আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শহীদুল জহির-এর কবিসত্তা : অপ্রকাশিত কবিতা-প্রসঙ্গ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

শহীদুল জহির-এর কবিসত্তা : অপ্রকাশিত কবিতা-প্রসঙ্গ .................................................................................................................................................................................... শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনে নীরবে-নিভৃতে সাহিত্যচর্চার দ্বারা বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ধারা নির্মাণ করে স্বীয় প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে স্বতন্ত্র আসন করে নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন সেই ধারাটি যখন গতিলাভ করতে শুরু করলো, তখন তিনি নীরব অভিমানে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। পেছনে রেখে গেলেন ব্যক্তিজীবনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা। তিনি ভরাপূর্ণিমার রাতে নয়, উজ্জ্বল দিনের আলোয় গত ২৩ মার্চ ২০০৮ ইহলোক ত্যাগ করার পর আমি তাঁর জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসটি পাঠ করি। শহীদুল জহিরের সাহিত্যের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচয় ঘটে মূলত তাঁর মৃত্যুর পর।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসের কাহিনীবৃত্তের নানামাত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির ব্যক্তিজীবনের যে সংকট প্রকটতর করে তুলেছেন তা প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাতীয় জীবনের অধঃপতিত সংকটাপন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতা। পুরনো ঢাকার গলিপথ একপাশে রেখে এরপর শহীদুল জহির যাত্রা করেছিলেন সুহাসিনী গ্রামের দিকে। গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচনা করলেন সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। এ উপন্যাসের অসামান্য গল্পের বুঁনন এবং মোহনীয় কাহিনী বর্ণনরীতি বাংলা উপন্যাসে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। সুহাসিনীর চন্দ্রালোকিত ভাদ্রমাসের এক রাতের ভয়াবহ ঘটনার নেপথ্য সত্য আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষয়িষ্ণুতার মূল কারণ আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

কিন্তু সুহাসিনীর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিবেশ ছেড়ে শহীদুল জহিরকে ফিরে আসতে হয় ভূতের গলিতে। তিনি রচনা করেন তাঁর তৃতীয় এবং শেষ উপন্যাস মুখের দিকে দেখি। ‘কার থিফ মাঙ্কিবয়’ চানমিঞার জীবনবাস্তবতা এবং সংকটাপন্ন অস্তিত্বের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকনৈতিক অবক্ষয় তথা ক্ষয়িষ্ণুতার যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা যথার্থই নাগরিক বাঙালির বিপন্নতা। আমার এই পাঠ-প্রয়াসের মধ্য দিয়ে হয়তো শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্যের অন্বিষ্ট জীবনাভিজ্ঞানের কিছুই আবিস্কৃত হয় নি। তা না-হোক; কারণ, ব্যক্তিভেদে সাহিত্যের পাঠ-উপলব্ধি, বিচার-বিশ্লেষণ ও নান্দনিক পর্যালোচনা ভিন্ন।

ব্যক্তিগত উপলব্ধির আলোয় হাঁটতে হাঁটতে শহীদুল জহিরের উপন্যাসের পাঠ শেষ করে তাঁর ছোটগল্পের ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’র জগতে প্রবেশ করার ঠিক পূর্ব-মুহূর্তে দৈনিক সংবাদ-এর সাময়িকী ‘ঈদ-সংখ্যা’ (২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮) আমার হাতে এসে পড়ল। প্রথম পাতায় চোখ রেখেই চমকে উঠলাম-- ‘শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত দীর্ঘ কবিতা’ শীর্ষক শিরোনাম দৃষ্টিগোচর হওয়ায়। এরপর বিলম্ব করি নি; এক নিমিষেই শহীদুল জহিরের কবিসত্তার হদিস জানার চেষ্টা করেছি ‘শিরোনামহীন’ দীর্ঘ কবিতার নান্দনিক তাৎপর্যে। কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের দীর্ঘকবিতাটির পাঠপ্রতিকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে তাঁর অনাবিষ্কৃত যে কবিসত্তার পরিচয় উদ্ঘাটিত হলো, তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ, অনাদরে অযত্নে যে লেখা শহীদুল জহির প্রকাশ করেন নি, কিংবা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি সেই অপ্রকাশিত কবিতার নান্দনিক বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় তা শুদ্ধতম কবিতা।

