আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্ণী টু চায়নাঃ(হংকং)- ৭

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

জার্ণী টু চায়নাঃ(হংকং)- ৭ আজ আমরা ঘুরে বেড়াবো কাউলুন সিটি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মিজ মিতসুইয়ার মত কোন নির্দ্দিস্ট স্থানের জন্য আমরা বেড়াবোনা। আমরা ঘুরবো যত্র তত্র। যেখানে সেখানে, যেমন খুশী তেমন করে। কিছুক্ষণ ঘুরতে ঘুরতেই আবার দেখা পেলাম সেই জাপানী বুড়ী মিজ মিতসুইয়া স্কাউট ভবনের এক কোনে কাচুমাচু করে বসে আছেন।

দেখে খুব অসুস্থ্য মনে হলো। আমাকে দেখে মলিন হেসে বললেন-সকাল পর্যন্ত ভালই ছিলাম। কিছুক্ষণ পুর্বে একবার বমি হবার পরথেকে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে-তাই একটু রেস্ট নিয়েনিচ্ছি। আমি তাঁকে বললাম-চলুন আপনাকে কোন ফ্রি ক্লিনিকে নিয়ে যাই কিম্বা আপনার হোটেলের ডাক্তারকে কল করি। তিনি বললেন-তার প্রয়োজন হবেনা।

আশা করি কিছুক্ষণ রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবো। আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। কিন্তু আমি আর সামনে যেতে পারছিনা। মন বলছে-এমন একজন বয়স্কা অসুস্থ্য মহিলাকে এভাবে রেখে আমার চলে যাওয়া ঠিক হচ্ছেনা। গতকালই এই বৃদ্ধা মহিলা কত্ত মমতায় আমার সন্তানকে নিজের সান ঝি (নাতী) মনে করে খাবার কিনে দিয়েছিলেন! অর্থাত মিজ মিতসুইয়া আমাকে তার সন্তানের মত ভেবেছেন, আর আমার সন্তানকে অসীম মমতায় তার নাতী ভেবেছেন।

আমার মনটা ক্যামন করে উঠল! আমার মা বেঁচে থাকলে এখন তাঁর বয়স কি মিজ মিতসুইয়ার মতই হতো কিম্বা কয়েক বছরের বড় হতেন। আমার মা এমন করে পথে কোথাও অসুস্থ্য হলে কেউ কি তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসতো? এমন সব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি আবার তাঁর কাছে ফিরেগিয়ে পাশে বসলাম। আমার কাছে এবং সুকসুখ'র কাছে সেল ফোন আছে-তাই যোগাযোগে কোন অসুবিধা হবেনা ভেবে সুকসুক এবং সাজিদকে এগিয়ে যেতে বললাম। আমার ছেলে আমাকে সাবধান করে বললো-আব্বু, আমার মনে হচ্ছে তুমি আবার** কোন বুড়োকে নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পরতে যাচ্ছো! হ্যা, আমিও বুঝতে পারছিলাম-আমি **"আবারো" কোন বুড়োকে নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছি। "আবারো জড়িয়ে" যাবার একটা কাহিনী আছে আমার জীবনে-তা পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিঃ- এক সময় আমরা কয়েক বন্ধু শিল্পকলা একাডেমীতে আড্ডা দিতাম।

সেই আড্ডাবাজদের ভিতর আমার এক শিল্পপতি বন্ধু(জনাব হেলালউদ্দীন) আছেন-যিনি হাইকোর্ট মাজারের একজন ভক্ত। মাঝে মাঝে তাঁর সাথে আমিও হাইকোর্ট মাজারে যাই দর্শক হতে। ১৯৯১ সনের কথা। শিল্পকলায় আড্ডা শেষে আমরা হাইকোর্ট মাজারে গিয়ে দেখি "পরানের বন্ধুরে বুড়ি হইলাম তোর কারনে..."/ "কোনবা পথে নিতাই গঞ্জ যাই..."-গান খ্যাত কাংগালিনী সুফিয়া মারাত্মক অসুস্থ্য হয়ে পরে আছেন রাস্তার পাশে। কোন এক পার্টীর অনুরোধে ঢাকা এসেছিলেন গান গাইতে।

প্রতি দিন গান শেষে ২০০ টাকা এবং ফ্রী খাওয়াদাওয়া করানোর কথা থাকলেও-৫ দিনে তাঁকে মাত্র ১০০ টাকা দিয়েছিলো সেই পার্টী! রিকশা থেকে পরেগিয়ে তাঁর হাত ভেঙ্গে গিয়েছে এবং বিনা চিকিতসা এবং অনাহার-অর্ধাহারে শিল্পী মারাত্মক অসুস্থ্য। আমরা দুই বন্ধুই তাঁর গানের ভক্ত। আমরা প্রথমে শিল্পীকে নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাকে ভর্তি করাই সেখানে। প্রায় ১৫ দিনের চিকিতসায় তিনি কিছুটা সুস্থ্য হলেন এবং হাসপাতাল কর্তিপক্ষ যথা নিয়মে তাকে রিলিজ করে দিলেন।

