আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাণিজ্য মেলা-১

এডিট করুন

ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। ইতিমধ্যে পুরানো জৌলুশ ও প্রাচুর্য হারিয়ে, স্থানীয় সাধারণ মেলায় পরিণত হওয়া এক গৌরবময় অতীত। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার সাথে আমার সখ্য আবাল্য। নিজের পায়ে হাটার সক্ষমতা শুরু হবার পর থেকেই এই মেলার হাওয়াই মিঠাই, লম্বা কলম, আমার প্রতি বছরের আবশ্যকীয় মৌলিক অধিকার। সর্বশেষ ২০০৬ অথবা ২০০৭ এর দিকে এই মেলায় যাওয়া হয়েছে।

প্রচন্ড রকম হতাশ এবং ততোধিক মনোকষ্ট নিয়ে ফিরে এসেছি। ছোট বোনের জন্য এক সেট সালোয়ার কামিজের কাপড় কিনেছিলাম শুধু, আর কিছু কিনতে পারিনি। কারণ কেনার মত কিছু ছিল না। অথচ একসময় সরগরম সেই মেলার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। একসময় আমার ছোট ছোট দুটি পা ব্যাথা হয়ে যেত হাটতে হাটতে।

নিজের কেনা লম্বা কলম দিয়ে নিজেই বেত্রাঘাত প্রাপ্ত হতাম পড়াশোনার জন্য। হাওয়াই মিঠাই মুখে লেগে আঠা আঠা হয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হত। সবচেয়ে কষ্ট হত মেলা ভাঙ্গার দিন। প্রতিটা দোকান ভাঙ্গা হত আর মনে হত আমার হৃদপিন্ড দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া হচ্ছে। হ্যা আক্ষরিক অর্থেই আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হত মেলা ভাঙ্গার দিন।

আমি সহ্য করতে পারতাম না মেলা নামক এই বিশাল সৃষ্টি, বিশাল প্রাণটাকে হঠাৎ করে থামিয়ে দেওয়া। পুলিশ যখন ষ্টলগুলোর খুটিতে তাদের লাঠি দিয়ে আঘাত করত আমি তখন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম আর প্রতিজ্ঞা করতাম, বড় হয়ে এর প্রতিশোধ আমি নেব। আমার সেই প্রতিজ্ঞার কথা আমি কাউকে বলিনি আজও। এখন বুঝতে পারি সেটা ছিল এক বালকের আবেগ, একটা সৃষ্টির প্রতি বিশুদ্ধ আবেগ, খুব ছেলেমানুষী এবং কিঞ্চিত লজ্জাকর। কিন্তু তখন সেটা ছিল আমার এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

কোন বালকের মনে কি এখন এইরকম প্রতিজ্ঞার জন্ম হয় এখন? মেলার বিশালতা আর প্রাচুর্য দেখে কোন বালক কি অনুভব করে এখন মেলা নামক বস্তুটার ভেতরের অদ্ভুত প্রাণের অস্তিত্ত্ব? বলেছিলাম, শেষবার মেলা থেকে একসেট সালোয়ার কামিজের কাপড় কিনেছিলাম শুধু, আর কিছু কিনি নাই। কি কিনব? একসময় এই বাণিজ্য মেলা ছিল সত্যিকার অর্থেই বাণিজ্য মেলা। তখনকার সময়ে সদ্য গড়ে ওঠা কলকারখানাগুলোর সাহসী উদ্যোক্তারা নিজেদের মেলে ধরতেন এই মেলায়। সবার মাঝে ছিল আত্মপ্রত্যয়। মাটিতে কাজ করে আকাশ ছোবার স্বপ্ন দেখত তারা।

ডিজিটাল ক্যামেরার মাইক্রো এস ডি কার্ডের অফুরন্ত জায়গা ছিল না তাদের, তাদের ছিল নেগেটিভের স্বপ্ল কিছু স্থান। কিন্তু তারা লড়াই করার, আকাশ ছোবার স্বপ্ন দেখতেন। একটা কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান যখন একটু একটু করে গড়ে ওঠে তখন যদি আপনি তা প্রত্যক্ষ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন সৃষ্টির আনন্দ কাকে বলে। নতুন কিছু করা, নতুন কোন পদ্ধতিতে কিছু করা, একটা একটা করে কারখানার দেয়ালের ইট গাথা, বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া, কর্মচারী নিয়োগ, কাজের তুমুল উচ্ছাস, হঠাৎ পাওয়া কোন ফরমায়েশে অতি অল্প সময়ে সারা রাত কাজ করে পণ্য তৈরী করা, সে এক মহান জিনিস, এক মহান কর্মযজ্ঞ। আমাদের বাণিজ্য মেলায় সে সময় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে ছিলেন এই কর্মযজ্ঞের যোগীরা।