কবি ও কবিতা সম্বন্ধে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) বড্ড ভয়ানক মন্তব্য করেছেন-- সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি। শহীদুল জহির কবিতাচর্চায় নিবেদিত প্রাণ না হয়েও জীবনানন্দ দাশ স্বীকৃত ‘কেউ কেউ’-এর দলের কবি। অতএব বলা যায়, শহীদুল জহির যদি কথাসাহিত্য রচনা নাও করতেন শুধু কবিতা লিখতেন-- তথাপি তিনি নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে স্বপ্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে স্ব-মর্যাদায় স্বতন্ত্র আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু শহীদুল জহির তাঁর কবিসত্তাকে বা কবিপ্রতিভাকে আড়াল করে রেখেছিলেন জীবদ্দশায়। তাঁর কবি-পরিচয় উদ্ধার করে অনুজ মোঃ হাবিবুল হক সংবাদ-এর সাময়িকী সম্পাদককে লিখেছেন : শহীদ ভাইয়ের সরকারী বাসভবন (অরুনিমা, এলিফ্যান্ট রোড) গত মে মাসে খালি করে দেওয়ার সময় তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিস, বইপত্র, ব্যক্তিগত কাগজপত্রের ভিতর এই পুরানো লেখাটি (কবিতা-শিরোনামহীন) পাই।

শহীদ ভাই তাঁর ঘনিষ্ঠজনকেও সম্ভবত নিজের লেখা-সম্বন্ধে জানাতেন না এবং লেখা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন না। প্রচারের ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট অনীহা ছিল হয়তো। ফলে তাঁর কাছের-লোক হিসেবে দাবিদার লোকজনও তাঁর লেখা সম্বন্ধে কিছু জানেন বলে আমার মনে হয় না। আমিও ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পাওয়া লেখা সম্বন্ধে ব্যক্তিবিশেষকে জানাতে চাইনি, ফলে অনেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগ করলেও লেখাটি তাদের কাছে না দিয়ে আপনার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠালাম। লেখাটির শুদ্ধ-অশুদ্ধ বিবেচনার ভার আপনার।

... লেখাটি পাঠক-সমালোচকেরা কীভাবে নেবেন জানি না, কেননা তিনি গদ্য লেখক হিসাবেই পরিচিত। --(মোঃ হাবিবুল হক, ‘সংগ্রহ ও ভূমিকা’, শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত দীর্ঘ কবিতা, ঈদ সংখ্যা, ঢাকা : দৈনিক সংবাদ, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮) হ্যাঁ শহীদুল জহিরের অনুজ হাবিবুল হক যথার্থই বলেছেন, যে তিনি গদ্য তথা কথাসাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন জীবদ্দশায়। তবে তাঁর আবিষ্কৃত এই দীর্ঘ-কবিতাটি পাঠ করার পর মনে হয়েছে-- তিনি কবিও ছিলেন বটে। তাঁর মতোই তিরিশের খ্যাতিমান কবি জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় জানতে দেন নি যে, তিনি গদ্য (গল্প-উপন্যাস) লিখতেন। বোধকরি, নিভৃতচারী-মুখচোরা স্বভাবের শহীদুল জহিরও তাঁর কাব্যচর্চার ইতিহাস সকলের আড়ালে-আবডালেই করতে চেয়েছিলেন।

