আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাসনাত আবদুল হাইয়ের ভীমরতির স্বরূপ সন্ধানে

১৪২০ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে বাঙালি জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবীত একটি ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক এবং রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নববর্ষ উদযাপন করছে সে সময় হাসনাত আবদুল হাই নামে সাবেক আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত লেখক জাতিকে ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’ শিরোনামে একটি অনবদ্য রচনা উপহার দিয়েছেন। নববর্ষে প্রিয়জনদের প্রীতি উপহার প্রদান সম্ভবত সর্বদেশে সর্বকালেই প্রচলিত রীতি। কিন্তু একজন লেখক যখন তাঁর রচনার মাধ্যমে সমগ্র জাতির সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে একটি বিকৃত রুচি ও অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান তখন সেই উপহারকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া কোনো গত্যান্তর থাকে না। হাসনাত আবদুল হাই-এর এই লেখাটি গল্প হিসাবে অত্যন্ত নিম্নমানের এবং সাহিত্যের মানদণ্ডে বিচার করা হলে তা কোনো সাহিত্য পদবাচ্য নয়। তবে এই রচনা চুয়াত্তর বছর বয়েসী একজন যৌন বিকারগ্রস্ত বৃদ্ধের ভীমরতি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

কথিত গল্পে অত্যন্ত সচেতনভাবে আমাদের রাজনীতি, বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার সংগ্রাম এবং চলমান রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে গর্জে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চকে সরাসরি আঘাত করা হয়েছে। এই বিনষ্ট বুদ্ধিজীবী আমাদের মিডিয়া জগত ও সুকৌশলে আমাদের জাতীয় পতাকাকে কটাক্ষ করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণ আন্দোলনসহ সকল সংগ্রামে এদেশের নারী সমাজ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের বোনেরা ভাইদের পাশাপাশি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে প্রাণপণ লড়াই করেছেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে রাজাকার আল বদর ছাড়াও কবি সাহিত্যিকের ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে থাকা হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো শত্রুরা দেশের সংগ্রামী নারীদের এই ভূমিকাকে হেয় প্রতিপন্ন করার কোনো সুযোগই ছাড়তে চান না।

নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার সূত্রে তিনি বীরকন্যা প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, ইলা মিত্র থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী পর্যন্ত প্রকারান্তরে সকলকেই অবজ্ঞা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। ‘গল্পে’ ব্যবহৃত ভাষা এবং বাক্য বিন্যাস নেহায়েত অরুচিকর ও শালীনতা বিবর্জিত বিধায় উদ্ধৃতি দেয়া থেকে বিরত থেকেও বলা যায় হাসনাত নারীকে শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য মনে করেন এবং তাঁর এই পুরুষতান্ত্রিক সামন্তবাদী মনোভাবের পরিচয় ‘টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি’ শিরোনামের পর্নোকাহিনীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে। তার বক্তব্য অনুসারে নারী তার নিজের যোগ্যতায় রাজনীতি বা কর্মক্ষেত্রে স্থান করে নিতে অক্ষম। ফলে আমাদের মায়েরা, বোনেরা এবং মেয়েরা তার মতো (এবং গণধিকৃত স্বৈরাচারী এরশাদের মতো) নষ্ট চরিত্রের রাজনীতিবিদ ও বুড়োভাম ‘সেলিব্রেটিদের’ দ্বারস্থ হয় বলে তিনি মনে করেন। গ্রাম অথবা মফস্বল শহর থেকে আমাদের যে মেয়েরা ঢাকা চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর মতো শহরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করতে যায়, তাদের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেশন জট এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাসহ প্রতি নিয়ত কি পরিমাণ সংগ্রাম করে বাঁচতে হয় তা হাসনাতের মতো স্যুটেড বুটেড আমলা লেখকের জানার কথা নয়।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটি মেয়ের জীবন সংগ্রামের চেয়ে তার বয়স, চেহারা ও শরীরের আকার আকৃতি তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। আমলা লেখক আবদুল হাই চাকুরিতে থাকা কালীন নভেরা, এস এম সুলতান এবং আরজ আলী মাতুবরের জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস ও কিছু ভ্রমণ কাহিনী লিখে এবং পাশাপাশি তাঁর পদাধিকার কাজে লাগিয়ে সাহিত্যিক হিসাবে জাতে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং ধরে নেয়া যায় কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণের পরে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টায় নিয়োজিত হন তিনি। একজন মধ্যমেধা সম্পন্ন সুবিধাবাদী চরিত্রের সাথে যখন লোভ যুক্ত হয় তখন তা কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, এই নিকৃষ্ট গল্পটি তারই প্রমাণ। নাম-ধাম, খ্যাতি ও যশের প্রত্যাশী এই লেখককে অর্থ বিত্তের আকাক্সক্ষা কতটা তাড়িত করেছে আমার জানা নেই, তবে নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা তথা লোভ ও লালসা তাঁর গল্পের ছত্রে ছত্রে নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি একটি চরিত্রের মাধ্যমে লেখক জাতীয় রাজনীতিকে কটাক্ষ করেছেন এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনকে। পহেলা বৈশাখে যখন লাখো জনতা শাহবাগে হাতে হাতে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতির আলোয় অন্ধকার দূরীভূত করে আলোর পথে যাত্রার শপথ গ্রহণ করছেন, তখন এই অন্ধকারের জীব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ একটি গণ জাগরণের মূলস্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংগঠকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। অবশ্য এক সময়ে পাকিস্তানের সেবাদাস, গণবিচ্ছিন্ন আমলার কাছ থেকে জনগণের কোনো প্রত্যাশা নেই এবং থাকতে পারেও না। অতএব খুব স্পষ্টভাবেই বলা যায় এই লেখা লেখকের বার্ধক্যজনিত মস্তিস্ক বিকৃতির কোনো আকস্মিক ফল নয়। এটি জনতার সংগ্রামের বিরুদ্ধে একটি সুচিন্তিত আঘাত।

সবশেষে বলতে চাই ‘সব কিছু ভালো’র সাথে থাকার দাবীদার পত্রিকাটি এই নিম্নমানের ‘ভালো’ গল্পটি প্রকাশ করে দেশ ও জাতির কী উপকার করেছেন তা জানি না। আরও অনেকদিন আগেই লেখক হিসাবে যার অবসরে যাওয়া উচিত ছিল, তেমন একজন লেখক তাঁর মনোবৈকল্যের কারণে যা ইচ্ছে তাই লিখে ফেলতে পারেন। কিন্তু একটি দৈনিক পত্রিকায় কি সম্পাদকীয় বিচার বিশ্লেষণ অথবা মান যাচাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি এ ধরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকে এবং লেখকের নাম দেখেই লেখা ছাপা হয় তা হলে বলার কিছু নেই। কিন্তু ‘এডিটোরিয়াল জাজমেন্ট’ বলে যদি কোনো ব্যাপার এই পত্রিকার থেকে থাকে তা হলে এ ধরণের একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত লেখা প্রকাশের দায়দায়িত্ব তাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

আর যদি পত্রিকার অনুরোধেই বিশিষ্ট পর্নোলেখক এই লেখাটি নববর্ষের উপহার হিসাবে লিখে থাকেন তাহলে পত্রিকাটিকে তার খেসারত দিতে হবে, আজ অথবা আগামীকাল। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.