আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবির সংকল্প কবির সন্ধান

গত শতাব্দীর মধ্যভাগে এক তরুণ বাঙালি লেখক হেনরি মিলরের কাছে একটি চিঠি লিখে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতার কথা জানতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল, তৃতীয় মহাযুদ্ধোত্তর অস্থির অশান্ত পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন আর কতটুকু কিংবা আদৌ আছে কী? হেনরি মিলর উত্তরে লিখেছিলেন, না, এই মুহূর্তে এই পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের হয়তো আর কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু আজ থেকে অর্ধ শতাব্দী পরে পৃথিবীর মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য হয়ে উঠবে। আমরা এখন রবীন্দ্রনাথকে ঠিক বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারব না, কিন্তু অর্ধ শতাব্দী পরে কিংবা তার আরও পরে ভবিষ্যৎ পৃথিবী রবীন্দ্রনাথের মূল্য উপলব্ধি করতে পারবে। শুনেছি সেই তরুণ বাঙালি বুদ্ধিজীবী তার জিজ্ঞাসার উত্তরে হেনরি মিলরের এই চিন্তার প্রতিফলনে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন। কী আশ্চর্য, তার অর্ধ শতাব্দী পর এই একুশ শতকের পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথ আমাদের কতখানি নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছেন তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি, রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন আমাদের যে কোনো শুভ কর্মের, মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের প্রধান, আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার ভাবুক, আমাদের বিজ্ঞান ভাবনার অন্যতম পথিকৃৎ, আমাদের মনোজগতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অভিভাবক, তার কাছে আমরা যে কোনো বিপদে, ব্যক্তিগত দুর্যোগে শরণাপন্ন হই, তার মুখপানেই তাকাই।

কি করে সম্ভব হলো একজন কবির এত বড় এই মানবিক অর্জন! আমার মনে হয় এর মূল সূত্র হচ্ছে কবির সংকল্প, তার সংকল্পের মধ্যেই নির্দিষ্ট থাকে এই অনাগত ভবিষ্যতের রূপরেখা, সেই সময় উপযোগী আধুনিক চিন্তা ও আধুনিক জীবনদর্শন।

কবিতা শুধু আবেগ নয়। কবিতার মূলে নিহিত থাকে যুক্তি। এই যুক্তিপরম্পরায় কবিতা হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের নির্ণয়, ভবিষ্যতের আত্দবিশ্লেষণ, বিচার। মহাভারতের কবি ব্যাসদেব বহু বছর আগে যে অসামান্য এপিক রচনা করেছিলেন তার সুশৃঙ্খল যুক্তি প্রায় অকাট্য সিদ্ধান্ত সর্বকালে আমাদের চমৎকৃত করে, এমন বহু বাক্য ও পঙ্ক্তি আছে যার কোনো বিকল্প হয় না।

চিন্তার কোনো প্রতিচিন্তা নেই। প্রকৃতপক্ষে এই হচ্ছে কবিতা, বিকল্পহীন, তুলনারহিত, যে যুক্তি শেষ যুক্তি, কবিতা এখানেই বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানই এখানে কবিতা। এই কবিতা রচনার জন্য কবিকে যেমন বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়, সমাজকেও তেমনি এমন কবির জন্য যুগের পর যুগ প্রতীক্ষা করে থাকতে হয়। সেই কবির আগমন ও প্রস্থান পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেয়, পৃথিবীর চিন্তা ও ধারণাকে পাল্টে দিয়ে এক নতুন বোধ ও চিন্তার জাগরণ ঘটায়। এই বোধ জাগরণ ও উন্মোচনের মূলেও থাকে সেই কবির সংকল্প।

এই সংকল্পই কবির ধ্যান, ধ্যানের মধ্য দিয়েই কবি এই সংকল্প আয়ত্ত করেন। কবির সংকল্প কোনো শপথ বাক্য পাঠ নয়। কোনো প্রতিজ্ঞার উচ্চারণ নয়, কোনো অঙ্গীকারের ঘোষণা নয়; এই সংকল্পের মধ্যে থাকে কবির মহত্ত্বম অঙ্গীকার, মহত্ত্বম প্রতীক্ষা, যে প্রতিজ্ঞা একমাত্র কবি ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে গ্রহণ করাই সম্ভব নয়। প্রায় একে মরণপণ বলা যেতে পারে। কবি বাজি রাখেন নিজের জীবন, তাকেই পুড়িয়ে দগ্ধ করে নিঃশেষ করে কবি আহরণ করেন কবিতা।

এই কবিতার মধ্যে যখন যথার্থভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তার সংকল্প, তার ধ্যান, তার চৈতন্যের নির্যাস তখন সেই কবিতা হয়ে ওঠে সমাজের জাগরণমন্ত্র, সমাজের অনন্য অদ্বিতীয় নির্দেশিকা।

মহৎ কবিদের জীবন এমনি পূর্ণ হয়ে ওঠে তার সংকল্পে, তার সংকল্পের দ্যুতি ও মহিমায়। কবি এই সংকল্প স্থির করেন তার তন্ময়তার মধ্যে, তার নিদ্রিত জাগরণের ভিতর। তিনি নিদ্রায়, স্বপ্নে, বিভোরতায় আবিষ্কার করেন এই সত্য, জীবন ও জগতের সত্য। মানুষের জন্য নির্ধারণ করেন এক অমোঘ সত্য, অমোঘ জীবনাচরণ।

