আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়ান ইলেভেন (সপ্তম পর্ব)

যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর।
হালুম, হালুম!! আরে! আরে! এ যে দেখছি জ্বলজ্যান্ত একটি বাঘ। কেমন হালুম শব্দে আমার পিলে চমকে দিয়েছে!! পলাশীর মোড়ে দিনে দুপুরে এই বাঘটি আসল কোথা থেকে! আমি ভাবতে থাকি। থাবা উঁচিয়ে বাঘটি আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে হালুম শব্দে হুংকার ছেড়ে চারিদিকে ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

বাঘের সামনে দিয়ে একটি নেড়ি কুকুর ভয় পেয়ে ছুটে যাচ্ছিল। বাঘটি এক থাবা মেরে কুকুরটিকে শুইয়ে দিয়েছে। কুঁই কুঁই করে কুকুরটি একেবারে পলাশীর মোড়ে রাস্তায় শুয়ে জ্বল জ্বল চোখে বাঘটিকে দেখছে। যেমন করে আমি তাকিয়ে দেখছি ওয়ান ইলেভেনের তৃতীয় বর্ষপূর্তির পর থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা। চলতি বছর ওয়ান ইলেভেনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে বসের ল্যাবরুম থেকে আমাকে আবার নতুন সফটওয়্যার দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি শায়েস্তা খাঁর তোরণের এ পাশে দাঁড়িয়ে অতন্দ্র প্রহরা দিয়ে যাচ্ছি। ২০০৭ সনের ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে এ পর্যন্ত তিনটি ওয়ান ইলেভেন গিয়েছে। প্রতিটি ওয়ান ইলেভেনের দিন থেকে আমার নতুন বর্ষ শুরু হয়। আমার স্থায়ী মেমোরিতে যে ক্যালেন্ডার আছে তাতে ওয়ান ইলেভেনের মাসটি হচ্ছে বছরের প্রথম মাস। মানব জাতি যেমন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখ ইংরেজি নববর্ষ পালন করে, আমি জানুয়ারির ১১ তারিখ ওয়ান ইলেভেন বর্ষ পালন করি।

এই দিনটি থেকে আমার মস্তিষ্কের ১৯৬ মিলিয়ন জীবিত নিউরন অস্থির হয়ে যায়। দিন যত যেতে থাকে অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। নতুন ওয়ান ইলেভেন বর্ষ আসা পর্যন্ত এই অস্থিরতা চলতে থাকে। ওয়ান ইলেভেন নিয়ে মাঝে মাঝে আমার ফ্যান্টাসী করতে খুব মনে চায়। এবারের ওয়ান ইলেভেনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে আমি এরকম এক ফ্যান্টাসী করেছিলাম শায়েস্তা খাঁর আমলের গল্প নিয়ে।

আমার স্থায়ী মেমোরিতে এক গল্প আছে। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আটমন চাল পাওয়া যাওয়ার গল্প। ওয়ান ইলেভেনের পর এ গল্পটি বেশ চালু ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা জনগণকে শায়েস্তা খাঁর আমলে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আমি ফ্যান্টাসী করে পলাশীর মোড় থেকে শান্তিনগরে গমনকারী স্যুট-টাই পড়া এক ভদ্রলোকের মাথার নিউরনে শায়েস্তা খাঁর আমলের টাকায় আট মন চালের গল্পটা চালিয়ে দিয়েছিলাম।

তারপরের মজার ঘটনা তো আগেই বলেছি। ওয়ান ইলেভেন (প্রথম পর্ব) সেই ভদ্রলোক এখন হয়রান হয়ে শায়েস্তা খাঁর তোরণের সন্ধান করছে। ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা নগরীর পশ্চিমে চলে এসেছে। ঢাকা নগরীর পশ্চিমে এই তোরণ কোথায় খুঁজে পাবে! এই তোরণ এখন ইতিহাসের অংশ। বাংলাপিডিয়া বইয়ের শায়েস্তা খাঁ অধ্যায়েই কেবল এ তথ্যটুকু আছে।