তারা ছিলেন সাধক। দেশীয় শিল্পে, নিজ দেশকে সমৃদ্ধ করতে তারা ছিলেন অগ্রপথিক। এরা অনেকেই আজ হারিয়ে গেছেন। কোথায় গেছেন জানিনা। তাদের অনেকের প্রত্যয় সেই ছোট আমার মনে তখন যেমন গেথে ছিল, আজও আছে।

তারা পরাজিত। এটাই সম্ভবত শেষ কথা। একটা ছোট্ট নীল পুতুল। পেট মোটা, আকৃতি ভালুকের মত। পুতুলটার মাথায় ছোট্ট একটা হলুদ টুপি।

ওটা আসলে টুপি নয়, ওটা একটা ছিপি। আর পুতুলটা ছিল একটা জুসের বোতল। এক বাণিজ্য মেলার শেষ দিকে এসে আমাদের ষ্টল ভাঙ্গা শেষে, বাশের খুটি, ব্যানার, অবশিষ্ট মালপত্র যখন ট্রাকে তোলা হচ্ছে তখন আমার বাবা আমাকে এই নীল ভালুকটা কিনে দিলেন। আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি এটা কি, পরে ঝাকি দিয়ে বুঝেছি এটার ভিতরে কিছু তরল জাতীয় বস্তু আছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি এর মাথাটা খোলার জন্য, কয়েকবার এর মাথা ধরে আর পেট ধরে পরষ্পর বিপরীত দিকে ঘুরিয়েছি।

কিন্তু পুতুলটা কোনভাবেই নিজেকে উন্মুক্ত করেনি। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে উনি উনার স্বভাবমত আমাকে চিন্তা করার উপদেশ দিলেন। আমার বাবা আমাকে প্রায়ই নানা বিষয়ে চিন্তা করতে বলতেন। আমি প্রায়ই চিন্তা করতে করতে কাজে নেমে যেতাম। যেমন ধরুন কার্টনে বাধা হত দড়ি দিয়ে।

কিভাবে বাধলে ভাল হয় এটা চিন্তা করতে করতে আমি কাচি নিয়ে দড়ি কাটায় নেমে যেতাম। এরপরে ঐ দড়ির এক মাথায় আগুন দিয়ে আরেক মাথা কোন গাছের ডালে বেধে রাখতাম। কারণ দোকানে দেখেছিলাম সিগারেট ধরানোর জন্য এরকম জ্বলন্ত দড়ি ঝুলিয়ে রাখতে। পুতুলটা পরবর্তীতে আমি খুলতে সক্ষম হয়েছিলাম। নানা কসরত করতে করতে একসময় মাথার হলুদ টুপি ধরে ঘুরাতেই ছিপি খুলে গেল।

পুতুলের ভিতরের জুসটা বেশ মজার ছিল। আমি পুতুলের মাথায় টিউমারের মত গজিয়ে থাকা ছিপির মুখে মুখ লাগিয়ে চুষে চুষে জুস খেতে লাগলাম। ট্রাকের এক ঝাকুনিতে একবার আমার জামায় কিছু জুস পড়েও গেল। জুস খাওয়া শেষে আমি পুতুলটা রেখে দিয়েছিলাম। একদিন মা ওটা ধুয়ে দিলেন।

আমি ওটায় করে পানি নিয়ে যেতাম স্কুলে। ঐ পুতুলের কোম্পানীকে এখন আর দেখি না। কোথায় গেছে কে জানে! আর ছিল সত্যিকারের পুতুলের কোম্পানী। ওরা লাল লাল জামা পড়া পুতুল বানাত। সুন্দর লাল টুকটুকে পুতুল।

লাল রঙের উগ্রতা ছড়িয়ে থাকত ওদের শাড়ীতে। মেলার ব্যাবসায়ীরা একে অন্যের খবর রাখতেন। অনেকের ছেলে মেয়ে আসত। কেউ তার ছেলে মেয়েকে নিয়ে অন্য কোন ষ্টলে গেলে তারা ছোট ছেলে বা মেয়েটার হাতে তাদের কোম্পানীর তৈরী কোন জিনিস উপহার হিসেবে ধরিয়ে দিতেন। এটা ছিল একটা সৌজন্যতা।

চলবে.........(যদিও আশা নাই, খেই হারাইয়া ফালাই)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।