আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বখাটেরা বেপরোয়া অসহায় অভিভাবক

আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি মনুষত্বে

মেয়েকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন—অভিভাবকদের এমন অভিযোগের অন্ত নেই। রাজধানীর রামপুরার এক গৃহবধূ জানান, তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত না করার জন্য তিনি এলাকার এক বখাটের পা ধরেছেন। তাতেও কাজ হয়নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি উত্তরার বাসা ছেড়েছেন।

বাসা পরিবর্তন করে এসে যেখানে মেয়েকে ভর্তি করেছেন, সেখানে এসেও ওই বখাটে মাঝেমধ্যে উত্পাত করার চেষ্টা করছে। রামপুরার ওই গৃহবধূর মতোই সারাদেশেই স্কুল-কলেজের মেয়েদের নিয়ে প্রতিনিয়ত চিন্তায় থাকেন অভিভাবকরা। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অভিভাবকরা মেয়ের নিরাপত্তার জন্য তাদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করেন। তারপরও রেহাই নেই। বেয়াড়া তরুণরা অভিভাবকের সামনেই উত্ত্যক্ত করে তরুণীদের।

অসহায় অভিভাবক সব মুখ বুজে সহ্য করেন। তারপরও ঘটে নানা অঘটন। থানা-পুলিশ এবং স্থানীয় মুরব্বিদের কাছে ধরনা দিয়েও পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। এ সমস্যা ইদানীং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কী পরিমাণ যন্ত্রণার শিকার হলে একজন তরুণী আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে—তা সহজেই অনুমেয়।

চোখের আড়ালে আরও অনেক ঘটনাই ঘটছে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে অভিভাবকরা সে ঘটনা গোপন রাখছেন। একের পর এক অঘটন ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকছে নীরব ভূমিকায়। ভুক্তভোগী অভিভাবকদের অভিযোগ, পুলিশের সাহায্য চাইলে বেশিরভাগ সময় তারা যথাযথ সাহায্যে এগিয়ে আসে না। তবে বেশিরভাগ সময়ই কোনো অঘটন ঘটলে পুলিশ দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে।

আসা-যাওয়ার পথে এবং স্কুল-কলেজের গেটে দেখা যায় ভিড় করে আছে দলে দলে বখাটে তরুণ, যুবক। এদের কাজই হলো মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। পাড়া-মহল্লায় টং-দোকানে আড্ডাবাজদের আলোচনার একটি বিষয়ই হচ্ছে এলাকার কোনো না কোনো দুরন্ত কিশোরীকে নিয়ে। সম্প্রতি ঢাকাসহ সারাদেশে এসব বখাটে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েও বেশিরভাগ সময় কাজ হয় না—এমন বহু অভিযোগ রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজের গণ্যমান্যদের কাছে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেক সময় এতে হীতে বিপরীতও হচ্ছে। এসব বখাটের উত্পাতে অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হচ্ছে কোমলমতি স্কুলছাত্রীদের। একের পর এক মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। মর্মান্তিক কোনো ঘটনার পর কয়েকদিন পুলিশ তত্পর হলেও কিছুদিন পর তা শিথিল হয়ে যায়।

আবারও সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শনিবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে স্কুলছাত্রী উম্মে কুলসুম ইলোরার মৃত্যুর পর তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন—এখন থেকে মেয়েদের স্কুলের সামনে সাদা পোশাকে পুলিশ পাহারা থাকবে। কিন্তু কতদিন এ ব্যবস্থা বহাল থাকবে, তা দেখার বিষয়। এর আগেও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হাঁকডাক দিয়ে বখাটেদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল।

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় রোমিওদের গ্রেফতারের জন্য ডিবির এই টিম আলাদাভাবে কাজ করবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিছুদিন পর সে অভিযানও থেমে যায়। সম্প্রতি পাড়া-মহল্লায় বখাটেদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। তাদের কটূক্তি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হচ্ছে কিশোরী-তরুণীদের। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারনেট আর আকাশ সংস্কৃতির কারণে এ যুগের ছেলেমেয়েরা কেউ পিছিয়ে নেই।

আগের চেয়ে মেয়েদের কাজের পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু তাদের নিয়ে কটূক্তি করা বন্ধ হয়নি। এ অপরাধের সাজাও তেমন গুরুতর নয়। পুরনো আইন-কানুনের ওপর ভর করে চলছে সব। সমাজববিজ্ঞানীরা বলছেন, যুগে যুগে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা হয়েছে।