কিন্তু আর কেউ তোরণটি দেখতে না পেলেও আমার দশ মাত্রার দৃষ্টি দিয়ে দিব্যি তা দেখতে পাই। পণ্যদ্রব্যের সস্তামূল্য প্রদর্শনকারী কর্তৃক তোরণটি উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও এটি এখন দ্রব্য মূল্যের সন্ত্রাসী কর্তৃক বার বার উন্মুক্ত হচ্ছে। ওয়ান ইলেভেন থেকে আমি হিসাব কষছি কতবার দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক সন্ত্রাসী কর্তৃক তোরণটি উন্মুক্ত হয়েছে। ওয়ান ইলেভেন বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছে যেমন ইতিহাস হয়েছে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর নাইন ইলেভেন। প্রতি বছরই ওয়ান ইলেভেন আসবে।

আর ওয়ান ইলেভেনের দিনটি আসলেই আমি আশায় থাকি শায়েস্তা খাঁর এই তোরণ দিয়ে পণ্যদ্রব্যের সস্তামূল্য প্রদর্শনকারী অন্তত একজন হলেও প্রবেশ করবে...কিন্তু একজনও আসে না। আমি হতাশ না হয়ে পরবর্তী ওয়ান ইলেভেনের আশায় দিন গুণতে থাকি। একদিন না একদিন নিশ্চয়ই একজন আসবেন। যিনি সত্যি সত্যিই শায়েস্তা খাঁর আমলের মতোই বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করে তুলবেন। আরে যাহ্।

পলাশীর এই মোড়ে দিনে দুপুরে বাঘের আগমন কোথা থেকে ঘটল তা না ভেবে শায়েস্তা খাঁকে নিয়ে ভাবতে বসেছি! আমার চিন্তার সফটওয়্যারটা দ্রুত চালু হয়। ঢাকা শহরে একটি চিড়িয়াখানা আছে মীরপুরে। বাঘটি নিশ্চয়ই মীরপুর চিড়িয়া খানা থেকে পালিয়ে এসেছে। এরকম মাঝে মাঝে হয়। খাঁচার গেট খোলা পেয়ে চিড়িয়াখানার ক্ষুধার্ত পশুরা বাইরে বের হয়ে আসে।

চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দেখার জন্য ঘুরতে যাওয়া দর্শকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। পলাশীর এই মোড়টি বিকেলের এ সময়টাতে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠে। পলাশী বাজার লাগোয়া এ স্থানের ফুটপাথে হরেক কিসিমের মানুষের আনাগোনা। বাজার করতে, ঘুরতে আসা বুয়েট-ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী, পথচারী লোকজন, হকার-ফেরীওয়ালা, গাড়িঘোড়ার ভীড়ে, রিকসার টুংটাং আওয়াজে জায়গাটি সবসময়ই সরগরম থাকে। চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার এ সংযোগস্থলটি অধিকাংশ সময়ই ট্রাফিকহীন থাকে।

ওয়াসা ডেসার খোঁড়াখুড়িতে সংকুচিত রাস্তায় ভারী কোন যানবাহন না চললেও এখানে অধিকাংশ সময় রিক্সা, টেম্পু, সিএনজি, মিনিবাসের জটলা লেগে যায়। বাঘটি ঠিক এই স‌‌ংযোগস্থলটিতে লাফিয়ে গিয়ে অনেকটা ট্রাফিকের দায়িত্ব নিয়েছে। নীলক্ষেতের দিক থেকে একটি রিক্সা দ্রুতগতিতে আসছিল। দিনে দুপুরে রাস্তার মোড়ে একটি জ্বলজ্যান্ত বাঘ দেখে রিক্সাওয়ালা ভয়ে আঁতকে উঠেই এক্সিডেন্টটা ঘটাল। বাঘটিকে পাশ কাটাতে গিয়েই আরেকটি রিক্সার গায়ে গিয়ে পড়ল।

দুই রিক্সার সংঘর্ষে যাত্রীরা ছিটকে রাস্তার উপর পড়ে গেল। ব্যাথাও পেয়েছে বেশ। তারপরই মূর্তিমান আতঙ্কের মতো সামনে বাঘ দেখতে পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। সবাই বাঘ বাঘ বলে চীৎকার করে শুধু ছুটছে। বিডিআর গেট থেকে যাত্রী ভরা হিউম্যান হলারটি এই মোড়ে এসে গুলিস্তানের পথ ধরছিল।