ডাক্তার এডভাইস করেছেন তাকে অন্তত আরো ২/১ মাস ঢাকায় রেখে চিকিতসা এবং ভালো খাবারের ব্যাবস্থা করলে শিল্পী পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যাবেন। এবার পরেছি এক মহা ঝামেলায়! তাঁকে কোথায় রাখবো? হেলাল ভাইর বৌ প্রথমেই না করে দিয়েছেন "ঐসব ঝামেলা" ঘরে না তুলতে। আমার বৌ-ও নাখোশ। আল্লাহ ভক্ত আমার বৌকে আমি বললাম-একজন ন্যাচারাল দরদীশিল্পী কিন্তু গরীব এবং অসহায় মানুষ। তাঁকে আমরা একটু সেবা যত্ন করলে আল্লাহ খুশী হবেন।

"আল্লাহ খুশী হবেন" বলার পরেও আমার স্ত্রী নিমরাজী। তারপরও আমি শিল্পীকে আমার বাসায় নিয়ে আসি। শিল্পীর যতসামান্য কাপড়-চোপর অত্যন্ত নোংড়া। অনেক দিন সাবান-পানি দিয়ে ভালোকরে শাওয়ার নাকরায় শরির থেকেও প্রচন্ড দুর্গন্ধ। শিল্পী পান এবং বিড়ি খান(সুযোগ পেলে গাঁজাও খান)।

যা আমার বাসায় এতোদিন সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। শিল্পী খকখক করে কাঁশে এবং কফ ফেলে ওয়ালে, খাটের পাশে। সেই সংগে পানের পিক ফেলাতো খুবই স্বাভাবিক! বাসার বাবুর্চী এমন কি কাজের বুয়াও শিল্পীকে থাকতে দেয়া রুমে যেতে চায়না! আমার ছেলেতো আমার সাথে কথা বন্ধ করেছে যেদিন তাঁকে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলাম-সেদিনই। ২/৩ দিন পর থেকে বৌও য়ামার সাথে কথা বলেনা। আমি অফিস থেকে ফিরে এবং অফিসে যাবার পুর্বে শিল্পীর সাথে কিছু কথা বলি-সেবা যত্ন করি।

কিন্তু শিল্পীর সাথে এবং আমার সাথে ঘরের কেউ কথা বলেনা। আমি "নিজভুমে পরবাশী"! এমন ঘটনা আমার জীবনে অনেক বার ঘটেছিলো। পারিবারিকভাবে আমাকে সেজন্য অনেক খেশারতও দিতে হয়েছিল যা আমার স্ত্রী এবং বড় ছেলের কাছে শুনে সেই কথাটাই আমার ছোটছেলে আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল! এযাত্রা আমার ভাগ্য খুবই ভালোছিল। আমি মিজ মিতসুইয়াকে তার হোটেলে নিয়ে যাই। হোটেলের ডাক্তার ডাকি।

ডাক্তার বললেন-সামান্য জ্বর এবং হাইপারটেনশন। সামান্য ঔষুধ দিলেন। মাথায় পানি দিতে এবং শরির ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতে বলেন। আমি পরম মমতায় তাই করি। আমার মনে হচ্ছিল-আমার মা অসুস্থ্য, আমি তাঁর সেবা শুশ্রুষা করছি...।

ঘন্টাখানেক পর তিনি স্বাভাবিকতা ফিরে পেলেন! সেদিন মিজ মিতসুইয়ার মুখে যে অনাবিল তৃপ্তি এবং সুখের আভা দেখেছিলাম এবং আমি যে মানষিক শান্তি পেয়েছিলাম-তেমন আমার জীবনে খুব একটা ঘটেনি। আমি তাঁকে কিছু খাবার খেতে অনুরোধ করি। তিনি জানালেন-যে খাবার তিনি খেতে চান-সেই খাবার এই হোটেলে পাওয়া যাবেনা। আমি তাকে আশ্বস্থ্য করলাম-খাবারের নাম লিখে দিলে আমি সেই খাবার হংকং'র যেকোন যায়গায় পাওয়া যাবে-সেখান থেকে আমি এনে দেবো। মিজ মিতসুইয়া পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েকবার বললেন-আরজি! আরজি!!(আমার ছেলে! আমার ছেলে!!)! কথাটা শুনে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল।

আমি চোখের পানি লুকিয়ে বললাম-নি মু কিন(তুমি আমার মায়ের মত)! মিজ মিতসুইয়া আমাকে কিছু খাবারের নাম লিখে দিলেন-যা তাদের দেশীয় ট্রাডিশনাল খাবার হবে। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটি জাপানী রেস্টুরেন্ট থেকে সেই খাবার আমি এনেদিলাম। খাবারের নাম "ওয়াংচুক"। একধরনে বনজ গাছ, লতা-পাতার স্যুপ। যাইহোক ডাক্তারের নির্দেশে মিজ মিতসুইয়া ওই দিন রেস্ট করলেন হোটেলেই।

আমি আবার ফিরে যাই আমার ছেলে এবং মিজ সুকসুক'র সাথে হংকং দেখার জন্য। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করুনঃ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।