আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড়ী স্বীকারোক্তি

www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
সমুচ্চ পাহাড়ের ঐ কালো চূড়ার উদ্দেশ্যে তাকাইয়া হঠাৎ কতিপয় সমতল-মানবের মনে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হইতেই পারে যে বিবর্তনের সূচনা কিরূপে হইয়াছিলো? সমতল-মানসের এই আকস্মিক কৌতূহল নিবারণে সেই মুহূর্তে তাহাদের 'সমতল' অবধারণ তাহাদের সুবিশাল 'সমতল' বোধসমূহের জ্ঞানভাণ্ডার চষিয়া এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হইলো যে সমতলের মৃত্তিকাই কোন এক সুদূর অতীতে দলা পাকাইয়া, কুঞ্চিত হইয়া, ঊর্ধ্বপানে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছুটিয়া গিয়াছিলো! তাহা হইতেই বোধকরি সূচিত হইয়াছিলো ঐ উন্নত বরিষ্ঠ উচ্চভূমির। উহা আদতে সমতলই বটে! উহার চর্মে সমতল-মৃত্তিকার গন্ধ আজ অবধি লাগিয়া রহিয়াছে। উহার সবুজ পল্লবের খাঁজে খাঁজে আজও দোল খায় সমতলের পক্ষীকুল। উহার নিটোল কক্ষপথের ভাঁজে ভাঁজে আজও চরিয়া খায় সমতলের প্রাণীকুল। শুধু বাধ সাধিলো উহার শরীরের উপর কীটের মতন বাঁচিয়া থাকা অ-সমতল মানবসম্প্রদায়।

এ কী হইলো! তোমরা কোথা হইতেই বা আসিলে? কেনই বা আমাদের ঐ জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সমতলের মৃত্তিকা কর্ষণ করিয়া তোমরা তোমাদিগদের ক্ষুধা নিবারণ করিতেছো? কেনই বা তোমাদিগদের দিকে আমাদের মাথা উঁচু করিয়া তাকাইতে হয়? সমতলের এত ঘনবসতিপূর্ণ বাসস্থানে বসবাস করিতে গিয়া যখন আমাদিগদের নাভিশ্বাস উঠিতেছে, তখন কী পরমানন্দেই না তোমরা বিচরণ করিতেছো তোমাদিগ কর্তৃক সৃষ্ট ঐ স্বর্গরাজ্যে। কিহ্! তোমরা এইপ্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারিলে? এই প্রকাণ্ড জনবিস্ফোরণের লাগিয়া কি আমরাই নৈতিকভাবে দায়ী? কখনই নহে! তোমাদের বীর্যই তো পাহাড়ের ঢালে-ঢালে গড়াইয়া-গড়াইয়া সমতলে উপবিষ্ট হইয়াছে, আর তাহাতেই কিনা আমাদের যত প্রবৃদ্ধি! ওহে অবাঙালী! তোমরা কি আমাদের এই ত্রাহী ত্রাহী রব শুনিতে পাইতেছো না? অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার পৃষ্ঠপোষক তোমরা কী ভীষণ দুঃসাহসে বানাইয়াছো তোমাদিগদের ঐ জগত! গড়িয়া তুলিয়াছো প্রাসাদ-মন্দির। ওহ্! কী ভীষণ দুরাত্মার অধিকারি সত্তা তোমরা! শিখিয়াছো কী সাংঘাতিক দুরাচার! আফসোস ইহাই যে তোমরা আজও সভ্য হইতে পারিলে না। করিলেনা সংস্কৃতি-চর্চা। খাইতে শিখিলেনা পাঁচশত টাকার পান্তা-ভাত।

একবিংশ শতাব্দীর ঝাণ্ডাধারী সমতল-মানবদের তোমরা পিছ টানিয়া ধরিয়া রহিয়াছো। আগাইতে পারিতেছি না আমরা তোমাদিগদের জন্যই। তোমাদিগদের বিবিধ সমস্যা সমাধান করিতেই তো আমাদের নির্ঘুম প্রহর কাটাইতে হইতেছে। তোমাদিগদের লাগিয়া পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বরাদ্দ করিতেই তো আমরা চালু করিয়াছি এক নূতন ঔপনিবেশিকতা। তোমরা কি ভুলিয়া গিয়াছো? তোমরা কি ভুলিয়া গিয়াছো যে এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ঐশ্বরিক ছোঁয়ায় তোমাদিগদের শতসহস্র ভূমি জলের তলায় বিরাজমান বলিয়াই তো আজ আমরা পাইয়াছি পেদা-টিং-টিং।