শহীদুলের এই দীর্ঘ-কবিতাটির পরও যদি আরো কোন কবিতা আবিষ্কৃত হয়, তাহলেও বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই; এজন্য যে, এই দীর্ঘ-কবিতাটিতে সুস্পষ্টভাবে তাঁর শক্তিমান শিল্পিত কবিসত্তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। ‘শিরোনামহীন’ কবিতাটি মূলত শহীদুল জহিরের যাপিত জীবনের স্মৃতিমূলক একটি রচনা। কবিতার শুরুতেই তিনি স্পষ্টভাবেই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন : ভোরে যখন মুয়াজ্জিন আজান দিল, এবং জানাল, নিদ্রার চাইতে নামাজ উত্তম, তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল এবং আমি তোমার কথা ভাবলাম তুমি আছ কোথাও তোমার পৃথক ঘরে, এখানেই ঢাকাতেই, এখানে ‘তুমি’ সর্বনাম পদটি শহীদুল জহির বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই ‘তুমি’ কে বা কাকে উদ্দেশ্য করে তিনি ‘তুমি’ সর্বনামটি ব্যবহার করেছেন, তা সম্পূর্ণ কবিতায়ও স্পষ্ট হয় নি। সুতরাং কবিতার শুরুতে যে ‘তুমি’ সর্বনাম শহীদুল ব্যবহার করেন, তা এক রহস্যের আড়ালে আবৃত।

কারণ, ভোর বেলা ঘুম থেকে জেগেই একজন মানুষের কার কথা মনে পড়ে? সুতরাং প্রশ্ন উত্থাপিত হয়-- এই ‘তুমি’ কি শহীদুলের ব্যক্তি-জীবনের সাথে জড়িত কোন নারী? যে নারীর সাথে তাঁর অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা তাঁকে মেনে নিয়ে নিঃসঙ্গ পঞ্চান্নটি বসন্ত পার করতে হয়েছিল? কিন্তু ‘তুমি’ সর্বনামে কবির হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার কথা ভাবতে গিয়ে কবিতার পরের চরণে একটি বড় ধাক্কা লাগে-- যখন সেই ‘তুমি’ শহীদুল জহিরকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে জানায়-- ‘আমার শ্বশুর আমাকে চিঠি লিখেছে, কিন্তু/ আমি এই গল্প শুনতে চাইনি, আমার অসহ্য লেগেছিল, এখনও লাগে/ কারণ তোমার এই গল্পে আমি নাই, হিংসা মানব জীবনের পাথেয় হোক/ কেন নয়? মানুষ-দেবতা আর কত হব আমি?’ --উদ্ধৃত চরণাংশের ‘স্যার’ সম্বোধনে মনে হয় শহীদুলের কর্মজীবন কেন্দ্রিক কোন অধীনস্ত কর্মচারীর কথা তিনি ‘তুমি’ সর্বনাম পদটিতে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শহীদুলের এই অধীনস্ত কর্মচারী তো কোন নারীও হতে পারে! হয়তো তার শহীদুলের ব্যক্তিজীবন গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল। নারী সাব-অর্ডিনেট (অধীনস্ত) হলে কি তার সাথে গড়ে উঠতে পারে না প্রণয়? কেননা প্রণয় তো মানে না-- জাত-পাত, ধর্ম-গোষ্ঠী-বংশ-শ্রেণী কিংবা সমাজের উঁচু-নীচু শ্রেণী ভেদাভেদ। হবে হয়তো, কর্মক্ষেত্রের নীচু অবস্থানের কোন নারীই ছিল শহীদুলের অন্তরাত্মা জুড়ে। কারণ, তার শ্বশুর বাড়ি থেকে আসা চিঠিতে নিজের কথা নেই বলে, সেই চিঠির ভাষ্য শোনার মতো আগ্রহ জাগে নি শহীদুলের।

বরং তাঁর ভেতর জেগে উঠেছে ‘ঈর্ষা’। আর এই ‘ঈর্ষা’র সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক যে কতটা গভীর ও গাঢ় তা সৈয়দ শামসুল হক ঈর্ষা কাব্যনাটকে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রণয়ের ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে শহীদুল জহির ‘মানুষ-দেবতা আর কত’ হবেন? বলাবাহুল্য, প্রণয়ের ঈর্ষা বড় ভয়ানক ও প্রচণ্ড। শহীদুল জহিরকে শেষ পর্যন্ত এই ঈর্ষা দেবতার আসন থেকে মর্ত্যভূমিতে টেনে নামিয়েছে। কবিতাটির পরের স্তবকে আছে-- শহীদুলের দৈনন্দিন অফিস কামরায় ফাইল-পত্র ঘাটাঘাটি; পিয়ন-কেরানির হৈচৈ।

