আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংশোধিত শ্রম আইন নিয়ে বিভ্রান্তি

সংশোধিত শ্রম আইন বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকেরা আর্থিক সুবিধা ও লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হবেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। মালিক নানা অজুহাতে যেকোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করতে পারবেন। কিছু ক্ষেত্রে সংশোধিত আইনটি ২০০৬ সালের শ্রম আইনের চেয়েও খারাপ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মত দিয়েছেন।
সংশোধিত আইনটি পোশাকশিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং অংশগ্রহণকারী কমিটি-সংশ্লিষ্ট ধারায় কিছু শব্দ যুক্ত করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।

একাধিক শ্রমিকনেতা বলছেন, এই আইন পোশাকশিল্প পরিস্থিতির পরিবেশ উন্নতি করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে না। তাঁরা সরকারকে আরও মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারা বাদ দিয়ে আইনটি যেন সংসদে পাস করা হয়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় শ্রমনীতি পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। এ ব্যাপারে ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী শ্রম আইনের সংশোধন হয়নি।
শ্রমসচিব মিকাইল শিপার প্রথম আলোকে বলেন, শিল্প টিকিয়ে রেখে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করাই এই আইন সংশোধনের মূল উদ্দেশ্য।

তিনি বলেন, আইনটি আগের চেয়ে ভালো।
তবে পাঁচ হাজার বা তার বেশি শ্রমিক আছেন এমন প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা বা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলে তাঁদের বিমার আওতায় আনার বিষয়গুলো আইনের ভালো দিক বলে উল্লেখ করেছেন শ্রমিকনেতারা।
গত ২২ এপ্রিল মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর সংশোধনী প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। ১৩ মে মন্ত্রিসভায় সংশোধনীটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। আগামী সংসদ অধিবেশনে আইনটি ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৩’ নামে পাস হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


কেন শ্রমিকবিরোধী: সংশোধনীতে বলা হয়েছে, (ধারা ২৩-৩) প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খল বা দাঙ্গা-হাঙ্গামামূলক আচরণ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অন্যের কাজে বাধা দেওয়া অথবা শৃঙ্খলাহানিকর কাজ করলে মালিক ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে শ্রমিককে বরখাস্ত করতে পারবেন। আইনে বলা হচ্ছে, অসদাচরণের কারণে শ্রমিক বরখাস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
আমেরিকান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল লেবার সলিডারিটির জ্যেষ্ঠ আইন পরামর্শক এ কে এম নাসিম বলেন, মালিকপক্ষ শ্রমিকের যেকোনো অসদাচরণকে শৃঙ্খলাহানিকর উল্লেখ করে এই ধারায় চাকরিচ্যুত করতে পারবে। এবং শ্রমিক কোনো ‘সার্ভিস বেনিফিট’ পাবেন না। এ রকম একাধিক ধারা শ্রমিকের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।


ধারা ৪(১১)-এর সংশোধনীতে বলা হয়েছে, জরুরি কাজে অথবা অপরিহার্য কারণে স্থায়ী ধরনের কাজে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী বা ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে। শ্রমিকনেতারা বলছেন, এই বিধানটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এই ধারার সুযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ দীর্ঘস্থায়ীভাবে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করার চেষ্টা চালাবে।
শ্রম আইনের ২৭(৩) ধারার সংশোধন শ্রমিক অসন্তোষ বাড়াবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছেন। এতে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে শ্রমিককে ১০ দিনের সময় দিয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ও চাকরিতে যোগ দিতে নোটিশ দিতে পারবেন মালিক।

শ্রমিক নির্ধারিত সময়ে ব্যাখ্যা দিতে বা চাকরিতে যোগ না দিলে তাঁর চাকরির অবসান ঘটবে এবং কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। শ্রমিকনেতারা বলছেন, একজন শ্রমিক ২০ বছর সন্তুষ্টির সঙ্গে কাজ করার পর মালিক চাকরিচ্যুত করলেও ওই শ্রমিক কোনো ‘সার্ভিস বেনিফিট’ পাবেন না, এটা অন্যায়।
শ্রম আইনে সব সময় প্রতিষ্ঠানের ৫ শতাংশ লভ্যাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করার একটি আইনি ব্যবস্থা ছিল। বর্তমান আইনে বলা হচ্ছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে এই লভ্যাংশ দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তার পরিবর্তে ক্রেতাদের সম্পৃক্ত করে একটি কল্যাণ তহবিল গঠন করার কথা বলা হয়েছে।


এ প্রসঙ্গে ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, লভ্যাংশ শ্রমিককে দেওয়ার বিধানটি পোশাকশিল্পের মালিকেরা কখনো মানেননি। তাঁরা কোটি কোটি পাওনা টাকা থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করেছেন। পোশাকশিল্পে এই ৫ শতাংশ লভ্যাংশ না দেওয়ার বিধানটি শ্রমিকদের পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করার শামিল। অন্যদিকে এই তহবিল গঠন খুবই অনিশ্চিত একটি বিষয় এবং বাস্তবে এটা শ্রমিকের কাজে লাগবে না।
এই বিশেষ ধারা সম্পর্কে শ্রমসচিব বলেন, আগের আইনটি কোনো দিন বাস্তবায়িত হয়নি।

