আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন এস এম সোহাগের মৃত্যুতে কি কিছুই আসে যায় না..?



আজ ২০১০ সালের ২৬ জুন। রাত ঠিক ১১টা ২৬ মিনিটে আমি এই লেখাটি শুরু করেছি। লেখাটি লিখতে লিখতেই হয়ত এস এম সোহাগের এই মৃত্যুদিনটি পেরিয়ে যাবো। প্রবেশ করবো ২৭ জুনের কক্ষপথে। আর এ মৃত্যু সংবাদটি হবে একদিনের পুরানো।

হয়ত ক্রমে কমতে থাকবে শোক। সকালে ঘুমটা ভেঙেছিলো জাফর ভাই (সাংবাদিক আবু জাফর সাইফুদ্দিন) এর ফোনে। ৯টার দিকে সে মোবাইলে জানালো- এস এম সোহাগ আর নেই। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বরিশাল থেকে সাংবাদিক বন্ধু আব্দুল্লাহ মাহফুজও ফোন করে একই সংবাদের পুনূরাবৃত্তি করে। সকাল ৭টা দিকে সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছে।

খবরটা শুনে কষ্ট পাওয়ার চেয়েও হতভম্ভ হয়েছি বেশী। মনে পড়লো গত ৪ তারিখের কথা। ঐদিনই শেষ বারের মত কথা হয়েছিলো সোহাগ ভাইয়ের সাথে। সেদিন সে জানিয়েছিলো শীঘ্রই ঢাকা আসবে আর অবশ্যই দেখা করবে। এরপর গত সপ্তাহে নাকি সে ঢাকা এসেছিলো।

কিন্তু আমার সাথে তার দেখা বা কথা হয়নি। সেই শেষ বার কথা বলার সময় সোহাগ ভাইয়ের বলা একটি কথা এখনো কানে বাজছে ‘সাংবাদিক হইস ভাই, ধান্ধবাজ-চান্দাবাজ হইস না’। এখানে একটু বলে নেই- কে এই এস এম সোহাগ। সদ্য প্রয়াত এই য্বুকটিকে ভাই, বন্ধু বা সহকর্মী- যে কোন কিছূই বলা যায়। সহজ ভাবে বললে সে আমার প্রায় ৭ বছরের কর্ম জীবনের সবচে বান্ধব সহকর্মী।

আমার মনে হয় সে শুধু আমার না, বরিশালে সাংবাদিকতা করেছে বা করছে এমন অনেকেরই সবচে বান্ধব সহকর্মী। তার পুরো নাম শরীফ মোহাম্মদ সোহাগ। তবে মিডিয়া বা নিজস্ব অঙ্গনে এস এম সোহাগ নামেই তার পরিচিতি। সে ছিলো ‘সাপ্তাহিক’ এর বরিশাল প্রতিনিধি আর স্থানীয় দৈনিক বরিশাল প্রতিদিন এর সিনিয়র ষ্টাফ রিপোর্টার। শরীফ মোহাম্মদ সোহাগের বাসা ছিলো বরিশালের সাগরদী এলাকায়।

তবে তার আড্ডাটা ছিল সদর রোড আর ফকিরবাড়ি রোড কেন্দ্রীক। উশৃঙ্খল ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে অনেকটা বেপরোয়াই কেটেছে তার কৈশোরের শেষ ভাগ। এরপর তারুন্যের শুরুতে হটাৎ করেই এক দিন বদলে যায় সে। মিল্টন ভাইয়ের (সাংবাদিক শওকত মিল্টন) হাত ধরে প্রবেশ করে স্থানীয় সংবাদ পত্র জগতে। এরপর থেকেই ক্রমাগত বহু চমকপ্রদ সংবাদের জন্ম দিয়ে গেছে সে।

সংবাদ প্রকাশের জেরে সন্ত্রাসী বা র‌্যাব-পুলিশের কোপানলে পড়ে নিজেও সংবাদের রসদ হয়েছে বহুবার। এভাবেই আস্তে আস্তে একদিন সে এস এম সোহাগ হয়ে ওঠে। তথাকথিত ৩য় বিশ্বের এক দেশের অবহেলিত একটি বিভাগীয় শহরের এক সাংবাদিকের স্বাভাবিক মৃত্যুতে এই বিশ্বের কি আসে যায়- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আসলেই তাই। এই যেমন আজ মৃত্যুর সংবাদ শুনে হতভম্ভ হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক হতে হয়েছে।

ঠিকই দৌড়াতে হয়েছে সংবাদের পিছনে। ইচ্ছে থাকলেও প্রিয় সহকর্মীকে শেষ বারের মত দেখতে ছুটে যেতে পারিনি। তবু আমার মনে হচ্ছে এগুলো লেখা দরকার। কিছু মানুষের অন্তত জানা দরকার যে- একজন এস এম সোহাগ ছিলো, সেই এস এম সোহাগ আর নেই। সোহাগ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০০৩-০৪ সালে।

বরিশালের বিবির পুকুরের পাড়ের সেই প্রথম সাক্ষাতেই খুব সহজে আপন করে নিয়েছিলো সে। তখন সে দৈনিক শাহানামা-তে কাজ করে আর আমি আজকের পরিবর্তন-এ। সেই থেকে শুরু। এরপরই আবার আমরা বহুদিন একসাথে আজকের পরিবর্তন-এ কাজ করেছি। এই সোহাগ সেই সোহাগ যে দিন-রাত সংবাদের পিছনে ছুটতো।