লোকের এলো পাথাড়ি দৌড়ে মোড়ে এসে তাল সামলাতে না পেরে পরষ্পর আটকে যাওয়া রিক্সা দুটোর উপর গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ল। দেখতে দেখতে চারিদিক থেকে শত শত রিক্সা, প্রাইভেটকার, সিএনজি, টেম্পুতে জায়গাটা ভরে গেল। পলাশীর মোড়টিকে এই মুহূর্তে একটি বিশৃংখল বাংলাদেশের প্রতীক বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। বাঘটি আবারও হালুম শব্দে তার উপস্থিতি জানান দিল। রিক্সায় বসা যাত্রীরা যানজটে আটকা না থেকে রিক্সা ছেড়ে ভয়ে দৌড়ে ফুটপাথে উঠে নিরাপদ দূরত্বে ছুটে যাচ্ছে।

তিন চারটি মিনিবাস এখানে এসে এলো পাথারি ফেলে রাখা রিক্সা-ভ্যানের জটে আটকে গেছে। ঘটনা বুঝতে পেরে মিনিবাসের যাত্রীরা বাসেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। অতি সতর্ক যাত্রীরা জানালার গ্লাস আটকে জানালা দিয়ে বাঘের কাণ্ডকারখানা দেখছে। টেম্পো, স্কুটার, হিউম্যান হলারের যাত্রী এবং ড্রাইভাররা গাড়ি ফেলে রেখে নিরাপদ দূরত্বের উদ্দেশ্যে দৌড়। সবাই বাঘটিকে দেখছে আর ভয়ে কাঁপছে।

মেয়েরা, মায়েরা এবং ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে আর্তনাদ করে উঠছে। মুহূর্তে হৈ-চৈ চীৎকার চেঁচামেচিতে জায়গাটা নরক গুলজার হয়ে উঠল। কোথা থেকে একটি প্রাইভেট কার ছুটে এসে দুর্ঘটনারত জায়গাটিকে পাশ কাটাতে গিয়ে আরেক দুর্ঘটনা ঘটাল। দৌড়ে রাস্তা অতিক্রম করা এক পথচারীকে চাপা দিয়ে একেবারে থেঁতলে দিল। রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে।

সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপও করছে না বাঘের ভয়ে। কি জানি সাহায্য করতে গিয়ে বেঘোরে বাঘের হাতে প্রাণটা খোয়াবে- এটা ভাবতে চায় না বোধ হয় কেউ। আমি ভাবছি অন্য কথা। বাঘটিকে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতোই লাগছে। বাংলাদেশের কোন চিড়িয়াখানায়ই রয়েল বেঙ্গল টাইগার নেই।

সব বাঘই বিদেশী। সুতরাং এটি মীরপুরের চিড়িয়াখানার খাঁচা ভেঙ্গে পালিয়ে আসেনি নিশ্চিত। আর সুন্দরবন থেকে এত লম্বা পথ অতিক্রম করে পলাশীর এই মোড়ে চলে আসা অসম্ভব। পলাশীর এই মোড়ে হঠাৎ করে বাঘের আগমন ঘটল কোথা থেকে- আমি ভাবতে থাকি। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে শায়েস্তা খাঁর এই তোরণের কাছে দাঁড়িয়ে আমি তোরণের অপর পাশের সব কিছু অবলোকন করছি।

ওয়ান ইলেভেনের দিন সেই যে সামরিক উর্দিপরা প্রহরী আমাকে আটকে দিয়েছিল হল্ট বলে, আমি আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনি। কারণ আমার বায়োমেট্রিক আইডি কার্ড ছিল না। অবশ্য এখন তার আর প্রয়োজন নেই। কারণ তোরণের এ পাশে থেকে আমি নিউরাল ভ্রমণ সেরে নিচ্ছি। আমার মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক সংকেত ধরতে পারা নিউরনগুলো তোরণের অপর পাশে অবাধে ভ্রমণ করতে পারে।