এসবের ভেতরেই শহীদুল ধূসর রঙের ফাইল খুলে বসেন। একরাশ ফাইল-পত্রের ভেতর নিমজ্জিত শহীদুল ভাবেন-- কাগজ সভ্যতার নির্মাতা, নাকি সভ্যতাই কাগজের নির্মাতা? এইসব বিচ্ছিন্ন ভাবনা এবং কাজের এক ফাঁকে বাতাসের সাথে বয়ে আসে ইউক্যালিপটাসের পাতার তীব্র ঝাঁঝাল ঘ্রাণ। যে ঘ্রাণে আলোড়িত হন শহীদুল জহির; তিনি হারিয়ে যান স্মৃতির রাজ্যে-- ‘অফিসের কলরব এবং ধুলোর ভেতর আমি ভাবি যে (কেন ভাবি জানি না) ধীবর রমণীদের দেহের ঘ্রাণ হয়তো/ এমন হয়, মাছের গন্ধের মত কামনার তীব্রতায় রাঙা’। ইউক্যালিপটাসের পাতার ঘ্রাণে শহীদুলের হৃদয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে তা নিঃসন্দেহে শিল্পিত সুষমায় অসামান্য এক কাব্যময় চিত্র-- ‘কামনার তীব্রতায় রাঙা’। কবিতার পরের স্তবকে শহীদুল জহির ব্যক্তিগত ভ্রমণাভিজ্ঞানের ঘটনা সংহত-সংযত কাব্যময় ভাষায় বর্ণনা করেছেন।

একদা সুন্দর বনে যাওয়া পথে ভৈরব নদীর কিনারায় তিনি দেখেছিলেন চিংড়ি-পোনা সংগ্রহকারী জেলেনিদের। সেই ধীবর রমণীদের দেহের ঘ্রাণ শহীদুলের রাজধানীতে অবস্থিত সচিবালয়ের নবম তলার অফিস কক্ষে অবলীলায় ঢুকে পরে ইউক্যালিপটাসের পাতার ঘ্রাণের সাথে। কবির বর্ণনায় : ... নদীর ঘ্রাণের সঙ্গে মাছেদের ঘ্রাণ মিশে আছে, এবং পানিতে নত হয়ে থাকা ওই নারীরাও মাছেদেরই মত (নাটোরের মেয়েরা কি মাছেদেরই বোন?) কতদূরে মাছ আর নারী পড়ে থাকে কিন্তু পানিতে কত দূর চলে আসে তাদের ঘ্রাণ, আমার অফিসের নয় তলার ওপরে বাতাসে ভেসে আসা ইউক্যালিপটাসের পাতার ঘ্রাণের মতন নারীর দেহে শহীদুল জহির খুঁজে পেয়েছেন ধীবর রমণীর (জাইলানি) শরীরের ঘ্রাণ। সেই নারীর সাথে তিনি সাদৃশ্য খুঁজে পেতে চেয়েছেন-- আধুনিক তথা শহুরে নারীর। সম্ভবত এ কারণে তিনি নিজের কাছেই প্রশ্ন করেছেন-- ‘নাটোরের মেয়েরা কি মাছেদেরই বোন?’ এখানে ‘নাটোর’ শব্দটির মাধ্যমে কবি কোন ভৌগোলিক স্থানকে নির্দেশ করতে চান নি।

