আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংবিধান তুমি কার???

লেখিতে এবং পড়িতে ভালবাসি। ইদানিং ছোট বেলার একটা মজার কথা বেশ মনে পড়ে। এই মনে পড়ার ব্যপারটি ঘটছে রাজনৈতিক নেতাদের সংবিধান মেনে চলা আর না চলার কথপোকথনের প্রভাবে। ঘটনা শেয়ার না করে লেখাটাতে মনোসংযোগ দিতে পারছি না। তখন আমরা খুবই ছোট।

গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। আশির দশকের কথা। তখন আমার গ্রামের বাড়ীতে বিদ্যুৎ নামক সোনার হরিণের পা পরেনি। টিভি দেখার জন্য ব্যাটারী ছিল একমাত্র সম্বল। সারা গ্রামে ২/৩টা টিভি ছিলো, তাও আবার সাদাকালো।

টিভি মালিক তার উঠানে টিভি ছেড়ে দিতেন গ্রামের সব শ্রেনীর মানুষ একসাথে বসে সাপ্তাহিক নাটক, ছায়াছন্দ এবং বাংলা সিনেমা দেখতো। সেটাই ছিলো গ্রামের মানুষের কাছে অমূল্য পাওয়া। টিভির মালিকদের আলাদা একটা ভাব ছিল। টিভি দেখতে দিবে বলে কৌশলে পোলাপানদের দিয়ে অনেক কঠিন কাজ সহজেই করিয়ে নিতো। আমিনিজেও অনেক কাজ করে দিয়েছি শুধু টিভি দেখার লোভে।

গ্রামের কিছু বড় ভাইয়েরা ভিসিপি/ভিসিআর প্লেয়ার নামক একটি জিনিস আবিষ্কার করলেন, যার মাধ্যমে হিন্দি ও ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখা যেত। একদিন গ্রামের সব বড় ভাইয়েরা মিলে সারা রাত হিন্দি ও ভারতীয় বাংলা ছহি দেখবে বলে চাঁদা তুলে ভিসিপি/ভিসিআর প্লেয়ার এবং জেনারেটর ভাড়া করে নিয়ে এলো। গ্রামের সব চেয়ে বড় উঠানে রঙ্গিন টিভিতে সেই প্রথম সারা রাত চললো অমিতাভ আর মিঠুনের হিট ছবি থেকে শুরু করে উত্তম-সুচিত্রার বিখ্যাত বিখ্যাত ছবি। গ্রামের মাতাব্বর শ্রেনীর মুরুব্বীরা বিষয়টি ভাল ভাবে নিল না। সভা ডাকলো, গ্রামের মসজিদের হুজুর আসলো, সিদ্ধান্ত হলো গ্রামে টিভ-ভিসিপি ভাড়া করে সিনেমা দেখা যাবে না, যে দেখবে তাকে সমাজচ্যূত করা হবে এবং জরিমানা করা হবে।

যে সিদ্ধান্ত সেই কাজ, সিনেমা দেখা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা যারা উঠতি তরুন ছিলাম আশাহত হলাম, বড় বড় ভাইয়েরা ব্যপক ক্ষেপে গেলেন। কিন্তু কিছু করার কারো সাহস ছিল না। কারণ আমাদের গ্রামে তখন গ্রাম্য সালিশী ব্যবস্থা ব্যপক জনপ্রিয় ছিল এবং মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য ছিল। মানুষ আদালতের রায়ের চেয়ে গ্রাম্য মুরুব্বীদের রায় বেশী মানত বলেই এখন মনে হচ্ছে।

(ফুটপাত দিয়ে মটরযান চালানোর বিরুদ্ধে আদালত নিষেধ করলেও কেউ মানে না, প্রকাশ্যে জনসম্মুখে ধুমপান করা বেআইনি হলেও কোন এ্যাকশন হয় না। ) ঠিক সেই সময়ে আরো একটি ঘটনা গ্রামে প্রবল ভাবে ঘটতে লাগল। সেটা হলো ছেলে-মেয়ে প্রেম করে বাড়ী ছেড়ে বিয়ে করে ফেলা। মুরুব্বীরা ভীষন চিন্তায় পড়ে গেলেন। সভা ডাকলেন।

সিদ্ধান্ত হলো কেউ যদি এই হীন কাজটি আবার করে তাহলে কঠিন সাজা দেয়া হবে, যে ছেলে এই কাজটি করবে তাকে ১০০ জুতার আঘাত করা হবে এবং ছেলের বাবাকে ১০,০০০টাকা জরিমানা দিতে হবে। ভাল কথা গ্রামের সবাই মেনে নিল। আমাদের গ্রামে তখন এই দুইটি নিয়ম খুব ভালো ভাবেই মানা হচ্ছিলো। দুয়েকজন গরীবের ছেলে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করা দায়ে সাজা ভোগ করলো। বিপত্তি ঘটলো কয়েকদিন পর।

সেই সময়ে যারা গ্রামের মাতাব্বর ছিলো, তাদের ছেলে-মেয়ে, ভাই বোনেরা বড় হতে লাগলো। তাদের আত্মীয় স্বজনেরা বড় হলো। বিদেশ গিয়ে টাকা পয়সা বানাতে লাগলো। টিভি-ভিসিপি/ভিসিআর বাড়ীতে নিয়ে এলো। একজন মাতাব্বরের ভাই আরেকজন মাতাব্বরের মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করে বসলো।