আগে যেভাবে মুখ বুজে মেয়েরা এ নির্যাতন সহ্য করেছে, এখন আর সে ব্যবস্থা নেই। মেয়েদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত ঘরের বাইরে কাজ করতে হচ্ছে। তাই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে আগামীদিনে এ নিয়ে আরও ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে হবে। প্রায়ই বখাটেদের কারণে আত্মহননের ঘটনা ঘটছে। এ তালিকায় আছে সিমি, পিংকি, তৃষ্ণাসহ আরও অনেকে।

তিন বছর আগে রাজধানীর পল্লবীর আদর্শ নগরে সন্ত্রাসী টুণ্ডা মজিবর বাহিনীর অপমান থেকে বাঁচতে কিশোরী স্বপ্না (১৩) আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় পাড়ার বখাটেদের শাস্তি হয়নি। ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর খিলগাঁওয়ে বিষপানে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সিমি বানু। নারায়ণগঞ্জের চারুকলার ছাত্রী ছিল সে। মৃত্যুর আগে সিমির লেখা একটি চিরকুট তার মৃত্যুর ঘটনাকে আরও মর্মস্পর্শী করে তোলে।

চিরকুটে লেখা ছিল খিলগাঁও থানার দারোগা বাশার এবং ৫ বখাটের নাম। এদের প্ররোচনায়ই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ২০০২ সালের ১৭ জুলাই স্কুলছাত্রী সাফিয়া সুলতানা তৃষ্ণার আত্মহত্যা ছিল বহুল আলোচিত ঘটনা। ধর্ষণের গ্লানি থেকে রেহাই পেতে পুকুরে ডুবে মারা যায় সে। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মেহেদী, শাহিন ও আরিফের ফাঁসির আদেশ হয়।

২০০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পুঠিয়ার কাঠালবাড়িতে ঘটে যায় আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। বখাটেদের ধর্ষণের শিকার মহিমা সামাজিক ন্যায়বিচার না পেয়ে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। ওই ঘটনায় ৪ ধর্ষকের ফাঁসি ও ৬ অভিভাবকের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এ ঘটনার কিছুদিন পরই নওগাঁর স্কুল শিক্ষিকা সেলিনাকে একই পথ বেছে নিতে হয়। গ্রামের রেজাউল করিম নামের এক যুবকের ফাঁদে পড়ে তিনি ২০০৪ সালের আগস্টে আত্মহত্যা করেন।

২০০৩ সালের ১ অক্টোবর যশোরে স্কুলছাত্রী পারভিন সুলতানা বখাটেদের উত্পাত সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে স্কুলছাত্রী সেলিনা আক্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। স্কুলে যাওয়ার পথে বখাটেরা তাকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছিল। ২০০৩ সালের ১০ জুন খুলনার বয়রা মহিলা কলেজের মেধাবী ছাত্রী উত্তরা রায় মুক্তি এক প্রতারকের ফাঁদে পড়ে আত্মহত্যা করে। এছাড়াও ২০০৩ সালের ১৫ এপ্রিল খুলনায় ফারজানা আফরিন রুমি নামের এক কিশোরী (১৮) আত্মহত্যা করে।

রুমি ছিল ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মেধাবী ছাত্রী। ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর বাগেরহাটের চিতলমারীতে কলেজছাত্রী রুমা বড়াল এক শিক্ষকের ফাঁদে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। ২০০২ সালের ৬ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় আইএসটিসি ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র ছাত্রী উসামা আত্মহত্যা করেছিল। স্বজনরা জানান, এর পেছনেও রয়েছে বখাটেদের উত্পাত। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বখাটের উত্পাতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামির কঠিন কোনো সাজা হয় না।

আবার কখনো মামলা করলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের কারণে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ধর্ষণজনিত মামলার বিচারে মৃত্যুদণ্ড হলেও প্ররোচনার মামলায় আসামিদের তেমন সাজা হয়নি। আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে পরিবারকে হুমকি দেয়। খিলগাঁওয়ে নিহত চারুকলার ছাত্রী সিমির বেলায় তেমনই হয়েছে।

আসামিরা বেরিয়ে এসে সিমির পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে বলেও ওই পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে তারা একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন। এমনকি সংবাদ সম্মেলন করেও প্রতিকার চেয়েছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.