আর ছুটতো মানুষের বিপদে। এমন মানুষ আছে কিনা সন্দেহ যে কিনা সাহায্য চেয়ে তার কাছ থেকে সাড়া পায়নি। যে কোন সময়ে যে কোন বিপদে সহকর্মীদের আস্থার প্রতীক ছিলো সে। আমার তখন বরিশালে আর এক মুহুর্ত ভালো লাগছিলো না। সব চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কারণ ততদিনে আমি আমার লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছি, আর এটাও জেনেছি যে- সেখানে পৌছানো বরিশালে বসে সম্ভব নয়। অথচ ঢাকায় আসারও কোন উপায় নেই। সারাদিন ছটফট করতাম। কিন্তু কোন ভাবেই টাকা যোগাড় করতে পারছিলাম না। তখন আর কেউ না বুঝলেও এই সোহাগ ভাই আমাকে বুঝতে পারে।

সে-ই সেই ব্যাক্তি যার টাকায় আমি সেদিন ঢাকার বাসের টিকিট কাটি। এছাড়া আরো কত দিন যে তার কাছ থেকে ১০/২০ টাকা করে কত টাকা নিয়েছি, তার কোনো হিসেব নেই । বরিশালে থাকাকালীন সময়ে দেখতাম- অধিকাংশ সিনিয়র সাংবাদিকই র‌্যাব-পুলিশ বা ক্রাইম সংক্রান্ত কোনো সংবাদ সম্পর্কে জানতে প্রথমেই ফোন করতো এস এম সোহাগকে। আর এ কারণে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার মোবাইলটি চরম ব্যস্ত থাকতো। কারণ ঐ সময়টাই মূলত বিভিন্ন পত্রিকার ব্যুরো অফিসগুলোর পিক আওয়ার।

তাছাড়া রোদ-বর্ষা বা যে কোনো পরিস্থিতিতে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে সোহাগের মোটর সাইকেলের বিকল্প ভাবতেই পারতো না অনেকে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি জনপদে এই বিশ্বস্ত সংবাদ কর্মির পা পড়েছে। সোহাগ ভাইকে দেখেই শিখেছিলাম- সরেজমিন সাংবাদিকতার মজাটা কোথায়। কি সব প্রত্যন্ত এলাকায়ই না গিয়েছিলাম তখন। কত সহজেই না ভয়কে জয় করতো সে- অবাক হয়ে দেখতাম।

এতক্ষণ পর হটাৎ মনে হলো- কি সব লিখছি; আমি কি এসবই লেখতে চেয়েছিলাম। কথাই তো বলা হয়নি। আবার কত কথা বলা যায় না। শুনলাম তার দাফন হয়ে গেছে। তার আগে বিকেলে বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের সামনে তার মরদেহ রাখা হয়েছিলো।

সেখানে জানাযাও হয়েছে। এরপর তাকে ফূল দিয়ে শেষ বিদায় জানিয়েছে তার সহকর্মিরা আর প্রিয় শহর বরিশাল। দৃশ্যটা কল্পনা করে তার প্রিয় মোটর সাইকেলটার শূণ্য সিটটির মতোই খা খা করে ওঠে বুকটা। এস এম সোহাগের চরিত্রের আর একটি দিকের ব্যাপারে না বললেই নয়। নিজের মাকে প্রানের চেয়েও বেশী ভালো বাসতো সে।

মায়ের দুই দফা ষ্ট্রোক ও দীর্ঘ দিনের অসুস্থতায় মানুষিক ভাবে কিছু ভেঙে পড়লেও হাল ছাড়েনি সে। মাকে নিয়ে এমন কোন চিকিৎসক নেই যার কাছে সে যায়নি। এমনকি ভারতেও গিয়েছে। তার রাত জেগে মায়ের সেবা করার সেই ব্রত দেখে শ্রদ্ধা মস্তক অবনত হতো। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি।

মায়ের মৃত্যু আর বিয়ে তাকে আরো বদলে দেয়। হটাৎ করেই যেনো বুড়িয়ে যাচ্ছিলো সে- অন্তত আমার তেমনটাই মনে হচ্ছিলো। সবচে যে বিষয়টা শুনে আশ্চর্য লাগলো সোহাগ ভাইয়ের পায়ের হাড়ের সমস্যা নাকি ক্যান্সারে রূপ নিয়েছিলো। আর এটা নাকি সে অনেক আগে থেকেই জানতো। অথচ কখনোই তাকে এনিয়ে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতে শুনিনি।

এ লেখা শেষ হবার নয়। তবু শেষ করে দিলাম। কারণ স্মৃতিচারণ করতে গেলে একটির পর একটি ঘটনা মনে পড়তে থাকবে আর এই লেখাটিও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে। তার চেয়ে থাক না কিছূ স্মৃতি শুধু নিজেরই জন্য তোলা। সেই সাথে তুলে রাখি একটি প্রশ্ন- একজন এস এম সোহাগের মৃত্যুতে কি বরিশালের কিছুই আসে যায় না..?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.