কখনো কখনো সমাজের কাছে তা গর্হিত মনে হয়, সমাজ-বহির্ভূত মনে হয় কিন্তু সেই আধুনিক সেই অপ্রচলিত সেই অজ্ঞাত বোধ ও চেতনার জন্ম দেন কবি। এ জন্যই প্রথাগত সমাজ কবিকে ভাবে স্বেচ্ছাচারী, কবিকে এই সমাজ পরিহারও করতে চায়, তাকে গ্রহণ করতে দীর্ঘ সময় লাগে। আর এ জন্যই সম্ভবত প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিকে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন। কবি প্রথাগত সত্যকে পরিত্যাগ করে প্রকৃত সত্যকে স্থাপন করেন, মানুষের বাস্তব ভুল জীবনকে চিনিয়ে দিয়ে যথার্থ স্বপ্ন জীবনের সন্ধান দেন। এখানেই কবির শ্রেষ্ঠত্ব।

এই কাজ কবি ছাড়া আর কেউ পারেন না, দার্শনিক পারেন না, বিজ্ঞানী পারেন না, রাষ্ট্রবেত্তা পারেন না। কিন্তু কবির এই কর্তব্য সাধন, এই সংকল্পের নির্মাণ এক কঠিন কাজ। এই কাজে কবির নিজের জীবন ধ্বংস হয়, আমরা খোঁজ রাখি না যে ঋষিপম রবীন্দ্রনাথেরও জীবন কীভাবে তিলে তিলে ক্ষয় হয়েছিল, কত দুঃখ জমেছিল তার, কত অনুতাপ কত গ্লানি কত পরাজয়; না হলে কেন তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখবেন সেই চিঠি- তার নিজের অসংলগ্নতা অস্বাভাবিকতার কথা, বিচ্যুতি ও অক্ষমতার কথা, কেন বলবেন- কখনো কখনো তার আত্দহত্যা করতে ইচ্ছে করে। মহৎ কবি লেখকেরা এভাবেই জীবনের সার সত্য চিহ্নিত করেছেন, তাতে তার নিজের গোটা জীবন প্রায় ধ্বংস নিঃশেষ হয়েছে। র্যাবো, বোদলেয়ার, ব্লেক, হ্যেল্ডারলিন, মায়াকাভস্কি, দিলানতমাজ, এমনকি সেই দেবশিশুর মতো কান্তিময় কিটসও তো এভাবেই জয় করেছিলেন নিজকে।

মহান কবিরা তাদের সংকল্পের জন্য উৎসর্গ করেন নিজের জীবন, সমস্ত পাপ পতন অপরাধ অপবাদ নিন্দা দুর্ভোগ নিঃগ্রহ মাথায় নিয়ে শুধু রেখে যান কবির সেই সংকল্প, সেই অবিনশ্বর (হয়তো বা অবিনশ্বর নয়ও) কিছু কাব্য পঙ্ক্তি। এভাবেই কবি সমাজের মধ্যে থেকেও যাপন করেন এক বহিঃস্থ জীবন। যে জীবনের কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না, রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত যন্ত্রণাময়।

কবি কোথা থেকে পান এই সংকল্প, এই অনির্দেশ্য এই অলিখিত, এই অজ্ঞাত সংকল্প। এই রূপ কেবল কবির কাছেই জানা, এর আকৃতি কেবল কবির চোখেই সাড়া দেয়, কবি নিদ্রিত চোখে এই সংকল্পের অবয়ব দেখতে পান, এর কাঠামোর সন্ধান করতে পারেন।

মহৎ কবির সংকল্পের মধ্য দিয়ে জীবন ও সমাজও মহৎ হয়ে ওঠে; আদর্শ কবির অন্বিষ্ট নয়, কিন্তু তিনিই রচনা করেন ভিন্ন রকমের নতুন আদর্শ নতুন ভাবকল্প। ভাবের মধ্য দিয়েই তিনি জন্ম দেন ভাবনার, উপলব্ধির, এমন আর কেউ পারে না। ভাবের মধ্যে ভালোবাসার মধ্যে প্রেমের মধ্যে আচ্ছন্নতার মধ্যে প্রকৃত অর্থে তিনি অনুসন্ধান করেন সত্য, অনুসন্ধান করেন সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই তার কাছে সত্য, সৌন্দর্যই তার শেষ কথা। এই তার সন্ধান, এই সংকল্প এই সন্ধান কবিকে করে তোলে সম্পূর্ণ পৃথক মানুষ। আচ্ছন্ন অসংলগ্ন অসামাজিক প্রায় উন্মাদ; কিন্তু তার উন্মত্ততাই প্রকৃত সুস্থতা, তথাকথিত সুস্থতার মধ্যে কত যে ক্লেদ, কত যে কলুষতা, কত যে রুগ্নতা, কত যে উন্মাদগ্রস্ততা তা সবার চোখে পড়ে না।

সে জন্য কখনো কখনো কবিকে প্রত্যাখ্যান করেন তারাই, সমাজ নয়, তাকে উপলব্ধি করে ভবিষ্যৎ, হেনরি মিলর যথার্থই বলেছিলেন।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.