আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে

বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।

(স্পেনের বিপ্লবী কবি ফেডারিকো গার্সিয়া লোরকা (জীবনকাল ৫ জুন ১৮৯৮- ১৯ আগস্ট ১৯৩৬) ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক। . গার্সিয়া লোরকা “প্রজন্ম ‘২৭” এর একজন প্রতীক-প্রতিম সদস্য হিসাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। স্পেনের গৃহ যুদ্ধের (১৭ই জুলাই ১৯৩৬- ১লা এপ্রিল ১৯৩৯) )শুরুতে আরো অনেকের মতো তিনিও নিখোঁজ হন।

মনে করা হয় যে, ১৯ শে আগস্ট ১৯৩৬ সালে ন্যাশনালিস্ট মিলিশিয়া বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর। বিপ্লবী এই কবিকে নিয়ে পৃথিবীর বহু ভাষায় অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে বিখ্যাত এই কবিতাটি রচনা করেন। ) কবির মৃত্যু : লোরকা স্মরণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দু’জন খসখসে সবুজ উর্দিপরা সিপাহী কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছ কেন? সিপাহী দু’জন উত্তর দিল না; সিপাহী দু’জনেরই জিভ কাটা।

অস্পষ্ট গোধুলি আলোয় তাদের পায়ে ভারী বুটের শব্দ তাদের মুখে কঠোর বিষণ্নতা তাদের চোখে বিজ্ঞাপনের আলোর লাল আভা। মেটে রঙের রাস্তা চলে গেছে পুকুরের পাড় দিয়ে ফ্লোরেসেন্ট বাঁশঝাড় ঘুরে- ফসল কাটা মাঠে এখন সদ্যকৃত বধ্যভূমি। সেখানে আরও চারজন সিপাহী রাইফেল হাতে প্রস্তুত তাদের ঘিরে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ কেউ এসেছে বহু দূরের অড়হর ক্ষেত থেকে পায়ে হেঁটে কেউ এসেছে পাটকলে ছুটির বাঁশি আগে বাজিয়ে কেউ এসেছে ঘড়ির দোকানে ঝাঁপ ফেলে কেউ এসেছে ক্যামেরায় নতুন ফিল্ম ভরে কেউ এসেছে অন্ধের লাঠি ছুঁয়ে ছুঁয়ে জননী শিশুকে বাড়িতে রেখে আসেননি যুবক এনেছে তার যুবতীকে বৃদ্ধ ধরে আছে বৃদ্ধতরর কাঁধ সবাই এসেছে একজন কবির হত্যাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে। খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো কবিকে, তিনি দেখতে লাগলেন তাঁর ডান হাতের আঙুলগুলো- কনিষ্ঠায় একটি তিল, অনামিকা অলঙ্কারহীন মধ্যমায় ঈষৎ টনটনে ব্যথা, তর্জনী সঙ্কেতময় বৃদ্ধাঙ্গুলি বীভৎস, বিকৃত- কবি সামান্য হাসলেন, একজন সিপাহীকে বললেন, আঙুলে রক্ত জমে যাচ্ছে হে, হাতের শিকল খুলে দাও! সহস্র জনতার চিৎকারে সিপাহীর কান সেই মুহূর্তে বধির হয়ে গেল। জনতার মধ্য থেকে একজন বৈজ্ঞানিক বললেন একজন কসাইকে, পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়ছে, ততই মুর্গী কমে যাচ্ছে।

একজন আদার ব্যাপারী জাহাজ মার্কা বিড়ি ধরিয়ে বললেন, কাঁচা লঙ্কাতেও আজকাল তেমন ঝাল নেই! একজন সংশয়বাদী উচ্চারণ করলোন আপন মনে, বাপের জন্মেও এক সঙ্গে এত বেজম্মা দেখিনি, শালা! পরাজিত এম এল এ বললেন একজন ব্যায়ামবীরকে, কুঁচকিতে বড় আমবাত হচ্ছে হে আজকাল! একজন পকেটমারের হাত আকস্মাৎ অবশ হয়ে যায় একজন ঘাটোয়াল বন্যার চিন্তায় আকুল হয়ে পড়ে একজন প্রধানা শিক্ষয়িত্রী তাঁর ছাত্রীদের জানালেন প্লেটো বলেছিলেন… একজন ছাত্র একটি লম্বা লোককে বললো, মাথাটা পকেটে পুরুন দাদা! এক নারী অপর নারীকে বললো, এখানে একটা গ্যালারি বানিয়ে দিলে পারতো… একজন চাষী একজন জনমজুরকে পরামর্শ দেয়, বৌটার মুখে ফোলিডল ঢেলে দিতে পারো না? একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলে, রক্তপাত ছাড়া পৃথিবী উর্বর হবে না। তবু একজন সম্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, এ তো ভুল লোককে এনেছে। ভুল মানুষ, ভুল মানুষ। রক্ত গোধূলির পশ্চিমে জ্যোৎস্না, দক্ষিণে মেঘ বাঁশবনে ডেকে উঠলো বিপন্ন শেয়াল নারীর অভিমানের মতন পাতলা ছায়া ভাসে পুকুরের জলে ঝুমঝুমির মতন একটা বকুল গাছের কয়েকশো পাখির ডাক কবি তাঁর হাতের আঙুল থেকে চোখ তুলে তাকালেন, জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখা ও অক্ষর থেকে রক্তমাংসের সমাহার তাঁকে নিয়ে গেল অরণ্যের দিকে ছেলেবেলার বাতাবি লেবু গাছের সঙ্গে মিশে গেল হেমন্ত দিনের শেষ আলো তিনি দেখলেন সেতুর নিচে ঘনায়মান অন্ধকারে একগুচ্ছ জোনাকি দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হলো চুল, তিনি বুঝতে পারলেন সমুদ্র থেকে আসছে বৃষ্টিময় মেঘ তিনি বৃষ্টির জন্য চোখ তুলে আবার দেখতে পেলেন অরণ্য অরণের প্রতিটি বৃক্ষির স্বাধীনতা- গাব গাছ বেয়ে মন্থরভাবে নেমে এলো একটি তক্ষক ঠিক ঘড়ির মতন সে সত বার ডাকলো : সঙ্গে সঙ্গে ছয় রিপুর মতন ছ’জন বোবা কালা সিপাহী উঁচিয়ে ধরলো রাইফেল- যেন মাঝখানে রয়েছে একজন ছেলেধরা এমন ভাবে জনতা ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ইনকিলাব জিন্দাবাদ! কবির স্বতঃপ্রবৃত্ত ঠোঁট নড়ে উঠলো তিনি অস্ফুট হৃষ্টতায় বললেন : বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মানুষের মুক্তি আসুক! আমার শিকল খুলে দাও! কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব! প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল- যেমন যায়, কবি নিঃশব্দে হাসলেন দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ কবি শান্ত ভাবে বললেন, আমি মরবো না! মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না। চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে- কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার নড়ে উঠলো কি উঠলো না কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।

আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন, বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.