আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিরাজ সিকদার, যে কথা বলতে হবে



রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে তবু সাহসের পতাকা আজও উড়ে .......লেখাটি আমি গত ৩০ জানুয়ারি সামুতে পোস্ট করি। কিন্তু বঝুতে পারছি না কেন লেখাটি আমার পোস্টে নাই। তাই পুনরায় পোস্টটি দিলাম। (লেখাটি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত অনুশিলন পত্রিকার জন্য দিয়েছিলাম। পত্রিকার সম্পাদকের স্বাধীনতা বলে একটা কিছু দাবীর বুনিয়াদে পত্রিকাটির সম্পাদক খোমেনি এহসান আমার লেখার ভূমিকাটি ফেলে দিয়ে অর্ধ বিকৃত করে ছেপেছেন, যার ফলে আমার পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে এক ধরণের পতিক্রিয়া আমি ল্য করেছি।

তবে আমি সম্পাদকের এহেন গর্হিত কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম না দিয়ে চুপচাপ বিষয়টি হজম করার চেষ্টা করছিলাম। এখন মনে হচ্ছে লেখাটি আবারও পুরোটাই প্রকাশ করা দরকার- লেখক) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতা আছে ল্যাতিন আমেরিকার মহান বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে নিয়ে ‘চে তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়। ’ অসাধারণ এই কবিতাটি পড়লে রাগে ক্ষোভে বিক্ষোভে আত্মঘাতি হয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। চে গুয়েভারা আজ ল্যাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বিশেষত তরুন তরুনীর আইকন হিসেবে। কিন্তু যতোটা না তার কমিউনিস্ট বিপ্লবী তথা শ্রেণী সংগ্রাম সমাজতন্ত্র আর শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্টার নায়ক হিসেবে তার চেয়ে বেশি পুঁজিবাদের অনুসঙ্গ হিসেবে।

অনেকে হয়তো আতকে উঠতে পারেন, কমিউনিস্ট চে মরে গিয়ে পূঁজিবাদকে সেবা করছে, এ আবারা কেমন কথা! তবে বাস্তবতা হলো এই যে সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট আইকনের বিপরীতে চে হয়ে উঠেছে পুঁজির পন্যের মুনাফার সর্বোচ্চকরণের জন্য তার মডেল হয়ে। তাইতো মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে দেখা যায় মদের বোতলে অথবা অর্ন্তবাসে। তাও বোধ হয় ভালো যে নারীর হ্র“দয়ের গভীর উত্তাপে তিনি থাকেন সর্বদা। পুঁজিবাদের এই হলো শক্তি যে, পুঁজি তার মুনাফার জন্য পুঁজিবাদের বিপরীত আর্দশকেও কাজে লাগিয়ে থাকে। যেমন ইসলাম একটি সামন্ততান্ত্রিক ধর্মব্যবস্থা (সব ধর্মই সামন্ততান্ত্রিক) হওয়ায় তার মধ্যে পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সংস্কৃতি তাকেও পুঁজিবাদ তার মুনফা পুনারোৎপাদনের কাজে লাগিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী হাসপাতাল সহ এমনি হাজারো সহি ইসলামী ভাবধারার নামে। ইসলামী চিন্তা পদ্ধতিতে সুদ হারাম, কিন্তু ইসলামী ব্যাংকে সুদের পরিবর্তে মুনাফা দিতে প্রস্তুত থাকায় সেখানে মমিনদার মুসলমানদের ধর্মও রা পায় আবার মুনাফাও রা পায়। সুদ এখানে মুনাফায় রুপান্তিরত হয়। আর এ কারনে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা টিকে যাচ্ছে কারন সে সমাজের উপরি কাঠামোতে এক ধরণের শক্তিশালী হেজিমনি বিস্তার করতে পারছে এবং তার পুনোরুৎপাদন কাঠামো পরিচালনা করতে পারছে। তবে আমার আলোচনা পুঁজিবাদের উপরি কাঠামো নয়।

আমর দৃষ্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ সিকদারকে নিয়ে কিছু বয়ান। ভয়ান ভারি না করার জন্য অনুশিলন সম্পাদকের কাছ থেকে বার বার তাগিদ থাকায় আমি তাকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দু;স্বপ্নের কিছু কথাবার্তা বলবো। যদিও সিরাজ সিকদারের অগনিত প্রগতিশীল বিরাট বিরাট মাথার পণ্ডিতেরা আমাকে এ জন্য ভিষণ বকাঝকা করবেন, বলবেন এভাবে তাকে চে বাদী বানিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। তবুও আমি আমার স্বপ্নের কথা বলতি চাই। সিরাজ শিকদার বাংলার রাজনীতিতে অপাঠ্য এক অধ্যায়।