কবি জীবনানন্দ দাশও তাঁর বনলতা সেনকে শেষাবধি যেমন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন-- স্থানিক বৃত্তের বাইরে বিশ্বচরাচরের মাঝখানে; তেমনি শহীদুল জহিরও ‘নাটোর’ শব্দটির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কোন ভৌগোলিক সীমানাকে চিহ্নিত করেন নি; বরং তিনি এই ‘নাটোর’ শব্দের প্রতীকে ভৈরব নদীর কিনারায় যেসব ধীবর রমণীদের দেখেছিলেন, তাদের সাথে শহুরে নারীদের পার্থক্য এবং সাদৃশ্য খুঁজেছেন। আসলেই কি কোন পার্থক্য আছে? আপাত অর্থে সামাজিক পার্থক্য দৃশ্যমান শহুরে নারীদের সাথে ধীবর রমণীর। প্রকৃতার্থে ‘নাটোরের’ (শহরের) রমণীর সাথে ভৈরব নদীর কিনারায় দেখা নারীদের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পান নি শহীদুল জহির। এজন্যই খোদ-রাজধানী শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শহীদুলের নবম তলার অফিস কক্ষের জানালা গলিয়ে অবলীলায় ইউক্যালিপটাসের পাতার সাথে ধীবর রমণীর কামনার ঘ্রাণ ভেসে এসেছে। নারী-দেহের এই গন্ধের তথা ঘ্রাণের পশ্চাতেও আছে এক ইতিকথা।

একটি বিশেষ সময়ে পৃথিবীর তাবৎ নারীর দেহেই সম্ভবত একই ধরনের ঘ্রাণ (আঁশটে গন্ধ) তৈরি হয়। প্রচলিত কথায় এই সময়কে নারীর ‘পিরিয়ড’ কাল বলা হয়। র‌্যাডিক্যাল ফেমিনিস্ট সিমন দ্য ব্যুভোয়ারও তাঁর দ্য সেকেন্ড সেক্স গ্রন্থে পিরিয়ড কালে নারী-দেহের বিশেষ গন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং শহীদুল জহির তাঁর নয় তলার অফিস কক্ষে বসে যখন ধীবর রমণীর দেহের ঘ্রাণ পান ইউক্যালিপটাসের পাতা বেয়ে আসা বাতাসে-- তখন সেই ঘ্রাণ আর ভৈরব নদীর ধীবর রমণীদের শরীরের গন্ধ থাকে না। সমগ্র নারীজাতিরই শরীরের ঘ্রাণের প্রতীক নির্মিত হয় ইউক্যালিপটাসের পাতা বেয়ে আসা বাতাসের ঘ্রাণে।

উল্লেখ্য, নারী-শরীরের এই বিশেষ ঘ্রাণে শহীদুলের কবিসত্তা অনুভব করেন : ‘... ইউক্যালিপটাস গাছের পাতার এই ঘ্রাণ হলো জেলে মেয়েদের/ দেহের ঘ্রাণের মত, মাছদের কামনার গন্ধরেণু মাখা, নির্লজ্জ তীব্রতায় কেমন/ উন্মুখ, তবু ব্রীড়াময় তবু সহৃদয় এবং নরম’। ব্যক্তিগত জীবনে শহীদুল জহির নারী-বিবর্জিত নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় বসবাস করেছেন। কিন্তু মানুষ কি হতে পারে একেবারে কামগন্ধহীন দেবতা? শহীদুলের এই নৈঃসঙ্গ্যে যাপিত জীবনের অনুদ্ঘাটিত তীব্র কাম-বাসনার প্রকাশ ঘটেছে কবিতায় এভাবে-- ‘ছেড়ে যেতে চাই, তবু/ দেহকে অতিক্রম করে ঘ্রাণ আসে, মানুষকে পার হয়ে জাগে অধরের তিল’। শহীদুল জহির কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) বিনোদন এবং রাজনীতিকদের খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন চিত্র তুলে ধরে শহুরে মানুষের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের বাস্তবতা উপস্থাপন করেছেন। রাতে যখন ‘সোনার বাঙলা’ জাতীয় সঙ্গীতের সুর-ধ্বনিতে টেলিভিশন (বিটিভি) বন্ধ হয়ে যায়-- তখন তিনি অনুভব করেন রাত-দিনের পার্থক্য ঘটল।

