বিশেষ সাক্ষাৎকার (কালের কন্ঠ): অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির, ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কালের কণ্ঠ :ম্প্রতি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় আবারও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অস্থিরতার মূল কারণ কী বলে মনে করেন?
ড. শরীফ এনামুল কবির : ছাত্রলীগের এ সংঘর্ষের মূল কারণ আমার মনে হয় আধিপত্য বিস্তার। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ হঠাৎ করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। আমরা তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছি।
দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান আছে। তদন্তে সেটা প্রমাণিত হলে কেউ রেহাই পাবে না। সব ধরনের অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতাকে দমন করা হবে। ছাত্রলীগের ভেতরে কিছু অনুপ্রবেশকারী থাকতে পারে। বাইরের ইন্ধন নিয়ে তারা ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে চায়।
আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অবশ্যই বিচার করব।
কালের কণ্ঠ : শহীদ রফিক-জব্বার হল নির্মাণকাজের টেন্ডার নিয়েও তখন তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে প্রথম দিকে ছাত্রদল, পরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জড়িয়ে পড়ে। ক্যাম্পাসে গত দেড় বছরে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সারা দেশেই এ শিক্ষাঙ্গনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
ড. শরীফ এনামুল কবির : রফিক-জব্বার হলের নির্মাণকাজকে সামনে রেখেই সংঘর্ষ হয়েছিল। এটা অস্বীকার করব না। ছাত্রদলও এটার সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এটা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা হয়নি। আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হলের নির্মাণকাজ শেষ করেছি।
ছাত্রলীগের কিংবা ছাত্ররাজনীতির এসব বিবাদ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে এতে শিক্ষাঙ্গনেরও ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে, এমনটা আমি ভাবি না।
কালের কণ্ঠ : টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন ছাত্রলীগের নেতারা। ফলে গোটা ক্যাম্পাসেই বিরাজ করছে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। ক্যাম্পাসে সাংবাদিক পেটানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।
ছাত্রলীগকে কঠোরভাবে দমন করতে না পারার কারণেই ক্যাম্পাসে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে বলে অনেকে মনে করেন।
ড. শরীফ এনামুল কবির : ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করা বড় কঠিন কাজ। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা আমার দায়িত্বও নয়। সম্প্রতি ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। এ বিষয়ে আমাকে জানানোও হয়নি।
তড়িঘড়ি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাতে কিছু ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসী ঢুকে পড়েছে। ছাত্রলীগের এ কমিটি নিয়েও মতবিরোধ আছে। অগণতান্ত্রিকভাবে যে কমিটি হয়েছে, এতে যদি কোনো সন্ত্রাসী থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় তো তার দায়িত্ব নেবে না।
কালের কণ্ঠ : শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত, আপনার সাফল্যের পাল্লা বেশ ভারী।
তবে ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড, ক্যাম্পাসের বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এক শিক্ষিকা কর্তৃক একই বিভাগের শিক্ষক আবদুলাহ হেল কাফীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আপনার সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।
ড. শরীফ এনামুল কবির : আমি আপনার কথার সঙ্গে একমত। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। ৫ জুলাইয়ের ঘটনার জন্য আমি মর্মাহত। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সব ঘটনার দায়িত্বও আমার ওপরই পড়বে।
কিন্তু আপনিই বলেন, ছাত্রলীগকে আমি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করব। উপাচার্য হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আমার দায়িত্বের বাইরে আমি যেতে পারব না। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করা, আমার দায়িত্ব নয়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথমত আমার ছাত্র, দ্বিতীয়ত তারা সংগঠনের কর্মী।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতা গ্রহণের পর ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশেই ছাত্রলীগ অসংখ্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে। গত দেড় বছরে শুধু জাহাঙ্গীরনগরেই অনেক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
ড. শরীফ এনামুল কবির : ছাত্ররাজনীতি নিয়ে হৈচৈ তো আর কম হয়নি। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে নানাজন নানা মত দিয়েছেন। তবে আমি গণতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। তাতে সব সংগঠনের সহাবস্থান থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ গণতন্ত্র নেই।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই। অতীতে ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য ছিল, এখন তা নেই। কেন নেই, এটার পেছনের ইতিহাসও খুঁজে দেখতে হবে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে ছাত্রদের নানাভাবে ব্যবহার করেছেন।
তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একটি করে ছাত্র সংগঠন থাকবে। তারপর একে একে ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অস্ত্র, অর্থ, ক্ষমতা। ছাত্ররাজনীতির পচন শুরু হয় তখন থেকেই। আগে ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিত না। তখন তো ছাত্র সংগঠনগুলো দলীয় রাজনীতি থেকেও বেশি জনপ্রিয় ছিল।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ১১ দফা, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রনেতাদের অগ্রণী ভূমিকা সর্বজন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ছাত্ররাজনীতির সেই সোনালি যুগের কথা খুব মনে হয়। তখন সব ভালো ছাত্ররাজনীতি করতেন। তাঁরা মিছিলেও থাকতেন সবার আগে, পরীক্ষায়ও তাঁরা প্রথম হতেন। আজকে ভালো ছাত্ররা রাজনীতি করে না।
কেন করে না, এটা আমাদের ভাবতে হবে। ছাত্ররাজনীতির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা তো এক দিনে সম্ভব নয়। ষাটের দশকের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য, লক্ষ্য, চিন্তাধারা যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কেউ-ই কিছু বলবে না।
কালের কণ্ঠ : জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে আপনার অভিমত কী? সুষ্ঠু রাজনীতি বিকাশে আপনার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
ড. শরীফ এনামুল কবির : জাহাঙ্গীরনগর সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
বর্তমানে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, একাত্তরের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সারা দেশে অরাজকতায় লিপ্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ সম্পন্ন হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়। আর মরিয়া হয়ে ওঠে জামায়াত। এটা তো সবারই জানা কথা। জামায়াত কোনো দিনই চাইবে না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক।
এটা হলে যে তাদের রক্ষা নেই। ফলে বিএনপি-জামায়াত শুরু করে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপরাজনীতি। সরকাকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরও এটা থেকে মুক্ত নয়। ছাত্রদের উসকানি দেওয়া হচ্ছে নানাভাবে।
ছাত্রলীগকে একা দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। ছাত্ররাজনীতির মধ্যে যে পচন ধরেছে, ছাত্রলীগও সেটা থেকে বেরোতে পারেনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ছাত্ররাজনীতির সুদিন ফিরে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চাই ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। অগণতান্ত্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হলে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি চলতেই থাকবে।
রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরে আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রসংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করব। সর্বোপরি, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, পাঠদান, জ্ঞানার্জন, গবেষণা ও উপযুক্ত মানুষ গড়ার কাজে সবার সহযোগিতা দরকার। আমরা সেশনজট দূর করেছি, অপরাজনীতিকেও দূর করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. শরীফ এনামুল কবির : আপনাকেও ধন্যবাদ। দৈনিক কালের কণ্ঠের জন্য শুভেচ্ছা।
(সংক্ষিপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।