আরেক জন মাতাব্বরের ছেলে ঘরে ভিসিআর চালিয়ে হিন্দি ছবি দেখা শুরু করলো। গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেল। মাতাব্বররা চুপ বনে গেলেন। কোন বিচারের উদ্যোগ দেখা গেল না। গরীব মানুষেরা কানাকানি শুরু করলেন, "যত নিয়ম গরীবের জ্ন্য, বড়লোকদের জন্য কোন নিয়ম নাই।

আমাগো পোলাপান করলেই দোষ ইত্যাদি----। " আস্তে আস্তে নিয়ম শীতল হয়ে গেল। এখনতো গ্রামে ঘরে ঘরে ক্যাবল লাইন চলে, ঘরে ঘরে ছেলে মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করে। সংবিধান নিয়ে সরকার দলের নেতা-নেত-নেত্রী, এপমি, মন্ত্রীদের কথা শুনে আমার গ্রামের সেই সময়ের কথা গুলো মনে পড়ে গেল। সরকার দল যা করে সব সংবিধান মেনে করে আর বিরোধীদল বা মত যা করে সব সংবিধান পরিপন্থী! তাইতো বলতে ইচ্ছে হয় "সংবিধান তুমি কার?" বিরোধী দল হরতালের নামে ভাংচুর করলে, সভা সমাবেশে ভাংচুর করলে সংবিধান পরিপন্থী কাজ হয়ে যায়।

শীর্ষ নেতাদের হুকুমের আসামী করে জেলে ভরতে হয়। হানিফ, টুকু, নাসিম, কামরুল, আসরাফ, সুরঞ্জিত, আলমগীর সাহেবদের মুখে সংবিধান সমুন্নত রাখার প্রত্যয় দেখা যায়, কিন্তু প্রকাশ্যে রাস্তায় বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মারলেও সংববিধান পরিপন্থী কাজ হয় না, সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা প্রকাশ্যে অস্র উচিয়ে বিরোধী মতের কর্মীদের দাওয়া করলেও সংবিধান ভঙ্গ হয় না। মন্ত্রীর দূর্নীতির কারণে বিশ্ব ব্যাংক চলে গেলেও সংবিধান অক্ষুন্ন থাকে। মন্ত্রী পদ হারালেও দলীয় নেত্রীর কাছ থেকে সাচ্চা দেশ প্রেমিক উপাধী পান। থলের কালো বিড়াল ধরতে গিয়ে মন্ত্রীর মনের কালো বিড়াল বেড়িয়ে পড়লেও সংবিধান সমুন্নত থাকে, পদত্যাগ করেও পদ ফেরত পান।

সংবিধান সবার জন্য সমান। সরকারী-বিরোধী দুই দলের জন্য দুই রকম সংবিধান বাংলাদেশে নাই, কিন্তু বর্তামানে দেশে আমার ছেলে বেলায় দেখা গ্রামের মত মনে হচ্ছে, এখানেও যেন গ্রামের নিয়ম চলছে। সরকার করলে দোষ নাই, বিরোধী দল করলে সব দোষ, জেল জরিমানা প্রাপ্য। পৃথিবী অন্যান্য দেশে যে ভাবে সংবিধান মেনে নির্বাচন হয় আমাদের দেশেও তাই হবে বলে সরকার প্রধান প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশে সরকার দলী ছাত্র সংগঠন অস্রের মহড়া দেয়? বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাদের লাঠি-রামদা দিয়ে কোপায়? কোন দেশে সরকারী বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের পাশাপাশি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা লাইসেন্সবিহীন অস্র দিয়ে গুলি করে? কোন দেশে বিরোধী দলের সব নেতাকে জেলে ভরে রাখে শুধুমাত্র নামমাত্র হুকুমের আসামী করে? পৃথিবীর কোন দেশে দুই বৃহৎ দল মুখ দেখাদেখি করে না? পৃথিবীর কোন দেশে আপনাদের মত (বিএনপি -আওয়ামী লীগ) প্রয়াত নেতাদের নিয়ে গালাগালি করে? পৃথিবীর কোন দেশে বিরোধী দলকে সভা সমাবেশ করতে দেয় না? যদি একটি দেশের উদাহরণ দিতে পারেন, তাহলে আমরা সাধারন জনগণ আপনার চাওয়াকে যুক্তিক এবং সংবিধান সম্মত ধরে নিয়ে বিরোধী দাবীকে অগ্রায্য করবো, তাদের চাওয়াকে বেআইনী মনে করবো।

আর যদি দেখাতে না পারেন, তাহলে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে বিরোধী দলের নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারে দাবী মেনে নিন। আপনাদের মত আমরা আর কোন লগি-বৈঠার আন্দোলন দেখতে চাই না। ঢাকার মতিঝিলে আর কোন যুবকের খুনীদের উল্লাস দেখতে চাই না। হরতাল, অবরোধ সাধারণ মানুষ চায় না, এটা আপনাকে বুঝতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভুলে যাবেন না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই আপনি আজকের জায়গায়।

ক্ষমতার লোভে, কিছু লোভী সমর্থকের প্রলোভনে ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না। আমরা চাই না মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলের অবস্থা আগামী নির্বাচনে বিএনপির মত হোক। ২৯টি আসন পেতে আশা করি আপনি নিজেও চাইবেন না। (০৫-০৬-২-১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.