আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা হাঁটছি উল্টোদিকে

গহীন অরণ্য পথে পথহারা এক পথিক....

পশ্চিম যখন প্রযুক্তি-দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছে আমরা তখন তৈরি করছি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার। আমরা হাঁটছি উল্টোদিকে। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে বেকার তৈরির কারখানা। প্রতি বছর ২৯টি (বর্তমানে ৩৪টি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪০ হাজার এবং মাদ্রাসা থেকে ২২ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সনদ পাচ্ছেন। যার সিংহভাগই থেকে যাচ্ছে বেকার।

হতাশাগ্রস্ত উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থান করতে পারছে না সরকার। তবুও থেমে নেই উচ্চশিক্ষার স্রোত। নিম্নমানের উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটেই চলেছে। কিন্তু বেকারত্ব হ্রাসে কারও মাথাব্যথা নেই। কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগও তেমন চোখে পড়ছে না।

অথচ এটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত গবেষণা নেই। চলছে শিক্ষক ছুটির হিড়িক। এদের অনেকে আবার সরকারি টাকায় বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন।

যোগ দিচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা অন্যত্র। সরকারি টাকায় উচ্চশিক্ষিত হয়ে অনৈতিকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির মাধ্যমে উপার্জন করছেন বড় অঙ্কের টাকা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক আবার নিজ প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর পাশাপাশি ৩-৪টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। এতে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পাঠদান পর্বটির মান নিম্নগামী হচ্ছে। শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়ছেন রাজনীতিতে।

সম্প্রতি ঢাবিতে মেধার বিস্ফোরণ হওয়া একটি বিষয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ছাত্রদের বিশেষ আদর্শের অনুসারী হতে অনুপ্রাণিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়নে রাজনৈতিক আদর্শকে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীকে দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। বর্তমানে এই সংখ্যা ৫৪।

মানসম্মত ক্যাম্পাস ছাড়াই মার্কেটের কিংবা শপিংমলের ওপর তলায় বসেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের ১২টি দেশে বেকারত্ব উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। শীর্ষ এই ১২ দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৩.৭ শতাংশ। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এ বৃদ্ধির হার ছিল ১.৯ শতাংশ।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর ২৭ লাখ জনগোষ্ঠী চাকরির যোগ্য হচ্ছে। এর বিপরীতে মাত্র ৫ লাখ লোক চাকরি পাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিবছর ২২ লাখ লোক যোগ হচ্ছে বেকারের তালিকায়। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছে ২০০৮ সালে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি। সংস্থাটির অভিমত, ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ৬ কোটিতে উন্নীত হবে।

বেকারত্বের শিকার জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই উচ্চশিক্ষিত। সরকার উচ্চশিক্ষা উৎসাহিত করতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করলেও উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনও পদক্ষেপই নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আবাসন, যাতায়াত, ফি ও খাওয়ার খরচ বাবদ অভিভাবককে অর্ধলক্ষাধিক টাকা ব্যয় করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে ব্যয়টা আরও বেশি। কিন্তু সরকারকে ব্যয় করতে হয় বড় অঙ্কের টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসাব মতে, ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে সরকারের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১৫ শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৫ টাকা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় ছিল ১ লাখ ১১ হাজার টাকা। বুয়েটের শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের ব্যয় ছিল ৬৭ হাজার টাকা।

একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার ৭শ ৭২ জন ছাত্রের প্রত্যেকের পেছনে সরকারকে ব্যয় করতে হয় ৫৪ হাজার ১৫৩ টাকা। হাতিরপুলের এক ডাক্তারের সাইনবোর্ডে এমবিবিএসের পাশে যোগ্যতা হিসাবে লেখা আছে এমবিএ যুক্তরাষ্ট্র। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এমবিএ কিংবা আইবিএর এসবিএতে। এমএসসিতে বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান করে নেওয়া ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে এমএ করে ল কলেজে ভর্তি হচ্ছেন। ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স করা ছাত্র আইন পড়ার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন যুক্তরাজ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি করে চাকরি করছেন বীমা কোম্পানিতে। ডাক্তারি এবং প্রকৌশল পাস করা শিক্ষার্থীরা ঢুকছেন প্রশাসনে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে চাকরি করতে হচ্ছে ব্যাংকে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএসএস করে দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর নামতে হচ্ছে ব্যবসায়। আরবিতে এমএ করা ছাত্র হিসাররক্ষক হিসাবে চাকরি নিচ্ছেন ব্যাংকে ।

এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ৫ বছরের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ পর্বটি কোনও কাজেই আসছে না। দেশে উচ্চশিক্ষার স্রোত বইছে। অথচ চাকরির বাজার হয়ে পড়ছে সঙ্কুচিত। ফলে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি জোটাতে প্রার্থীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাকরি হয়ে পড়ছে সোনার হরিণ।

