আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিডিয়ার শত্রু খোঁজা



মিডিয়ার শত্রু খোঁজা শওগাত আলী সাগর সমাজ এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা কতগুলো গোড়া এবং মৌলবাদী চিন্তার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি। সেই চিন্তাটা অবাধ ও স্বাধীন মিডিয়ার প্রধানতম বা গুরুত্বপূর্ণ যে শত্রু তাকে সুকৌশলে আড়াল করে রাখে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকার একটা বড় বাধা সে ব্যাপারে সম্ভবত দ্বিমত করার বা তর্ক করার লোক পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মতো পশ্চাদপদ একটি দেশে যেখানে রাজনীতিকদের অধিকাংশই পড়াশুনা না করা মানুষ ( ডিগ্রী কিংবা সার্টিফিকেট অর্জন অর্থে নয়),মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারগুলোতে তারাই বসেন, তারা মিডিয়াকে তাদের প্রচারের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবেনই। তার অন্যথা হলে মিডিয়ার উপর খড়কহস্ত হয়ে তেড়ে আসবেন তাতে আর নতুনত্ব কি ? কিন্তু মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ হিসেবে আরো একটি প্রভাবশালী শক্তি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে, সেটি হচ্ছে ব্যবসায়ী সমাজ।

মিডিয়া ওয়াচে ফাহমিদুল হক মিডিয়ার প্রধানতম এই শত্রুটিকে আলোচনায় টেনে এনেছেন। সেই জন্যে তাকে ধন্যবাদ। বলে ন্ওেয়া ভালো, মিডিয়্ওায়াচে ফাহমিদুলের বিশ্লেষনাত্মক লেখাটা পড়ে দূর প্রবাসে বসেও খানিকটা প্রতিক্রিয়া হয়। সেই প্রতিক্রিয়াগুলোকেই একসূতোয় গেথে রাখার প্রয়াস থেকেই এই লেখার সূচনা। ঢাকার একটি প্রভাবশালী বাংলা দৈনিকে দীর্ঘদিন বিজনেস এডিটর হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার।

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ইকোনোমিক এডিটর হিসেব্ওে কাজ করেছি। ফলে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া - দুটি ক্ষেত্রেই মিডিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়ী শিল্পপতি সম্প্রদায়ের সম্পর্কের টানাপড়েন দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যেহেতু সেই অর্থে মাটি খুড়ে দুর্নীতি খোঁজার মতো সাংবাদিকতা শুরু হয়নি এখনো , ফলে তাদের আপোষ টাপোষের দিকে খুব একটা যেতে হয়না । পুঁজির ভাগ নিজেদের অনুকূেল টেনে আনতে তোষামোদির প্রায় সবটুকুই তাদের করতে হয় মাত্র। এখন পর্যন্ত ইলেকট্রনিক মিডিয়া শহরের ”চলমান নানা ঘটনাবলীর ধারাবিবরনী” প্রচারনার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমিত রেখেছে।

সত্যিকার অর্থে সাংবাদিকতা চর্চ্যার মধ্যে তারা এখনো প্রবেশ করে নি। ফলে মিডিয়ার স্বাধীনতা ও কিংবা ঝুঁকির আলোচনায় তাদের অংশীদারিত্ব খুবই কম। অবশ্য মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং টক শো নামের প্যাচাল পারার অনুষ্ঠানগুলো তাদের খানিকটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা “তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হইবো কেন”- জাতীয় রাজনৈতিক সরকারের মানসিকতা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্যে নতুন বিপদের উপসর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে মিডিয়ার ঝুঁকি বিষয়ক সামগ্রিক আলোচনায় প্রিন্ট মিডিয়ার অংশীদারিত্বই সর্বাধিক।

কোনো পত্রিকার ইকোনোমিক রিপোর্টারকে যদি সম্পাদক মহোদয় বলে দেন অর্থমন্ত্রীকে কোনোভাবেই চটানো যাবে না, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর আমাদের বন্ধু মানুষ,্ওই রিপোর্টারের রিপোর্ট করার আর কোনো জায়গা থাকে, বলুন তো ? অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার প্রধান দুটি চারণভূমি হচ্ছে অর্থমন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই দুটি মূখ্য প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে পত্রিকা অফিস থেকে আনুষ্ঠানিক “এডভাইজারী” জারি হবার পর কোনো রিপোর্টার কি আর ওমুখো হবেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্যে। দূর্মুল্যের বাজারে চাকরীর মায়া নেই এমন সাংবাদিক কি আদৌ আছেন ? আর বেসরকারি খাত? মানে ব্যবসায়ী শিল্পপতি সম্প্রদায় ? হায় আল্লাহ!! তাদের ব্যাপারে তো লিখিত অলিখিত কতো কিছুই একজন রিপোর্টারকে মাথায় রাখতে হয়। বিজ্ঞাপনদাতা, মালিকপক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, বন্ধবান্ধব,সম্পাদকের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান সম্পাদকের খাতিরের লোক এভাবে তালিকা করার পর একজন রিপোর্টারের রিপোর্ট করার জায়গা থাকে কোথায়? লক্ষ্য করবেন, এখানে কিন্তু সরকারের কোনো ভূমিকা নেই, পত্রিকা নিজেই তার রিপোর্টারের হাত পা বেধে দিলো। মিডিয়া নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ফাহমিদুল হক একটি বড় বিষয়ই অনুল্লেখ রেখেছেন।

