!!
কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাইকে নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার কিছুই নাই। যারা নিয়মিত বই পড়েন তারা নিশ্চিয় তার লেখা পড়েছেন। উনার লেখার বিষয়বস্তু বৈচিত্রময়। মনস্তাত্বিক থেকে শুরু করে পেশাগত দ্বন্ধ, সামাজিক পারিবারিক জটিলতা, রোমান্স, শাসক ও শোষিতের গল্প কি নেয় তার লেখাতে? উনার লেখার গন্ডী উচ্চবিত্তের বেডরুম বা মধ্যবিত্তের বারান্দায় থেমে থাকেনি। বরং তা বিস্তৃত হয়েছে গ্রামীন জনপদে অবহেলিতদের মাঝে।
প্রান্তিক কৃষক ও দরিদ্রশ্রেণীদের উপর মহাজন বা মাতুব্বর শ্রেণীদের স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় শোষন ও প্রতারনার চিত্র তাই বারবার উঠে এসেছে উনার গল্পে। মহারাজা গল্পে প্রশাসকের সহায়তায় চেয়ারম্যানের বা সাপ ও ওঝা গল্পে এনজিও এর সহায়তায় মাতুব্বরের বা পোকা তে মহাজনের দরিদ্রদের সর্বস্ব লুঠ ভিটেমাঠি ছাড় করার ষড়যন্ত্র ও তাতে সফল হওয়া যেন তার প্রমাণ।
তবে কি হাসনাত আবদুল হাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত নিয়তিবাদী লেখক? সবল এর বিরুদ্ধে দুর্বল এর লড়াই ও জয় কি তার লেখাতে আসেনি?
উহু! এসেছে। তিনি শোষিতদের শাষকদের বিরুদ্ধে জয়ী করেছেন তার নানা গল্পে। বাউকুরানীর খেলা গল্পে আমরা দেখি প্রশাসন ও মাতুব্বর দুইশ্রেনীর সাথে যেন যোগ দেয় ঈশ্বর।
শাসকের শতচেষ্টা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মিলেও দরিদ্র জনগোষ্টীকে হারাতে পারে না। জয় হয় শোষিতদেরই। শকুন গল্পেও শতচেষ্টার পরও মহাজন হারাতে পারে না দরিদ্র কৃষকদের। তাদের ঐকবদ্ধ চেষ্টার ফলে জয় হয় তাদেরই।
দৌড়া পরাণ দৌড়া ও কিন্তু শাসক এর বিরুদ্ধে শোষিতের প্রতিশোধের গল্প।
মুক্তিযুদ্ধ ও বীরঙ্গনাদের নিয়ে বইটিতে রয়েছে একাধিক গল্প। কৃষ্ঞপক্ষ বা ভাগীরথীর গল্প বা একাত্তুরের মোপাঁসা তার সবচেয়ে ভাল উদাহরন।
একাত্তুরের মোপাসায় আমারা মানব চরিত্রের অন্ধকার ও নোংরা দিকটা ভাল করেই দেখতে পায়।
যুদ্ধের সময় এক হিন্দু যুবতী পাক মেজরের নজরে পরে যায়। মেজরটি হয়ত তাকে ভালবেসে ফেলে তাই মেয়েটিকে ক্যাম্পে না নিয়ে তার বাসাতেই রেখে দেয়।
প্রতি রাতে মেজর মেয়েটির বাসায় আসে। ফুর্তি করে চলে যায়। মেয়েটির তখন শহরে অনেক প্রভাব। তার কাছে তদবির নিযে ছুটে আসে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা।
যেন তাদের রক্ষা করা হয় এজন্য। সকলের কাছে হাসিমুখে মেয়েটি নিজেকে বিলায়। তারপর যুদ্ধ শেষ হয়। যারা তার জন্য উপকৃত হয় তারাই তাকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দার করায়। সে শত্রুর সাথে শুয়েছে হেসেছে তাই সেও শত্রু! বাহ! কি চমৎকার মানুষ আমরা!