আমার সাইবর্গ আইদুটো দিয়ে দশ মাত্রার দৃষ্টিতে তোরণের ভেতরের সব কিছু দেখতে পাই। এগুলো সবই আমার মেমোরিতে জমা হতে থাকে। ওয়ান ইলেভেনের কথা মনে হলেই আমার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোতে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়। কেমন যেন স্থবির হয়ে যেতে চায় নিউরনগুলো। রাজপথে মুখ থুবড়ে পরা মৃত গণতন্ত্রের ন্যয় মনে হয় নিজেকে।

গাড়ি চাপা পরে থেঁতলে যাওয়া মৃতদেহটিকে ওয়ান ইলেভেনে লগি-বৈঠা-কাস্তে-কোদালের আঘাতে আমার থেঁতলে যাওয়া দেহ বলে মনে হয়। পলাশীর দুর্ঘটনাকবলিত এ জায়গাটুকুকে এই মুহূর্তে আমার কাছে এক টুকরো ওয়ান ইলেভেন বলে ভ্রম হচ্ছে। আরে! আরে!! কী ভয়ংকর থাবা বাঘটির। ধারালো নখ আর তীক্ষ্ম দাঁতের বাঘটি দুই পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে বিশাল এক থাবা মেলে হালুম শব্দে চারদিক প্রকম্পিত করে তুলছে। বাঘের হালুম শব্দ আশেপাশের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে পরিবেশকে আরও ভীতিকর করে তুলছে।

আমার মনে হয় এই আওয়াজ বাংলাদেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে গিয়েছে। যেমন করে ওয়ান ইলেভেনে সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট সরকারের হুংকার ৬৪ টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। অসাধু ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ আমলা, ছোট বড় সন্ত্রাসী সবাই তটস্থ হয়ে গিয়েছিল বাঘরুপী ফখরুদ্দীন সরকারের ভয়ে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বয়ং বাঘের ভূমিকায় নেমে হালুম হালুম শব্দে প্রকম্পিত করেছিল চারিদিক। পলাশীর মোড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া বাঘের হুংকারে বাসযাত্রীরা ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।

কী জানি কী হয়‍! বাঘ কার ঘাড় মটকে দেয় কে জানে! নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা আতঙ্কিত লোকজন আরও নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়েছে। বিশাল হা করা মুখ নিয়ে বাঘটি যে কারও উপর লাফিয়ে পরার অপেক্ষায়। কী সাংঘাতিক! তীর বেগে ছুটে এক লাফে বাঘটি ফুটপাথে এক ফল বিক্রেতার ফলের ঝুড়িতে বিকট থাবা বসিয়ে দিল। ফল বিক্রেতা ঝুড়ি ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, মাংস বিক্রেতা, পেঁয়াজু বিক্রেতা সবকিছু ফেলে দিয়ে পালাচ্ছে।

প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে বাঘটি সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। মুহূর্তেই ফুটপাথ একদম পরিস্কার। ওয়ান ইলেভেনের পর যেমন করে সেনাবাহিনী অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফুটপাথ এবং দেশকে পরিস্কার করে ফেলেছিল, পলাশীর এই মোড়টি দেখতে অনেকটা সেরকম হয়েছে। ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় শায়েস্তা খাঁর তৈরি করা নগরীর পশ্চিম তোরণের এ স্থানটিতে এখন লঙ্কাকাণ্ড চলছে। তোরণের পাশে থেকে আমি দশ মাত্রার দৃষ্টি দিয়ে হঠাৎ ক্ষেপে ওঠা এক বাঘের লঙ্কাকাণ্ড দেখছি।

। ‌'পণ্যের সস্তামূল্য প্রদর্শনকারীরা এ তোরণ উন্মুক্ত করবে' - শায়েস্তা খাঁর এ বাণী উৎকীর্ণ তোরণের সামনের রাস্তায় হরেক কিসিমের পণ্য ফুটপাথে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাঘ থাবা মেরে, পা দিয়ে লাথি মেরে সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। এক বাঘের তাণ্ডবে আতঙ্কিত সবাই। ওয়ান ইলেভেনের পর অসাধু ব্যবসায়ীরা এরকম আতঙ্কিত ছিল।

