আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতন্ত্রের স্বরূপ

আমি খুব সাধারণ। ব্লগে নতুন। আপাতত ব্লগ পড়ছি। এখনো লেখার হাত হয়নি। আপনাদের সহোযোগিতা চাই।

ধন্যবাদ

আমার খুব প্রিয় একজন কলামিষ্ট এবনে গোলাম সামাদ। তার একটা লেখা সামুর পাঠকদের জন্য দিলাম আশা করি সবার ভালো লাগবে। গণতন্ত্রের স্বরূপ -এবনে গোলাম সামাদ গণতন্ত্রের শিকড় আসলে বহু দূরে প্রোথিত। যেসব জাতি অথবা উপজাতিকে ‘আদিম’ বলে মনে করা হয়, তাদের অনেকের মধ্যে দেখা যায় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে। আলোচনায় অংশ নেন প্রধানত বয়স্ক ব্যক্তিরা।

কারণ ধরে নেয়া হয়, তাদের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা তরুণদের চেয়ে বেশি। অনেক আদিম প্রজাতির মধ্যে সরকারপ্রথা বিদ্যমান আছে। আর এই সরকার নির্বাচিত হন বয়স্কদের সম্মতির মাধ্যমে। গণতন্ত্রের গোড়ার কথা হলো, সমাজ শাসিত হতে হবে সামাজিক সম্মতির মাধ্যমে। আমাদের ভাষার ‘সভা-সমিতি’ শব্দগুলো যথেষ্ট প্রাচীন।

সভা-সমিতি শব্দগুলোর সাথে গণতন্ত্রের ধারণার সংযুক্তি হলো কাছের। আরবদের মধ্যে একধরনের গণতন্ত্রের ধারণা প্রচলিত ছিল। সেটা ছিল কতকটা জির্গা প্রথার মতো। কুরআন শরিফে আমরা দেখতে পাই, বলা হচ্ছে, সমস্ত গুরুতর ব্যাপারে, আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে (সূরা-৪২ঃ৩৮)। যাযাবর বেদুইনদের মধ্যেও ছিল গণতান্ত্রিক মনোভাব।

আধুনিক গণতন্ত্রের অনেক দিক আছে। ভোটের ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে জটিল। কারণ, মানুষ এখন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসবাস করে না। বাস করে বিরাট জনসমষ্টি হিসেবে। আর এ সমাজে ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হতে হলে দরকার হয় জটিল ভোট ব্যবস্থাপনার।

যে গণতন্ত্রকে আমাদের দেশে অনুসরণ করতে চাচ্ছি, তার ভিত্তি হলো জনমত, রাজনৈতিক দল, আর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এই গণতন্ত্রের একটা বৈশিষ্ট্য হলো­ একদল সরকার গড়ে। তারা হয় সরকারি দল। আর অন্যরা সরকারবিরোধী দল। বিলাতে চলে আসছিল দুই দলীয় গণতন্ত্র।

একদল নির্বাচনে জিতে গড়ত সরকার। আরেক দল করত সে সরকারের বিরোধিতা। কিন্তু এবারে বিলাতের নির্বাচনে গড়তে হলো দু’টি দল মিলে কোয়ালিশন সরকার। এটা বিলাতের গণতন্ত্রে একটি বিরাট ব্যতিক্রম। ইতঃপূর্বে এরকম ঘটনা ঘটেনি।

বিলাতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের স্বার্থেই তারা গড়েছেন কোয়ালিশন সরকার। দেশ চালানো তাদের লক্ষ্য। বিলাতের রাজনীতিতে সব কিছু আগের মতোই আছে। আছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আছে জনমত পোষণের অধিকার।

আছে রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বিলাতের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ। কেউ উঠাচ্ছে না নির্বাচনে কোনো কারচুপির অভিযোগ। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে আমরা এ রকম কথা বলতে পারছি না।

‘আইনের শাসন’ কথাটা আমরা পেয়েছি বিলাতের কাছ থেকে। বিলাতে বিচারব্যবস্থা বাস্তবে ভোগ করে বিরাট স্বাধীনতা, যদিও পার্লামেন্টকে তা ডিঙিয়ে যেতে পারে না। কারণ বিলাতের কোনো লিখিত সংবিধান নেই, আর পার্লামেন্ট হচ্ছে সার্বভৌম সরকার। একমাত্র যুদ্ধের সময় ছাড়া বিলাতে সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের ওপর কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের দেশে আর যা-ই হোক, সংবাদপত্রকে স্বাধীন বলা যায় না।

সংবাদপত্রকে চলতে হচ্ছে সরকারের নির্দেশে। একটি অতি জনপ্রিয় পত্রিকা অত্যন্ত কূটকৌশলে বন্ধ করে দেয়া হলো। ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেক পত্রিকার ভাগ্যেই এমন কিছু ঘটতে পারে। আমরা এই আশঙ্কার কথা ভেবে হয়ে উঠেছি শঙ্কিত। মনে পড়ছে, ১৯৭৫ সালের কথা।

সে সময়ের আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র চারটি সরকারি পত্রিকা চালু রেখে বাদবাকি সব ক’টি সংবাদপত্রকে করেছিল নিষিদ্ধ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। এটা তার একটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য। জানি না, তার এই বিশেষতা এবার কতটা প্রকট রূপ নেবে অথবা নিতে পারবে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতায়।