গড়িয়া তুলিয়াছি পর্যটন! অবসর পাইলেই হাজার হাজার ভ্রমনপিপাসু সমতলমানব যখন তোমাদিগদের উদ্দেশ্যে কী এক দুর্নিবার তাড়ণায় ছুটিয়া যায়, খাঁচার অভ্যন্তরীণ শাখামৃগ দেখিবার মতন তোমাদের দেখিয়া হইয়া উঠে প্রফুল্ল ও উৎফুল্ল, অতঃপর আলুর-খোসার উচ্ছিষ্টান্ন যত্র-তত্র ফালাইয়া বন্দোবস্ত করিয়া দেয় কতিপয় প্রাণীর জীবিকা আহরণের, তাহা তো তোমাদিগদের সমৃদ্ধির জন্যই! তোমাদিগদের সমৃদ্ধিই তো দেশমাতৃকার সমৃদ্ধি, কারণ তোমরা তো এই দেশের সম্পদ নহো। তোমরা এই দেশের সম্পত্তি। তোমাদের নিয়া তাই সমতলে চিন্তার কুল নাই। তর্কের শেষ নাই। হে অবাঙালী! মৃত্তিকার মূল্য তোমরা কী বুঝ! সমতলের মানবরা বোঝে।

রক্ত ঝরাইয়াছি মোরা এই ভূখণ্ডের লাগিয়া। রক্ত কেমন লাল হইতে পারে উহা তোমাদিগদের বোধগম্যতার বাহিরে। এই ভূখণ্ডের গলি-ঘুপচি এখন আমাদিগদের। প্রয়োজন পড়িলেই আমরা ডাকিয়া আনি এক স্মৃতিকাতর জীবাশ্ম, কারণ সম্মুখে অগ্রসর হইতে হইলে আমাদিগদের যে পিছনে ফিরিয়া তাকাইতেই হয়। সমতল-মানবরা কি ভুলিতে পারে সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ তাজা প্রাণের কাতরতা? অথবা ভগিনী-সহধর্মিণীর আতঙ্ক-চক্ষুর উপর সারমেয়-ছায়ার পিশাচসিদ্ধ হাসি? স্বাধীনতা বলিতে তুমি কি বুঝো অবাঙালী! শুধু জীবনভর ঘামরক্ত ঝরায় সমতলের যে মানবসম্প্রদায়, যাহাদের ঘামরক্তের নির্যাস পাইয়া খুশীতে দুলিয়া উঠে হেমন্তের ধানের শীষ, যাহাদের রক্তশূন্য সাদাটে চোখের প্রতিচ্ছায়া ভাসে সমতলের সমস্ত সাদাভাতের থালায়, তাহাদের লাগিয়া কিঞ্চিত ভূখণ্ড যখন আমরা বরাদ্দ করিতে পারি নাই, পারিলেও যাহা ঠাঁই পাইয়াছে স্বাধীন দৈত্য-মানুষের তলাবিহীন উদরে, যাহারা এই ভূখণ্ডের অখণ্ড রূপখানি গোগ্রাসে গিলিতে ব্যস্ত, লাল-সবুজ নিশানের অন্তরালে যাহারা আজ অবধি হাসিয়া চলিয়াছে বিকৃত সেই ক্রূর হাসি, তখন ইহাই প্রতীয়মান হয় যে সমতল-মানবসম্প্রদায় তাহাদের কবর খুঁড়িয়া চলিয়াছে, তোমাদিগদের সমুচ্চ-ভূমির গোর-মৃত্তিকা আজ তাই এক অনন্য আবশ্যকতা।

মৃত্তিকার আগ্রাসন তোমরা ঠেকাইতে পারিবে না, হে অবাঙালী, স্বাধীনতা পরবর্তী নৈরাশ্যবাদী কিন্তু ভড়ংশূন্য এক অনুতপ্ত প্রজন্মের নিকট হইতে ইহাই তুমি শুনিয়া রাখো আজ।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।