মাত্র তখন নীরবতা নেমে আসে চারপাশে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়ে সকলেই। কবির কথায় : ‘... ঈশ্বর দিনের ভেতর থেকে রাতকে পৃথক করেন/ কেন করেন?/ হয়তো তোমার ঘুমানো এবং আমার জেগে থাকার জন্য’। আরো একধাপ বিশ্লেষণ করে শহীদুলের কবিসত্তা জানিয়ে দেয়-- পৃথিবীর তাবৎ মানুষ যখন ঘুমিয়ে রাতের নীরবতাকে আরো জমাট স্তব্ধতায় ভরে দেয়, তখন তিনি অনুমান করেন-- হয়তো এখন ‘রাত গভীর হয়ে গেল’। যখন রাত গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে তখনো জেগে থাকেন শহীদুল জহির, ভাবেন-- তার কথা; যাকে (তুমি) তিনি ঘুম থেকে উঠেই স্মরণ করেছিলেন।

আর তিনি তখন লেখেন : আমরা দুজন তো ছিলাম এবং আছি (আছ কি? তুমি আসলে এখন কোথায় আছ?) আদম এবং হাওয়া কি ছিল না আমাদের মত? আবারে প্রশ্ন ওঠে কে এই ‘হাওয়া’? যার কতা গভীর রাতে একাকী নিঃসঙ্গতায় বসে শহীদুল জহির ভাবেন? তাহলে এই ‘হাওয়া’ কি সেই ‘তুমি'-- যার কথা ঘুম থেকে জেগে উঠেই তাঁর মনে আসে। নাকি শহীদুলের এই ‘হাওয়া’ শাশ্বত কোন নারী-সত্তা? অবশ্য ‘আদম’ ‘হাওয়া’ শব্দ দুটোর মধ্য দিয়ে নর-নারীর শাশ্বত জীবন-কথার সম্ভাবনা অধিকতর প্রবল হয়ে ওঠে। শহীদুল জহির ঢাকা নগরীর গভীর রাতের দৃশ্য এরপরের স্তবকে শিল্পিত দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন। ঘুম-দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে শহীদুল জহির ঢাকার যান্ত্রিক জীবনের অসামান্য প্রতিচিত্র নির্মাণ করেছেন কবিতার শেষাংশে। একটি মাত্র প্রশ্নের মাধ্যমেই শহীদুল ঢাকা শহরের জীবনসত্যকে বাঙ্ময় করে তোলেন-- ‘আসলে ঢাকা শহরে কি আকাশ আছে?’ সত্যিই তো মাল্টি স্টোরেড বিল্ডিং-এর নীচে দাঁড়িয়ে বিশাল আকাশটার মুখ দেখা যায় না ঢাকা শহরে।

শহুরে এই সভ্যতায় আকাশের নীচে শহীদুর জহির দেখেন-- সিটি কর্পোরেশনের সোডিয়াম আলোর নিচে ফার্মগেট, মগবাজার অথবা রমনা পার্কের গেটে কিংবা অন্য কোথাও অসংখ্য নর-নারীর যাপিত জীবনের নির্মম-নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এদের কেউ-বা চোর, কেউ-বা পতিতা। বহুতল বিশিষ্ট ভবনের আকাশবিহীন ঢাকা শহরের মানুষগুলো শহীদুলেরর কলমে ভীড় জমায়, বেদনার্ত হৃদয়ে এদের (ছিন্নমূল মানুষ) যাপিত জীবন চিত্র এঁকেছেন শহীদুল। তিনি ভাবেন, এরাও তো মানুষ; তাহলে তাদের যাপিত জীবন কেন সামাজিক সাম্যকে ব্যাহত করে? যখন রমনা পার্কের গেটে কোন পতিতা খদ্দের ধরবার অপেক্ষায় গভীর রাত অবধি জেগে থাকে, তখন শহীদুল জহিরের কবিসত্তা কিভাবে ঘুমাতে পারে আরামে-আয়েশে? পারে না, এবং তিনি সত্যি রাতভর ঘুমাতে পারেন না। তাই শহীদুল জহির লেখেন : ... পতিতা আর পাতি চোরেরা জাগে, জাগে পেঁচা এবং তস্করেরা এবং আমি জাগি (কেন জাগি বলো?) শহীদুল জহির নিজেকেই প্রশ্ন করেন-- আসলে তিনি কেন জেগে থাকেন? এইসব মানুষ তাঁর স্মৃতিতে ভীড় জমায়, প্রশ্ন তোলে কি মানবতার? কিংবা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের দাবী নিয়ে, ন্যূনতম জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা চায় এরা কবির কাছে? নাকি শহীদুলের মমতায় আর্দ্র কবিসত্তা ভাবে-- কিভাবে এসব মানুষের ন্যূনতম বাঁচবার নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে? কবিতার পরের চরণে অবশ্য শহীদুলের জেগে থাকার কার্যকারণ সম্বন্ধে জানা যায় : গাছ এবং পাখিদের মত, দালানের ফাঁক দিয়ে জেগে থাকা কালো আকাশের মত তুমি ঘুমাও (কেন ঘুমাও?) কেন বলো তুমিও জাগো না? এই পেঁচা এবং গণিকাদের জন্য, চোর অথবা তস্করের জন্য (আসলে এদের জন্য কেউ রাত জাগে না, খামখা তবু কেন বলি!) মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব মানুষের জন্য রাত জাগে না কেউ।