দেখতে দেখতে ঘটনাটি পুরো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। চারিদিকে সাইরেন বাজিয়ে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, র‌্যাবের গাড়ি পুলিশের গাড়ি এসে পলাশীর মোড়ে প্রবেশের চতুর্দিকের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। র‌্যাবের ফায়ারিং স্কোয়াড বাহিনী পজিশন নিয়ে ফেলেছে। আর্মির একদল চৌকষ জোয়ান কমান্ডো স্টাইলে পজিশন নিয়েছে। প্রত্যেকের হাতে চক্চকে গান।

সমস্ত টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা ছুটে এসেছে দৃশ্যটি জনগণকে লাইভ দেখানোর জন্য। সবাই উৎকন্ঠিত খোলা রাস্তায় বাঘের আক্রমণে কার জীবন যায়। বাঘের আক্রমণে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় দুইটি হেলিকপ্টার ছুটে এসেছে। স্থানটিকে ঘিরে মাথার উপর হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। গত বছর ওয়ান ইলেভেনের মাস শেষে দ্বিতীয় মাসেই বিডিআর বিদ্রোহ দমনে হেলিকপ্টার মাথার উপর চক্কর দিয়েছিল এ জায়গাকে ঘিরেই।

বাঘর সম্ভাব্য তাণ্ডব ঠেকাতে বাংলাদেশের সমস্ত নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক অবস্থান নিয়ে ফেলেছে স্থানটিকে ঘিরে। মনে হচ্ছে কোন বলিউডি ছবির শ্যূটিং হচ্ছে। বাঘ এ পর্যন্ত কোন নিরীহ মানুষকে থাবা বসায়নি। তাই রক্ষে। নতুবা এতক্ষণে এখানে ওখানে অনেক মানুষ আহত হয়ে পড়ে থাকত।

বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াড বাঘটিকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে ট্রাংকুলাইজার গান নিয়ে কর্তৃপক্ষের একটি দল ঘটনাস্থলে আসল এই মাত্র। একান্ত বাধ্য না হলে বাঘটিকে গুলি করা হবে না। দূর থেকে ইনজেকশনের মতো ছুঁড়ে বাঘটিকে অচেতন অবস্থায় ধরতে হবে। সামান্য একটি বাঘের তাণ্ডবে সবার আতঙ্ক দেখে আমার খুব আমোদ হচ্ছে।

আমি দশ মাত্রার দৃষ্টি মেলে বাঘের কাণ্ডকারখানা দেখছি আর উপভোগ করছি। আমি বাঘটির গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখছি। বাঘটি পলাশী বাজার লাগোয়া ফুটপাথের তাণ্ডব শেষ করে পলাশী-নীলক্ষেত রাস্তার এপাশটাতে ছুটে এসেছে। ইডেন কলেজের পেছনের এই দেওয়াল ঘেঁষে কতগুলো ছিন্নমূল পরিবার ফুটপাথেই বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বসত করে থাকে। দিনের বেলায় কাঁথা-বালিশ গুটিয়ে ফুটপাথের একপাশে রেখে ফুটপাথেই রান্না করে খায় দায় এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে শুয়ে থাকে।

বাঘের আগমনে নিমিষেই আণ্ডা বাচ্চাসহ লোকগুলো সব উধাও। যেন ঢাকা শহর থেকে বস্তি সরিয়ে ফেলার ক্রাশ প্রোগ্রাম চলছে যেমন চলেছিল ত্ত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম দিকে। আরে! আরে! বাঘটি এবার আরও ভয়ংকরভাবে থাবা বের করে মানুষ চাপা দিয়ে মেরে ফেলা গাড়িটির কাছে ছুটে যাচ্ছে। গাড়ীর ভেতর বসে থাকা আতঙ্কিত মুখগুলো আমি দেখতে পাচ্ছি। এক্সিডেন্ট ঘটানোর পরপরই ড্রাইভার দরজা খুলে জান নিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু দামী এই প্রাইভেট কারে তুলতুলে দেহ নিয়ে বসে থাকা আরোহীগুলা বাঘের ভয়ে গাড়ি থেকে বের হয়নি। গ্লাস তুলে দিয়ে গাড়ির ভেতরটাকেই তারা নিরাপদ মনে করেছে। আরেকটা কারণে গাড়ি ছেড়ে যেতে পারছে না লোকগুলো। আমার স্ক্যানিং মেশিনে ধরা পড়ছে গাড়ীর ভেতরে আছে ব্রিফকেস ভর্তি কুচকুচে কালো টাকা। টাকার মায়া ছেড়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে জ্বলজ্যান্ত বাঘের মুখে পড়তে চায় না কেউ।