কোনওক্রমে জীবন ধারণের জন্য তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীরা সম্পূর্ণ বিপরীত সেক্টরের চাকরিতে ঢুকছেন। চাকরিতে ঢোকার আগে বা পরে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে পরিবর্তিত ক্ষেত্রে প্রস্তুত করছেন। বিপরীত সেক্টরে চাকরিরতরা জানিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা এক্ষেত্রে তাদের কাজেই আসছে না। নতুন কর্মক্ষেত্রে তাই তাদের মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও দক্ষ জনশক্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত নারীর অনেকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ঢুকে পড়ছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে। পরিবার তাদের সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতে নিরুৎসাহিত করছে। সেজন্যই ঢাবি থেকে সমাজকল্যাণে মাস্টার্স করা মেয়েটি কালীগঞ্জের প্রাথমিক বিদ্যালয়কেই আদর্শ কর্মস্থল ভাবছে। অথচ মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রাইমারি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা এসএসসি পাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নামতা, যোগ-বিয়োগ, ছড়া, ইতিহাস, ভূগোলের প্রাথমিক পাঠ পড়াতে এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস করা শিক্ষকই যথেষ্ট।

এসব ক্ষেত্রেও উচ্চশিক্ষার পেছনে ব্যয় করা অর্থ শুধুই অপচয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স করা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি। এদের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা হিসাবে চাকরিতে ঢোকা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষে কম্পিউটার শিখে হচ্ছেন করণিক কিংবা টাইপিস্ট। প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে কিংবা অদক্ষ জনশক্তি হিসাবে বিদেশগামী হচ্ছেন।

তাদেরও উচ্চশিক্ষা কাজে আসছে না। মাদ্রাসা থেকে ফাজিল-কামিলে উচ্চশিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীরাও মূল স্রোতে আসতে পারছেন না। মাদ্রাসা শিক্ষক, ইমামতি এবং গ্রামাঞ্চলে দোয়া-দরুদ পড়ার মধ্যেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কর্মজীবন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। অথচ উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য দেশের প্রশাসন চালানো ও নেতৃত্বদানের জন্য মেধাবী কর্মশক্তি গড়ে তোলা। শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা ঠিকই নিচ্ছেন তবে প্রশাসন এবং নেতৃত্বে তাদের সুযোগ সঙ্কুচিত।

উচ্চশিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ হলেও মান বাড়েনি। পরিকল্পনা ছাড়াই সরকার উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। বিচ্যুত হচ্ছে কর্মমুখী শিক্ষার পরিকল্পনা থেকে। কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণে কোনও উদ্যোগ নেই। শিল্পায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বব্যাপী কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।

উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের সংখ্যাই বেশি। পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোয় কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশ জাপানে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশই কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। সিঙ্গাপুরে এ হার ৫০ শতাংশ। এমনকি উন্নয়নশীল দেশ মালয়েশিয়ার কারিগরি শিক্ষার হার ৪০ শতাংশ।

অথচ বাংলাদেশে এ হার ২ শতাংশেরও কম। শিল্পায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে কল-কারাখানা অটোমোবাইল, টেক্সটাইল, ইলেক্ট্রনিক্স, গ্লাস, সিরামিক ও স্থাপত্যকলায় জনশক্তির চাহিদা। পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশ, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বাংলাদেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। স্বকর্মসংস্থানের জন্যও অনেকে উদ্যোক্তা হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তুলছেন।

এসব ক্ষেত্রে দরকার দক্ষ জনগোষ্ঠী। প্রয়োজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষাই পারে বেকারত্ব লাঘব করতে। সৃষ্টি হতে পারে নতুন কর্মক্ষেত্র। গুণগত মান না বাড়িয়ে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ নিয়ে সমালোচনা দীর্ঘদিনের।

অনেকেরই মত, সাধারণ মানের মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া অনুচিত। তারা বলছেন, উচ্চশিক্ষা শুধুই মেধাবীদের জন্য হওয়া উচিত। সাধারণ মেধাবীদের কর্মমুখী শিক্ষায় নিয়ে আসতেই তাদের পরামর্শ। যুক্তি দেখিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মেধাবীদের উচ্চশিক্ষিত করলে সামাজিক এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট হয়। জনশক্তিতে এরা বাড়তি বোঝা হয়।

অযোগ্যতার কারণে তারা কাজ পায় না। থাকে বেকার। অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন উদাহরণ দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিষয়ে ১৮-২০ জন শিক্ষার্থী থাকে। অথচ আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের জটলা থাকে। ২০০-২৫০ শিক্ষার্থীকে একটি বিষয়ে ভর্তি করা হয়, যাতে শিক্ষাদানের পরিবেশ ব্যাহত হয়।

তার মতে, উচ্চশিক্ষায় এত পরিমাণ শিক্ষার্থী না নিয়ে যোগ্য এবং মেধাবীদের স্থান দিতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.