যে আইন বাস্তবায়িত হয়নি, তা না রেখে পরিবর্তন করা ভালো। ভালো উদ্দেশে এই পরিবর্তন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এ কে এম নাসিম বলেন, আগের আইনটি বাস্তবায়িত না হওয়ার দায়দায়িত্ব সরকারের। সরকার আইন মানতে মালিকপক্ষকে চাপ দেয়নি, বাধ্য করেনি। আইন বাস্তবায়ন না করার জন্য কাউকে শাস্তিও দেয়নি।


বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, উদ্যোক্তারা শ্রমিকের স্বার্থ দেখেন না, এটা ভুল কথা। উদ্যোক্তারাই মজুরি বোর্ড গঠনের কথা বলেছেন। নতুন আইন সম্পর্কে তিনি বলেন, শ্রমিক ও উদ্যোক্তা উভয়পক্ষই যেন লাভবান হয়, সে দিকে লক্ষ্য রেখেই সরকার আইন করেছে।
এবারও ইউনিয়ন হবে না: শ্রমিকসংগঠনগুলোর বহুদিনের দাবি ছিল, আইএলও কনভেনশনের আলোকে শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু সেই দাবি পূরণ হলো না।


শ্রমিক অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, শ্রম আইনে কখনোই ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু মালিকেরা কখনো চাননি পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠুক। এ ক্ষেত্রে সরকারও নানাভাবে মালিকপক্ষকে সহায়তা করে গেছে।
আইএলও কনভেনশনে (৮৭) বলা হয়েছে, সংগঠন করা ও নেতা নির্বাচন করা শ্রমিকের অধিকার। বাংলাদেশ ওই কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশের আইনেও ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃত। তার পরও পোশাকশিল্পে ৯৯ শতাংশ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নেই। ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে নিবন্ধন করার জন্য শ্রম পরিচালকের দপ্তরে আবেদন করতে হয় শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের নামের তালিকাসহ। ২০০৬ সালের আইনে বলা ছিল, আবেদনপত্র পাওয়ার পরপরই শ্রম পরিচালক তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিককে অবহিত করবেন। কল্পনা আক্তার বলেন, মালিকপক্ষ তালিকা পাওয়ার পরই শ্রমিকনেতাদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেয়, চাকরিচ্যুত করে।


শ্রমিকনেতারা বলেছেন, পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার চেষ্টার শুরুতেই অনেক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করেছে, হয়রানি করেছে, মারধর করা হয়েছে। এ রকম নজির আছে। শ্রমিকেরা কাজ হারানোর ভয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার আর চেষ্টাই করেননি। তিনি বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন শিল্প বিকাশের সহায়ক।
সংশোধনীতে পরিচালকের পক্ষ থেকে মালিকপক্ষকে শ্রমিকের তালিকাসহ আবেদনপত্র পাঠানোর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।

মিকাইল শিপার বলেন, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার বিষয়টি আগের চেয়ে সহজ করা হয়েছে।
কিন্তু শ্রমিকনেতারা মনে করছেন, এতেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, ঘুষ নিয়ে বা অন্যভাবে মালিকপক্ষ এই কাগজ সংগ্রহ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সরকারপক্ষকে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ করে দিতে হবে।
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১০ শতাংশ কারখানায় এখন ট্রেড ইউনিয়ন আছে (শ্রমিকনেতারা বলছেন ১ শতাংশ)।

জোর-জুলুম করে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না, এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।
অংশগ্রহণকারী কমিটি: শ্রম আইনে আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে ৫০ জন শ্রমিক থাকলেই সেখানে মালিক ‘অংশগ্রহণকারী কমিটি’ গঠন করবেন। কমিটিতে মালিক ও শ্রমিকের প্রতিনিধি থাকবে। এই কমিটি পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, সমঝোতা ও সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা চালাবে, শ্রম আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করবে।
বিজিএমইএর নেতা আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৭০ শতাংশ পোশাক কারখানায় অংশগ্রহণকারী কমিটি আছে।

এসব কমিটি শ্রমিকের স্বার্থ দেখে।
মালিকপক্ষের এই দাবি অস্বীকার করেছেন শ্রমিকনেতারা। তাঁরা বলছেন, ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প ‘অংশগ্রহণকারী কমিটি’ হতে পারে না। মালিকপক্ষ অংশগ্রহণকারী কমিটিকেই সামনে এনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এ কে এম নাসিম বলেন, মালিকেরা বিভিন্ন কারখানায় নিজেদের পছন্দের লোক নিয়ে কমিটি গঠন করেছেন।

এই কমিটি মালিকের কথামতো চলে। এরা শ্রমিকের স্বার্থ দেখে না।
বাবুল আখতার বলেন, কোনো বিরোধ দেখা দিলে অংশগ্রহণকারী কমিটির মাধ্যমে কীভাবে তার নিষ্পত্তি হবে, আইনে তা বলা নেই। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তার নিষ্পত্তির আইনগত নানা বিকল্প ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, অংশগ্রহণকারী কমিটি মূলত শ্রমিকের অধিকার হরনের একটি পন্থা।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.