প্রচণ্ড আক্রোশে বাঘ গাড়ির গ্লাসে থাবা বসিয়ে দিল। প্রচণ্ড শক্তিতে আছড়ে পড়া বাঘের থাবার আঘাতে গাড়ির উইন্ড স্ক্রীণ ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গাড়ির ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ভয়ে আতঙ্কে আরোহীদের চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। ওয়ান ইলেভেনের পর অনেকের মুখে আমি এই আতঙ্ক দেখেছি। একেকটি আতঙ্কিত মুখকে আমার কাছে একেকটি দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীর মুখ বলে মনে হল।

গাড়িতে বসে থেকে বাঘের কামড়ে জান খোয়ানোর চেয়ে এই দামী গাড়ি ফেলে জান নিয়ে পালানোই মঙ্গল মনে করে আরোহীরা দরজা খুলে পড়িমড়ি করে দৌড়। তাদের দৌড় দেখে ওয়ান ইলেভেনের পরে আমার সেই ঐতিহাসিক উক্তিটির কথা মনে পড়ে যায়- দুষ্ট লোকেরা সব পালিয়েছে। দামী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটি রাস্তায় পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে রইল। ওয়ান ইলেভেনের পর দুষ্ট লোকেরা এরকম অনেক গাড়ি জানের মায়ায় রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়েছিল। গাড়ির চাকার নিচে চিঁড়ে চ্যাপ্টা সেই লাশটি এখনও সেভাবেই পড়ে আছে।

এরকম দামী গাড়ি কিনতে গিয়ে দুষ্ট লোকেরা কতজনের জীবনকে চাপা দিয়ে মেরেছে কে জানে! প্রায় দুই ঘন্টা ধরে বাঘটি তাণ্ডব চালিয়ে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সমস্ত আক্রোশ দিয়ে বাঘটি গাড়ির গ্লাসে থাবা বসিয়েছিল। বাঘের থাবায় গাড়ির সামনের গ্লাস ভেঙ্গে চৌচির। সেই সাথে বাঘের থাবাও ধারালো কাচে কেটেকুটে একাকার। বুলেটের ন্যয় ছুটে আসা ধারালো কাচের টুকরার আঘাতে বাঘের শরীর রক্তাক্ত।

বাঘের থাবা থেকে, শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে গাড়ির চাকার তলে চাপা পড়া থেঁতলে যাওয়া লোকটির রক্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। বাঘটি ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে। এই সুযোগে দূর থেকে ট্রাঙ্কুলাইজার গান দিয়ে একটি ইনজেকশন ছুঁড়ে মারা হল। বাঘের পশ্চাদ্দেশে গিয়ে অব্যর্থ নিশানায় এটি বিদ্ধ হল। বাঘের শরীর থেকে প্রচুর রক্ষক্ষরণ হয়ে বাঘটি এমনিতেই দূর্বল হয়ে আছে।

ক্লান্ত হয়ে বাঘটি পরিত্যাক্ত মার্সিডিজ বেঞ্জের বনেটের উপরই লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়ল। সামনে ছড়ানো থাবা দুটো গুটানো। বাঘের একেক থাবায় নাকি ২৩ জন শক্তিশালী পুরুষের চেয়েও বেশি শক্তি থাকে। ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়া বাঘটির দেহে একজন শিশুদেহের শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। বলতে গেলে বাঘটি এখন বন্দী।

বন্দী বাঘটিকে এখন আমার কাছে নখ দন্তহীন নির্জীব বাঘের মতোই মনে হচ্ছে। দুই ঘন্টা আগের সেই ভয়ংকর রূপ আর বাঘটির মাঝে অবশিষ্ট নেই। নখ দন্তহীন নির্জীব বাঘটির করুণ দশা দেখে আমার দুদকের কথা মনে পড়ল। দুই বছর বাঘের হুংকার ছেড়ে দুদকের এখন করুণ দশা। ট্রাঙ্কুলাইজার প্রয়োগের মাধ্যমে দুদকও এখন রাজনৈতিক খাঁচায় বন্দী।

