অজানাকে ভালোবাসী
'৭২ সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সরকারি উদ্যোগ
সংবিধান শাসনব্যবস্থা ও জাতিকে শেষহীন বিতর্ক ও বিভক্তির মধ্যে ঠেলে দেয়া হচ্ছে
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিলুপ্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্রের বুনিয়াদকে ধ্বংস করতে পারে
এ. বি. সিদ্দিক : বর্তমান সরকারের ৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবার বিষয়টি রাজনৈতিক হিংসা, অযৌক্তিক জেদ এবং চরম অগণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ শুধু নয়, প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশকে ৩৮ বছর পিছিয়ে দেয়াসহ বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে শেষহীন এক বিতর্ক ও বিভক্তির মধ্যে ঠেলে দিতে চায়। ৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থ শেখ মুজিব আমলের তিনটি সংশোধনীসহ চৌদ্দটি সংশোধনী বাতিল হয়ে যাওয়া, যার সাথে হাজারো আইন, সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন জড়িত। সংবিধান প্রশ্নে এমন পেছনে সরে যাওয়ার নজীর পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নেই। মূলত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাতিল করা এবং সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার জন্যেই সংবিধান নিয়ে এত বড় অনাচার করা হচ্ছে। আর এটা ভারতেরই এজেন্ডা।
ভারত বাংলাদেশে ইসলামী চেতনা ও মুসলিম স্বাতন্ত্র চিন্তার অস্তিত্বকে সহ্য করতে পারে না। ইসলামী চেতনা ও মুসলিম স্বাতন্ত্র চিন্তার কারণেই মুসলমানদের হজম করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে ৪৭-এ ভারত বিভাগ হয়েছে, যার ফলে আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদ উপড়ে ফেলতে হলে ইসলামী চেতনা ও মুসলিম স্বাতন্ত্রবোধের ধ্বংস প্রয়োজন। এই লক্ষ্য অর্জনের একটা পথ হিসেবেই '৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে এই ক্ষতিকর ও অযৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য হবে না।
কারণ সংবিধানের '৭৫-উত্তর মৌলিক সংশোধনীগুলো রেফারেন্ডের মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে। এই বাস্তবতা সামনে থাকা সত্ত্বেও সরকার ৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার।
৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা হচ্ছে। কমিশনে কারা থাকছেন, এ বিষয়টি নিয়ে আজ-কালের মধ্যেই আইন মন্ত্রণালয় ঠিক করার উদ্যোগ নেবেন। আবার সরকার সর্বদলীয় একটি কমিটিও গঠন করতে যাচ্ছে।
এই কমিটিতে বিএনপিকে ডাকা হলেও তারা এতে যাবে কিনা এটা নিশ্চিত করে কেউ বলেননি। বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, ‘সময় আসুক দেখা যাক'। অপরদিকে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন যে, এ ধরনের কমিটি হলে বিএনপি-জামায়াত না যাওয়ারই কথা। আর না যাওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এছাড়া জামায়াতকে তো সরকার ডাকবেই না।
অথচ এই সংসদে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। অপরদিকে আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম গতকাল পরিষ্কার করেই বলেছেন, জামায়াতের রাজনীতি বন্ধ করতেই তারা ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাচ্ছেন। এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকবে না।
দীর্ঘ প্রায় ৩৮ বছর পর কেন ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন এই সরকার? এই প্রশ্ন সচেতন নাগরিক সমাজের। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সম্পর্কে এর মধ্যে অভিজ্ঞ মহল থেকে যেসব কথা উঠে আসছে তা হলো- সরকার কি আবার একদলীয় শাসন কায়েম করতে চায়? সরকার বৃহৎ মুসলিম এই দেশ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করে দেবে? সংবিধানে ইসলামী মূল্যবোধ, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এসব কিছুই থাকবে না।
এসব প্রশ্ন আজ সামনে উঠে এসেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সরকার কেন বন্ধ করতে চায়? পৃথিবীর বহু দেশে রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। প্রতিবেশী ভারতে যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন তারা কি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নয়? বিজেপি, শিবসেনাসহ আরও কট্টর কথিত মৌলবাদী বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে ভারতে।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন (৪.৫.০৯ মানব জমিন পত্রিকায় প্রকাশিত) হাইকোর্ট এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাব থেকে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' (আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস) রয়েছে।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সংবিধানের ৬, ৮, ১০, ১২, ২৫, ৩৮ ও ১৪৫ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। আর সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রণীত সংবিধানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে সে সময় পর্যন্ত সে সময় সরকারের প্রতিটি কাজের বৈধতা রয়েছে। এর মাধ্যমে শূন্যতা পূরণ করা হয়েছে। আমরা পছন্দ করি বা না করি সামরিক শাসন এসেছে।
সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সংবিধানে সামরিক আইনের অধীনে সংঘটিত কর্মকান্ডের বৈধতা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধান, রাষ্ট্র ও সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পঞ্চম সংশোধনীর বৈধতা দিতে হবে। সংবিধানের শূন্যতা কোনো রাষ্ট্রেই রাখা হয়নি। তিনি বলেন, ৪র্থ সংশোধনীতে ফিরে যাওয়া মানেই বাকশাল বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম হবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে না, থাকবে না বহুদলীয় গণতন্ত্র যা আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা হবে। দ্রুতই কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এর আগে যা বলেছিলেন তা হলো- সংবিধানকে যুগোপযোগী করতে কমিশনের পরামর্শ পাওয়ার পরই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনমন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে দেশে আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকবে না। তিনি বলেছেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের ৭২-এর সংবিধানে ফিরে গিয়ে চার মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
এর কোনো বিকল্প পথ আমাদের সামনে নেই। মন্ত্রী আরও বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত হলে ৮(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখিত রাষ্ট্রের চারনীতি (গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র) পুনর্বহাল হবে।
গোটা বিশ্ব যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বর্তমান সরকার এখন থেকে ৩৮ বছর আগে ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাইছে। আধুনিক বিশ্বে যখন গণতন্ত্র, বিশেষ করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিযোগিতামূলক তখন সরকার আবরও একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। দেশ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মুছে ফেলে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম কার স্বার্থে করতে চায়, এটাই দেশবাসীর প্রশ্ন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।