অর্থাৎ কেউ-ই ভাবে না এদের কথা। বিশেষ করে যারা রাজধানীর স্কাইস্ক্রাপারে (বহুতলবিশিষ্ট ভবন) বাস করেন, তারা তো নয়-ই। কিন্তু শহীদুল জহির জেগে থাকেন; আর ভাবেন-- যদি কিছু করতে পারেন খোলা আকাশের নীচে যাদের জীবন কাটে, তাদের জন্য। কবিতার এই স্তবকে শুরুতে যে ‘তুমি’ সর্বনাম শহীদুল ব্যবহার করেছিলেন তা আরো বাঙ্ময় ও কাব্যময় হয়ে উঠেছে। এখানে এসে এই ‘তুমি’ প্রিয়তমা প্রতীক আরো গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্যবাহী ইঙ্গিতময়তার দ্যোতক।

এখানে শহীদুলের মানস-প্রিয়া সেই ‘তুমি’ প্রকৃতপক্ষে ‘কাব্যলক্ষ্মী’তে পরিণত হয়ে উঠেছে। যাকে শহীদুল জহির অনায়াসে প্রশ্ন করতে পারেন : ‘তুমি এত অনায়াসে কেম করে ঘুমিয়ে থাকাদের দলে গিয়ে ভেড়/ রাত জাগাদের দলে থাকার কথা ছিল না কি তোমার?’ বলার অবকাশ রাখে না যে, এখানে ব্যবহৃত ‘তুমি’ সর্বনাম প্রিয়তমার আসন ছেড়ে অসীমের দিকে ধাবিত হয়েছে। যে ‘তুমি’র কাছে প্রত্যেক মানুষই উত্থাপন করতে পারে-- প্রশ্ন-অভিযোগ-অনুযোগ। কিংবা দুঃখে-কষ্টে এই ‘তুমি’র ওপর ক্ষোভ-বিক্ষোভও দেখাতে পারে মানুষ। ফলে ব্যক্তি শহীদুলের নির্মিত ‘তুমি’ শেষাবধি সমষ্টিতে গিয়ে মিশে গেছে।

যেমন-- জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন নাটোরের ভৌগোলিক সীমার বৃত্ত পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত হয়েছে, তেমনি শহীদুল জহিরের এই ‘তুমি’ও ব্যক্তি-জীবনের দরজা পেরিয়ে সমষ্টির সীমায় বিলীন হয়েছে। শহীদুল জহির এরপর কবিতাটির তৃতীয় স্তবক শুরু করেছিলেন : ‘দিন গেলে পুনরায় ঘরে ফিরি/ রাত কেটে গেলে পুনরায় বের হতে হয়’; এখানে ছেদ পড়েছে। কিন্তু এই ছেদ পড়ায় স্পষ্ট বোঝা যায়, কবিতাটি এখানেই শেষ হয় নি। আরো বাকি রয়েছে। যেহেতু এ পর্যন্তই উদ্ধার করা হয়েছে শহীদুল জহিরের কবিতা; সেহেতু সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে-- হয় কবিতাটির বাকি অংশ পাওয়া যায় নি অথবা তিনি (শহীদুল জহির) লেখাটি শেষ করেন নি।