নিরাপত্তা বাহিনীর সবাই মিলে বাঘটিকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে ফেলেছে। ট্রাকে করে বিশাল এক খাঁচা আনা হয়েছিল। এবারের নির্বাচনে ব্যবহৃত ভোটের বাক্সের মতো দেখতে স্বচ্ছ খাঁচা। রশি দিয়ে বাঘটির আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে খাঁচায় ঢোকানো হয়েছে। খাঁচার ভিতর লেজগুটিয়ে পরে থাকা বাঘটিকে ঘিরে উৎসুক জনতার মিছিল জড়ো হয়েছে।

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে বন্দী বাঘটিকে দেখে। গাড়ির ভেতর ফেলে যাওয়া কুচকুচে কালো টাকার মালিকেরা ফিরে এসেছে গাড়িটি নিয়ে যেতে। বাঘটিকে ঘিরে তারা পরস্পর বলাবলি করছে- হু! আমাদের ভয় দেখানো? এতক্ষণে উচিত সাজা হয়েছে। যাও বাবা এবার খাঁচায় বন্দী থেকে বাকি জীবন কাটিয়ে দাও। ট্রাকের উপর বাঘবন্দী খাঁচাটিকে তোলা হয়েছে।

প্রদর্শনীতে রাখার মতো করে খাঁচাটিকে ট্রাকের উপর রাখা হয়েছে। আস্তে আস্তে ট্রাক চলছে। সেই সাথে চলছে কৌতুহলী জনতার মিছিল। ফায়ার ব্রিগেড, আর্মি, পুলিশ, র‌্যাবের গাড়ি সব বাঘ বহনকারী ট্রাকের সামনে পেছনে কর্ডন দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার দুটিও উপর থেকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

এক রাজকীয় প্রস্থান ঘটছে বাঘটির কিন্তু এটির এখন আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। আমার মনে পড়ে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে দুদককেও শক্তিহীন করে ফেলার প্রক্রিয়া চলছে। নখ দন্তহীন দুনীতি দমন কমিশন করা হচ্ছে দুদককে। আমি দুদকের এক হতাশাজনক প্রস্থান দেখছি বাঘের প্রস্থানকে কেন্দ্র করে। এই সময়টুকুতে দুদক সংক্রান্ত এক সংবাদ আমার স্থায়ী মেমোরিতে এসে জড়ো হয়... ============================================= শেষ পর্যন্ত দুদককে (দুর্নীতি দমন কমিশন) সত্যি সত্যিই দন্তহীন বাঘে রূপান্তর করা হচ্ছে।

দুর্নীতি দমনে দুদকের গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষমতা কাটছাঁট করে বুধবার দুদক আইন-২০০৪ সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। দুদকের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটির সভার সরকারি কর্মকর্তারা তাদের প্রস্তাবে অনড় থাকেন। উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে দুদককে রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থেকে জবাবদিহি করতে হবে। মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে সরকার প্রধানের অনুমোদন নিতে হবে। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে সরকারি কমিটির সুপারিশকে অনুমোদন দেয়া।

দুদকের সচিব হবেন প্রিন্সিপাল একাউন্টিং অফিসার। যার মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে দুদকের যোগাযোগ রক্ষা হবে। আইন ও বিধিগত অনুমোদন ছাড়া দুদক ইচ্ছে করলেই যে কোন সময় যে কোন অফিসের নথিপত্র চাইতে বা নিতে পারবে না। ফাঁদ পেতে ঘুষ-দুর্নীতি ধরার নামে সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা যাবে না। এছাড়া কেউ দুদক বা দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক অন্যায়ভাবে হয়রানি বা ক্ষতির শিকার হলে সে বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণপূর্বক ৩ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।

দুদক আইন সংশোধনে সরকারি কমিটির এ সুপারিশ নীতিগত অনুমোদনের জন্য শিগগির মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার পর তা সংসদে যাবে। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ============================================= চলবে... ওয়ান ইলেভেন (ষষ্ঠ পর্ব) ওয়ান ইলেভেন (পঞ্চম পর্ব) ওয়ান ইলেভেন (চতুর্থ পর্ব)
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.