আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী : একটি সভ্য সংসদও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো

অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি

মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যক্তিপর্যায়ে এটা আপনাকে আমার তৃতীয় খোলা চিঠি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এবং সারাদেশে ছাত্রলীগের নৈরাজ্যের সমালোচনার পর এবার নির্বাচিত সাংসদদের অসভ্যতার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো আমার নিজের নয়, কথাগুলো আপনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, যাকে জাতির পিতা মানি। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ওই সংসদভবনে, স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের অধিবেশনে তার মুখ থেকে এসব কথা বের হয়েছিলো। জানি প্রটোকলের দেয়াল ভেঙ্গে এসব কথা আপনার কানে কখনোই পৌছাবে না, আপনার চোখে পড়বে না এই চিঠি।

তারপরও নিজের বিবেককে স্বান্তনা দিতে লিখছি। তার আগে ব্যক্তিগত কিছু কথা বলার সুযোগ ছাড়ছি না। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে নিজের ভোটটি নিজে দিতে পারার সেই সৌভাগ্যবানদের একজন আমি। চোখ বেধে মার্কার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত বলেই হয়তো কাকে নির্বাচিত করছি সে ব্যাপারে অন্ধ থাকি। এ আমার পাপ হয়তো।

কারণ দীর্ঘদিন আগে সেই স্বৈরাচারের আমলে যখন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, মাঠে ঘাটে কর্মীদের, দলের দুঃখে-দুর্দিনে পাশে থাকা নেতাদের এড়িয়ে ব্রিফকেস ভর্তি টাকার মালিকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সংস্কৃতি জন্ম নিলো, সেদিন থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সর্বনাশের সূচনা। কারণ তখন বিপন্ন নেতারাও বুঝে গেল যে কোনো মূল্যে টাকা কামাতে হবে। কোটি টাকা চাঁদা, কোটি টাকা নির্বাচনী ব্যয় উশুলের সেই সংস্কৃতিতে কিছু বর্বর, কিছু অশিক্ষিত আনকালচার্ড কুথও আমাদের সর্বোচ্চ আইন পরিষদের দায়িত্বে এলো। এরা ক্যাডার দিয়ে এমপি হোস্টেলের রুম দখল, ন্যাম ভবনের ফ্লাট, শুল্কমুক্ত গাড়ি আর নির্বাচনী এলাকায় ঠিকাদারীর কমিশন ছাড়া সাংসদদের কোনো অধিকার বোঝে না। এরা সংসদে বক্তৃতা বলতে বোঝে দলীয় নেতা কিংবা নেত্রীর তোষামুদি।

একদিন সাধারণের কাতারে বসে টেলিভিশন দেখবেন, নিশ্চিত আপনি বিব্রত হবেন, আপনি লজ্জিত হবেন। এজন্য হবেন কারণ আপনাকে আমি পাশ থেকে প্রম্পট করার জন্য মোহাম্মদ নাসিমের মতো নেতাকে প্রকাশ্য জনসভায় বকা দিতে দেখেছি। সম্ভবত সিরাজগঞ্জে যমুনা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিলো সেটি। একজনকে বক্তৃতা পাশ থেকে কথা শিখিয়ে দেয়ার মতো অসভ্যতা যখন অপছন্দ করতে পারেন, এইসব তোষামুদিও আপনার অসহ্য লাগা উচিত। কারণ স্বাধীনতার প্রজন্ম হিসেবে এটাই দেখে এসেছি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকই শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুকে গালি দেনেওয়ালাদের চেয়ে তার ভাবমূর্তির বেশী সর্বনাশ করেছে এইসব তোষামোদের দল।

এই তোষামুদির সংস্কৃতি প্রশ্রয় দেন বলেই, আজ আমাদের সংসদে গালি গালাজ আর ধর-শালাও শুনতে হয়। অথচ আপনি সেই পিতার কন্যা যিনি তার শাসনামলে স্রেফ দূর্নীতির অভিযোগে ৪৬ জন নির্বাচিত সাংসদকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এইসব তোষামুদি বন্ধ করুন। সাংসদদের টু দ্য পয়েন্ট কথা বলার নির্দেশ দিন। দেশ, তার নির্বাচিত এলাকা, তার ভোটারদের সমস্যা দিয়ে কথা বলতে বলুন।