প্রকৃতসত্য যাই হোক না-কেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ কবিতাটি যে পাই নি শেষ দুই লাইনের পাঠ-গ্রহণ করলে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতার চরম সত্য মেনে নিয়ে যখন শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত ‘শিরোনামহীন’ দীর্ঘ কবিতাটির পাঠ শেষ হয় তখন নির্দ্ধিধায় বলা যায়, শহীদুল জহির নিজের ভেতরে লোকচক্ষুর আড়ালে এক বড় মাপের কবিসত্তাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। অথব তিনি অবহেলায় তাঁর কবিসত্তাকে ফেলে রেখেছিলেন আলোহীন তমসবৃত্তে। তাঁর কবিসত্তাকে যদি তিনি আলোর মুখ দেখতে দিতেন-- তাহলে জীবদ্দশায় শহীদুল জহির কথাসাহিত্যিক স্বীকৃতির পাশাপাশি নিঃসন্দেহে কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতেন। যে কবিতা শহীদুল জহির অপাংক্তেয় ভেবে ফেলে রেখেছিলেন, সেই কবিতার উপর্যুক্ত পাঠ-পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় তাঁর অন্তরে ফল্গুধারার ন্যায় বহমান ছিল কবিসত্তার অনাবিল স্বর্গীয় সৌরভ।

আর তাই বিনা বাধায় শহীদুলের বহুতল ভবনের অফিস কক্ষে ইউক্যালিপটাসের পাতা বয়ে আসে ভৈরব নদীর কিনারায় চিংড়ি সংগ্রহকারী রমণীদের মদির মাতাল কামনার রঙে রাঙা ঘ্রাণ। কাব্যভাষা নির্মাণে শহীদুল জহির যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন অথবা ছিলেন না, এমন বলা যায় না একটিমাত্র কবিতার পাঠ-বিশ্লেষণ বা ভাষা-পর্যালোচনার মাধ্যমে। কারণ, তিনি কবিতার অনেক চরণে কিংবা শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন প্রথম বন্ধনীর মধ্যে। কোন কোন ক্ষেত্রে অপরিহার্যতা থাকলেও কবিতার বিবেচনায় বন্ধনীতে ব্যবহৃত সকল টীকাভাষ্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল না, যা বাহুল্য দোষে দুষ্ট হয়ে কাব্য-সৌন্দর্যে হানি ঘটিয়েছে। কবিতাটির আবৃত্তির তথা পাঠের কথা বিবেচনা রেখে দীর্ঘলয় ব্যবহার করলেও এর সমতাহীন মাত্রা অনেক পংক্তির ছন্দময়তা হারিয়েছে।

অক্ষরবৃত্তের দীর্ঘলয়ে রচিত এই দীর্ঘ কবিতাটির চুলচেরা নান্দনিক বিচার-বিশ্লেষণ করলে হয়তো অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া যাবে; তবে এখানে উপমা-রূপক-প্রতীক ও চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে গদ্য-রচয়িতা শহীদুল জহিরের যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। বলার অবকাশ রাখে না যে, কথা-সাহিত্যিক শহীদুল জহির অনন্য এবং অসাধারণ। কিন্তু তাঁর নব-আবিষ্কৃত কবিতার পাঠ-পরিক্রমা শেষে বলতে বাধা নেই যে নিভৃতচারী শহীদুল জহির হৃদয়াভ্যন্তরে পুষে রেখেছিলেন অসামান্য এক কবিসত্তা। তাঁর কবি-প্রতিভার উজ্জ্বল স্মারণ ‘শিরোনামহীন’ দীর্ঘ কবিতাটি। কবি হিসেবেও যে কথা-সাহিত্যিক শহীদুল জহির বাংলাদেশের সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখতে পারতেন তা এই অপ্রকাশিত দীর্ঘ কবিতার শিল্পিত সুষমায় অনুমান করা যায়।

...............................................................................................................................

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.