিট থাকার পর আবার খেঁক করে উঠতেই তিনি এমন ধমক দিলেন যেন আমার জীবনে এমন ধমক আর কখনও খায় নি। উনি বললেন আপনি বাইর হন , বাইরে যান। কইতাছি বাইরে যান। জীবনের মায়া কার না থাকে, সহ্য করতে না পেরে আমি পিছু হটতেই বাধ্য হলাম। অক্সিজেন শুন্যতায় না নিতে পারছি দম, না পিছু হয়ে বের হতে পারছি।

ঠিক একই কায়দায় মাথা সামনের দিকে( ঢুকার সময় যে দিকে ছিল) মানে বুকে ভর করে পিছিয়ে আসতে লাগলাম, কিন্তু আবার শরীর আটকে গেল ফ্লোরের টাইলস ভাঙ্গার স্থানে। অনেক কষ্টে সেখান থেকে ছুটে আবারও একদম বাইরের দিকেও পা আটকে গেল মানে বাঁকা পথে বের করতে হবে। তখন বাইরে যারা ছিলেন তারা পায়ে ধরে টান দিলেন। বের হয়ে আসতে সম্ভব হলাম বাইরের জগতে, ভিতরে থাকা ২০- ২৫ মিনিট যেন ২০ থেকে ২৫ লক্ষ বছর, প্রতিটি মুহূর্তই মৃত্যুর ভয়াল অশনিসংকেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য একটাই জীবিত মানুষটাকে কোন ভাবেই বের করে আনতে পারলাম না, প্রচণ্ড রকম হতাশাগ্রস্ত আক্ষেপ, অনুভূতি আর কান্না।

সারা জীবন হয়ত, এই একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরতে হবে আমাকে! কেন বাস্তবতা এমন নির্মম! বের হয়ে আসার পরও অনেকক্ষণ ছিলাম মানে রাত চারটা পর্যন্ত, আগুনের সূত্রপাতের সময় ফায়ার সার্ভিসের পানির জন্য চিৎকার করতে করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আসে আধা ঘণ্টা পর!!! 2. লড়াই করে বেঁচে যাওয়া এক মেয়ের কথা: প্রচন্ড তেষ্টা পাওয়ায় হাতের কাছে থাকা ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করেছি, তাতে আধেক পরিমাণ পানি আছে. পানি খেতে যাব এমন সময় পাশ থেকে এক ছেলে হাত বাড়িয়ে কেড়ে নিতে চাইলো কিন্তু না পেরে নখের আচর দিয়ে সে আমার হাতের চামড়া তুলে ফেলল এমনকি আমার জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলল. দুজনেই চাপা পড়া অবস্হায় ছিলাম বিধায় কেউ নড়তে পারছিলাম না. শেষ অবধি আমি যখন বের হয়ে আসি তখন সে চাপা পড়া অবস্হায়ই ছিল. এই দুটি ঘটনা পড়ে আমার নিজের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল, ২০০৮ সালে শিক্ষা সফরে জাফলংয়ে গিয়ে দেখি নদীটাতে কোমড় পানি, ৮ বন্ধু চিন্তা করলাম ওখানকার স্বচ্ছ টলমল পানিতে গোসল করতে করতে হেঁটে পার হব. হঠাৎ একজন ভাসা শুরু করল কারন বড় বড় পাথরগুলো তোলার পর নদীর ঐঅংশের গভীরতা বেড়ে যায়. ও যে সাঁতার জানে না, এটা আমরা জানতাম না; আর নদীটা এত খরস্রোতা যে ও স্রোতের সাথে চলে যাচ্ছিল, এমন সময় ওর পাশে থাকা দুজন সাতার দেওয়া অবস্হায়ই পা দিয়ে ঠেলে ওকে জাগিয়ে রাখছিল. আমি সাঁতরিয়ে ওর কাছে গেলাম, ও এতটাই ভয় পেয়েছে যে আমার কোমড় না ধরে বরং গলা জাপটে ধরল. আমার শাষনালী বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সাঁতরাতে পারছিলাম না বিধায় দুজনেই ডুবে যাচ্ছিলাম তখন নিষ্ঠুরের মত এক লাথ্থি মেরে ওর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাই, আসলে ঐ সময় আমার মধ্যে ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী কাজ করা শুরু করছিল, আগে তো নিজে বাঁচি বাকি সব গোল্লায় যাক. এসময় অন্য একজনের ডাকাডাকিতে একটা পাথর বহনের নৌকা এগিয়ে এসে প্রথমে ওকে তোলে এরপর আমিও ওটার উপর উঠে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি. এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ বন্ধুটি যদি সেদিন মারা যেত তাহলে বোধ হয় কোনদিনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না. পৃথিবীতে যে লোকগুলি নিজে দেখতেছে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করবে তারপরও অপরের জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টারত থাকে তাদের মত বড় মনের আর কেউ হতে পারে না. ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।