অন্য যে কোনো খাতের মতোই মিডিয়ারও সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য থাকে। একটা সময় ছিলো মিডিয়া বিশেষ বিশেষ দর্শনকে লালন করতো, লালন করতো আদর্শ। লক্ষ্য বা আদর্শকে ভিত্তি করেই বিকশিত হতো মিডিয়ার কার্যক্রম। কিন্তু এখন কি সেই অবস্থা আর আছে? ”নিউজ পেপার ইজ এ বিজনেস”- বড় বড় হাউজগুলোতেই যখন মন্ত্রের মতো করে মিডিয়াকর্মীদের কানে এই বাণী তুলে দ্ওেয়া হয় তখন মিডিয়ার জন্যে ঘরের বাইরে শত্রু খোঁজা আর অন্ধকারে কালো বেড়াল খোঁজার মধ্যে তফাৎ কি? কর্পোরেট পুঁজি মিডিয়ায় লগ্নী হবার পর থেকেই তো আদর্শকে বিতাড়িত করে খবরকে পণ্য বানানোর জোড় প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। তখন সাংবাদিকের ঝুঁকি কিংবা মিডিয়ার স্বাধীনতার শত্রু খুঁজতে অন্য কোথ্ওা যেতে হয় না।

মিডিয়াই তখন হয়ে দাড়ায় মিডিয়ার বড় শত্রু। মিডিয়া মালিকদের ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্ধে মিডিয়া ব্যবহৃত হ্ওয়ার কথা ফাহমিদুল তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। এই প্রবণতা যে কেবল মিডিয়ার স্বাধীনতাকেই ক্ষুন্ন করছে তা তো নয়, মিডিয়াকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। নিজেরা অকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থেকে কোনো মিডিয়া স্বাধীনভাবে সাহসিকতার সঙ্গে সামাজিক অনাচার কিংবা রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এটা ভাবা এবং বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে কিন্তু রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নেই,মিডিয়া নিজেই নিজের গ্রহনযোগ্যতা নষ্ট করছে।

শুধু কি মালিক ? সাংবাদিকরা নিজেরাকি নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট এবং প্রশ্নবিদ্ধ করছেন না। প্রথম আলো যখন এক ভ- পীরের কাহিনী নিয়ে রিপোর্ট করলো তখন আর দশটা পত্রিকার সাংবাদিক উঠে পড়ে লেগে গেলেন ওই রিপোর্টকে মিথ্যা প্রমানের জন্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওই সব রিপোর্টে কেউ কিন্তু নতুন এমন কোনো তথ্য উপস্থাাপন করেন নি যা দিয়ে নিশ্চিত হ্ওয়া যায় ওই পীর আসলে একজন ভালো মানুষ। বরং রিপোর্টগুলোতে দেখেছি প্রথম আলোর রিপোর্টারের প্রতি সাড়াশি আক্রমন। টরন্টোর অনলাইন বাংলা পত্রিকা নতুনদেশ ডটকম ঢাকার কবিনামধারী কয়েকজন প্রতারকের ফেইসবুক প্রতারনা নিয়ে রিপোর্ট করার পর প্রতারকদের পক্ষ নিয়ে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোয় নেমে পড়ে ঢাকার তিনজন সাংবাদিক।

তাদের দুইজনই আবার সমকালে চাকরী করেন। লক্ষ্য করবেন, প্রতারকদের পক্ষে কথা বলতে কোনো কবি এগিয়ে আসেননি, কবি এবং অন্য পেশার লোকগুলো বরং সাহস এবং সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়ে নতুনদেশকে উৎসাহ দিয়েছেন। আর প্রতারকদের পক্ষে দাড়িয়ে পত্রিকার বিরুদ্ধে,সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত এবং অশোভন আক্রমন করে দু হাতে কলম চালাতে লাগলেন সংবাদপত্রেরই গিুটি কয়েক লোক। এই যখন অবস্থা তখন সরকার কিংবা অন্যকোনো স্থানে মিডিয়ার শত্রু খুঁজে লাভ কি? দীর্ঘদিন মিডিয়ায় চাকরী করার কারনেই পশ্চিমা মিডিয়ার নানা দিকে নজর পড়ে। এই কানাডায়ইতো দেখেছি মিডিয়াগুলোর মধ্রে কি তীব্র ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা? কিন্তু যখন কোনো একটি পত্রিকা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তখন বাদবাকি সব মিডিয়াই তার পাশে এসে দাড়িয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে।

মিডিয়াওয়াচের সম্পাদক অনুমতি দিলে হয়তো সে সব বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে লেখা যাবে। টরন্টো। Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।