আমরা মনে করি, মত প্রকাশের স্বাধীনতাই গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তিভূমি। বর্তমান সরকার পার্লামেন্টে এখন খুবই সংখ্যাগরিষ্ঠ। একটা বিশেষ পত্রিকা তাদের জনপ্রিয়তাকে ক্ষুণ্ন করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল বলে মনে হয় না। আমরা পত্রিকার ভেতরের ব্যাপার জানি না। কোনো নতুন প্রকাশক এসে যদি পত্রিকাটি প্রকাশ করতে চান, তবে সেটা করতে দিলে আইনের খেলাপ হবে বলে মনে হয় না।

আমার মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালে সংবাদপত্র বন্ধ করার পর প্রায় পাঁচ শ’ সাংবাদিক মিটিং করে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তেমন কিছু ঘটল না। পত্রিকা বন্ধ করার সমালোচনা করেছেন প্রায় সব মত ও পথের সাংবাদিকই। সে দিনের থেকে আজকের পরিস্থিতি অনেক ভিন্ন। এই বাস্তবতার নিরিখেই বিবেচনা করে দেখা উচিত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি।

মানবজীবনে কোনো ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা সীমাহীন হতে পারে না। তর্কশাস্ত্রে বলে, স্বাধীনতাকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। আলোচ্য পত্রিকাটি দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত ছিল বলে আমরা জানি না। তবে এর মতামত অনেক পত্রিকা থেকে ছিল ভিন্ন। কিন্তু এই ভিন্নতার জন্য একে শাস্তি দেয়ার অর্থ হলো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা।

পত্রিকাটি আসলে কোনো এক ব্যক্তির মালিকানাধীন ছিল না। পত্রিকাটি আসলে ছিল একটি কোম্পানির। এই কোম্পানির শেয়ারের একটা বড় অংশ অবশ্য ছিল এক ব্যক্তির। কিন্তু তাই বলে পত্রিকাটির সব শেয়ারই তার নিজের ছিল না। কোম্পানি আইনানুসারে পত্রিকাটি তাই বন্ধ করে দেয়া যায় কি না; সেটাও হওয়া উচিত বিশেষ বিচার্য।

বিচারকার্য সম্পাদিত হওয়া উচিত কোম্পানি আইনানুসারে। কিন্তু সেটা এ ক্ষেত্রে করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। আইনের মধ্যে থাকছে যেন একটা বড় রকমের ফাঁক। অবশ্য সেটা বিচার করে দেখার অধিকার আছে কেবল বিচার বিভাগেরই। তবে ‘জনমত’ বলেও একটা কথা আছে।

আর কথা আছে জনগণের সার্বভৌমতার। জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তুললে একপর্যায়ে আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। তার জায়গায় আসে নতুন আইনের শাসন। রাজনীতিতে ‘লোকায়ত সার্বভৌমত্ব’ (চড়ঢ়ঁষধৎ ঝড়াবৎবরমহঃু) কথাটিও বিশেষভাবে মনে রাখার মতোই। এটা মনে না রাখার কারণে এ দেশে ঘটতে পেরেছে অনেক রক্তপাত।

দেখা দিয়েছে ভয়াবহ সঙ্ঘাত। আমরা চাই না সঙ্ঘাতের পথে চলতে। কিন্তু গণতন্ত্র চরম অবস্থায় অকার্যকর হয়ে পড়ে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে। বিগত নির্বাচন কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল, তা নিয়ে জনমনে ইতোমধ্যেই জেগে উঠেছে বিরাট সন্দেহ।

এই সন্দেহ নিকট ভবিষ্যতে আরো ঘনীভূত হওয়া সম্ভব। গণতন্ত্রে কোনো দল চিরদিন ক্ষমতায় থাকে না। দশ বছর পর বিলাতে লেবার পার্টিকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। কিন্তু ক্ষমতার এই হস্তান্তর হতে পারল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে, যা হওয়া উচিত আমাদের অনুকরণীয়। গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট হয়ে ওঠে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

সব গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে দিয়ে থাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হতে পারছে না। রাজনীতি নেমে আসছে রাজপথে। ক্ষমতাসীন দল যদি এ বিষয়ে সচেতন না হয়, হবে গৃহবিবাদ যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে একটা চরম পর্যায়ে। নানা রকম শক্তি কাজ করছে দেশের মধ্যে, যারা শক্তি সঞ্চয় করে বিপ্লবের মাধ্যমে চাইতে পারে ক্ষমতার অধিকার।

বাংলাদেশ একটা মুসলিম অধুøষিত দেশ। যাকে বলা হচ্ছে, র্যাডিক্যাল ইসলাম বা জঙ্গি ইসলাম, বাংলাদেশে এখনো তা যথেষ্ট সতেজ নয়। কিন্তু যদি পরিস্থিতিকে এমন করে তোলা হয় যে, এ দেশের মুসলিম জনসমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তবে র্যাডিক্যাল ইসলাম এ দেশেও উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। কথাটা মনে আসছে এ কারণে যে, আমার দেশ পত্রিকার সাথে কেউ কেউ র্যাডিক্যাল ইসলামের যোগসূত্র দেখাচ্ছেন। অথচ আমাদের জানা মতে, পত্রিকাটি অনুসরণ করত উদার ইসলামী মানবতন্ত্রী ধ্যান-ধারণাকে।

আমার দেশ পত্রিকা অনুসরণ করছিল­ যাকে বলে মধ্যপন্থী (গসনপড়থয়প) ইসলাম, জঙ্গিবাদী ইসলাম নয়। আমরা কথা শুরু করেছিলাম গণতন্ত্রের স্বরূপ নিয়ে। একমাত্র প্রকৃত গণতন্ত্রই পারে সব ধরনের চরমপন্থাকে এড়িয়ে সাধারণ সম্মতির মাধ্যমে দেশ চালাতে। লেখকঃ প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।