আমরা বাঙালীরা অন্যের প্রশংসা সইতে পারি না। আমাদের গা জ্বলে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর মতো আপনাকেও সাধারণ মানুষের শত্রু বানাচ্ছে তোষামোদকারীরা মাখনমাখানো কথা বলে। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে এসব হয় কিনা জানি না, এসব মানে এইসব তোষামুদি। সাংসদদের বাধ্যতামূলকভাবে এসব উন্নত দেশের অধিবেশনগুলোর কালচার শিখে আসা উচিত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবার যাই জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তৃতায়, যা কার্যবিধিতে এখনও আছে কিনা আমার জানা নেই, তার নাম, স্মৃতি, কথা গুম করার সেই নীলনকশায় এখনও আছে কিনা তা। নীচের কথাগুলোই তার বক্তৃতায় বলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী : জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ভুললে চলবে না এবং সদস্য ভাইদের আমি বলি যে, আমরা গণপরিষদের সদস্য। সদস্যদের একটা বিধি প্রণালী আছে, এর বাইরে প্রশ্ন করবার অধিকার নাই। এটা পার্লামেন্টারি কনভেনশন।

আমি আপনার মাধ্যমে আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করবো, দেখবেন, শেখবার চেষ্টা করবেন। আমরা বহুদিন পার্লামেন্টারি কাজ করতে পারিনি, আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। ১৯৫৮ সালের ‘মার্শাল ল’ জারির পরে পার্লামেন্ট হয়নি। সেজন্য আমরা সুযোগ পাইনি পার্লামেন্টারি রাজনীতি কাকে বলে এবং গণপরিষদ কাকে বলে তা শেখার। সেইজন্য আমাদের কিছু অসুবিধা হয়।

তাই বহুদিন পর সদস্যরা এসে কথা বলতে চায়, যদিও সেটা অনেক সময় বিধি বা রুলসের বাইরে হয়। আমি আপনার মাধ্যমে অনুরোধ করব যখন একজন কথা বলেন, তখন অন্য কারো বাধা দেওয়া উচিত নয়, এরূপ নিয়ম নাই। আমি আপনার মাধ্যমে জানাতে চাই যে গণপরিষদ একটা সুপ্রীম বডি, আমাদের ব্যবহারে বাইরে এমন কিছু প্রকাশ হওয়া উচিত নয় যাতে জনসাধারণের কাছে আমাদের ইজ্জত নষ্ট হয়। আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে, যেসব রুলস রেগুলেশন এবং বিধি আছে, তা আপনি অনুসরণ করেন। আমি এই হাউজের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি, আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব।

মেম্বারদের আরেকটা বিষয়ে হুশিয়ার করতে চাই। স্পিকার যখন কথা বলেন, তখন আর কোনো মেম্বারের অধিকার নাই কথা বলার। বললে আপনি মেহেরবানি করে তাকে পরিষদ থেকে বের করে দিতে পারেন। অধিবেশনের সমাপ্তি বক্তৃতা থেকে সংযুক্তি : জনাব স্পিকার সাহেব, আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদ সদস্যদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না, অনেকদিন পর আমরা এখানে বসার সুযোগ পেয়েছি।

তাই আমরা পরিষদ বিধি না মেনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। কিছুদিন আপনাকে এটা সহ্য করতে হবে। কারণ সদস্যরা বহুদিন পর এখানে বসবার সুযোগ পেয়েছেন। সকলে এখন পর্যন্ত সব জিনিস দেখার সময় পান নাই- গণপরিষদ কার্যপ্রণালী বিধিতে কি আছে, তাও দেখবার সময় পান নাই। তাই মাঝে মাঝে দুয়েকটা কথা এদিক-ওদিক বলে ফেলেছেন।

আমি আপনার মাধ্যমে গণপরিষদ সদস্যদের বলতে চাই যে, আপনারা কটাক্ষ করে কাউকে কিছু বলবেন না। কারও প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলা উচিত নয়। কোন সদস্য অন্য কোন সদস্যকে সম্বোধন করে কথা বলতে পারেন না। সকল মেম্বারকেই জনাব স্পিকারকে সম্বোধন করতে হবে- এটা সকল সদস্যের জানা দরকার। আমি আবার সদস্যদের অনুরোধ করছি।

আপনারা কারো প্রতি কটাক্ষ করে এই পরিষদে কোন কথা বলবেন না। আমার আর একটি আবেদন এই যে, আপনারা যে গণপরিষদের সদস্য একথা যেন ভুলে না যান। আমি আপনার মাধ্যমে সদস্যদের আরো বলতে চাই যে, পরিষদে একজন কথা বলতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন দাঁড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। এতে পরিষদের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে এবং এর দ্বারা প্রমাণিত হবে, আমরা পরিষদ সদস্য হবার যোগ্য নই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

চিঠির শেষে এটুকুই বলতে চাই বঙ্গবন্ধুর অনেক অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার আপনার। কিন্তু উপরের বক্তৃতায় পরিষ্কার উনি একটি সভ্য সংসদে সভ্য সাংসদও দেখতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করা যায় না? একজন লজ্জিত নাগরিক, একজন বিব্রত ভোটার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.