হাসনাত আবদুল হাই এর লেখালেখি শুরু ষাট এর দশক থেকে।
এই দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি পাড়ি দিয়েছেন নানা রাজনৈতিক উত্তাল সময় ষাট এর শেষ সময় বা নব্বুই এর স্বৈরাচার সরকার বা নানা সামরিক সরকারের সময়। কিন্তু তার লেখাতে নেয় এসবের ছিটেফোটাও। হয়ত সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা(তিনি সচিব পদে কর্মরত অবস্থায় অবসর নেন) ছিলেন বলে এ বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে তা পুষিয়ে দিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের নানা দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতা বা নির্যাতনের লেখা দিয়ে। মৃগয়া গল্পে আমরা কর্মকর্তাদের নষ্টামী স্বেচ্ছাচারিতার ভাল একটি চিত্র দেখতে পাই।
অডিট করতে গিয়ে এক কর্মকর্তার ৪র্থ শ্রেণীর এক কর্মচারীর মেয়ের প্রতি লোভ লেগে যায়। কামনা চরিতার্থ করতে না পেরে সে ঐ কর্মচারীকে চোর সাজিয়ে করে চাকুরিচ্যুত। সর আসছে গল্পও বা কম কিসে? নানা দুর্নীতি নির্যাতন করার পরও চর থেকে ফেরার পথে খাড়িতে যখন এডিসির স্পীডবোট আটকে যায় তখন শীতের রাতে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার হাত থেকে তাকে রক্ষা করে চালকের চাদর। অথচ শেষ রাতে বাংলোতে ফিরে ঘৃণ্যায় সে প্রথমেই চাদরটি ছুড়ে ফেলে হুমকি দেয় ঐ কর্মচারীকে চাকুরিচ্যৃত করার। বা! কি চমৎকার আমাদের দেশের সরকারী কর্মকর্তারা।
রাবেয়া বা কাফকার পোকা কিন্তু অন্য স্বাদের গল্প। মধ্যবিত্ত পরিবারের নানা অবক্ষয় নিযে সাজানো হয়েছে এই গল্পগুলো। যুবতী ও জাদুকর আবার ফ্যান্টাসী টাইপ গল্প। ধীবর ও মেঘনা এক বৃদ্ধ জেলের বিশাল এক বোয়াল মাছ ধরা ও তাকে বেচার সংগ্রাম। যেন মানব জীবনের চিরায়ত লড়াই এর গল্প।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ গল্পটিতে আর্নস্ট হেমিংওয়ের "দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দ্য সী" র ছাপ বেশ স্পষ্ট। যা সচেতন পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। তবে এ বই এর রুপক গল্পের ক্ষেত্রে সেরা বলব মাদার কারেজের কথা। মাদার কারেজের মার সংগ্রাম কিন্তু মা ছেলের যুদ্ধ নয় এ যেন আমাদের দেশের গল্প। দেশকে তৈরী করার যুদ্ধের গল্প।
হাসনাত আবদুল হাই কিন্তু রোমান্সকে এড়িয়ে যাননি। শুধু আলাপিতা ,ভালোবাসার গল্প ,কবি ও পাখি বা ইন্টারভিউ ঐ ধাচেরই গল্প।
তবে বই এর সেরা গল্প আমি বলব বাবরের পার্থনা। বিয়ের আগের রাতে বখাটেদের হাতে অপহৃত হয় এক মেয়ে। পতিত হয়ে মেয়েটি যখন কয়েকদিন পর ফিরে আসে তখন কেউ তাকে মানতে পারে না।
এমনকি তার বাবাও অশ্রুসজল চোখে বলে, তুই কেন ফিরে এলি?
কি সুন্দর আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। এখানে একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে হয় পতিত। আর আমরা ছেলেরা শত ধর্ষন করেও থেকে যায় পবিত্র!কারও কারও কাছে হয়ত হিরোও। কিন্তু যে মেযেটি হয় পাপের শিকার সেই হযে যায় দোষী। বিচিত্র এ সমাজ! বিচিত্র মানুষ!
গল্পসমগ্রতে এমনি ভিন্ন ধাচের, স্বাদের মোট ৫৩টি গল্প রয়েছে।
যার বিস্তারিত আলোচনা করা অনেক সময়সাপেক্ষ। তবে এটুকু বলতে পারি সবগুলো গল্পই অসাধারন। আমি নিশ্চিত যা আপনাদের ভাল লাগবে।
বাংলা বই এর পিডিএফ বা ওয়ার্ড কপি পাওয়া বেশ দুষ্কর। যা কিছু পাওয়া যায় তার বেশীরভাগই হুমায়ুনময় বা ভারতীয় লেখকের।
এই বইটির তাই কোনো লিংক তাই দিতে পারলাম না। দু:খিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।