কেউ তাকে বাংলার চে গুয়েভার, চারু মজুমদার আর কেউবা তাকে সন্ত্রাসবাদীদের নেতা মনে করেন। আমাদের ইতিহাস সব সময় সাদা আর বিজয়ীদের পে উকালতি করতে করতে বিজয়ীদের সভাকবিতে পরণিত হয়েছে। আর যাইহোক সবা কবির বয়ানে বিজয়ীদের লুণ্ঠন উঠে আসেনা। অথবা বলা যেতে পারে সত্য উদ্বঘাটনে কখনোই আমাদের ইতিহাস মনোযোগী ছিলো না, এখনো নেই। কিম্বা বলা যেতে পারে ইতিহাস হলো বিজয়দের আর সেখানে পরাজয়ীরা পড়ে থাকে অনাদরের হীমঘরে।

ইতিহাস যাই বলে বলুক, আমি তাকে দেখছি সাহসের পাহাড় ডিঙানোর নায়ক হিসেবে। ইতিহাসতো বর্ণবাদী উচ্চ শ্রেণীর। তা না হলে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধাদের কি সন্ত্রাসী আর সাদা বৃটিশ ঔপনিবেশিক দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনকে বলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন? এই হলো ইতিহাসের এলেমবোধ। কিন্তু এই জনপদের মানুষতো জানে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি আর ভগত সিংদের সাহস ও ভালোবাসার উপখ্যান। তো সিরাজ সিকদারও সেই উপখ্যানের মহানায়ক ছাড়া আমি আর কিইবা বলতে পারি।

আজকের ডিজে আর ডিজুস প্রজন্ম সাহসের সীমানা কতদূর? যারা ইকারুসের কথা জানেন তারা স্বীকার করবেন যে, ইকারুসের বাবার ভবিষৎ বাণী অমান্য করে মোমের পাখনায় ভর করে উড়ে গেলো সূর্যের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে গলে গেলো তার মোমের পাখনা। ইকারুস সাগরের জ্বলে ডুবে মারা গেলেন। তবে মানব জীবনের আজন্ম সাধ স্বাধীনতার প্রশ্নে সেই অমিমাংসিত জনগণের স্বাধীনতার মতায়নের আন্দোলন কিন্তু ইকারুসের মোমের পাখনা শক্তি যোগায় যতোটা না যোগায় গান্ধির শান্তিবাদী আন্দোলন। বাংলার ইকারুসের, সিরাজ সিকদারের বয়স যখন মাত্র ২৩ তখন তিনি তৈরি করলেন মাও সেতুং গবেষণাগার।

একবার ভাবুনতো আজকের যুগে যারা ইকারুস হতে পারতো তারা কি করে? তারা রাত যেগে ফোনে কথা বলে, হিন্দি ফিল্মের নকল করে চুল কাটে আবার কাটে না, দাড়ি রাখে আবার রাখে না। তারা সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঘরে ফিরে কোনো স্বপ্ন না নিয়ে। একবার ভাবুনতো চুল দাড়ি পেকে যাওয়া রাজনীতিবিদরা যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের চোরাগলিত হাত পা ডুবিয়ে হাপিত্যিশ করছেন তখন মাত্র ২৪ বছরের যুবক সিরাজ সিকদার বললেন, দীর্ঘ স্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। সিরাজ সিকদার স্বাধীন পূর্ব বাংলার জন্য কারা শত্রু কারা মিত্র তার বিস্তারিত তত্বায়ন করে জাতির সামনে হাজির করলেন ঐতিহাসিক পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস। ইতিহাস স্বাধিন পাকিস্তানের সঙে শত্রু মিত্রের প্রভেদ এমন সহজ করে এর আগে কেউ আমাদের জানায়নি।

শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসের যে সত্য, আজ যে কেউ পড়লে বুঝতে পারে ২৪ বছরের যুবক যে একদিন ৫৫ হাজার বর্গ মাইলজুড়ে মানুষের স্বপ্নের কারিগর হবেন তার আভাষ ছিলো ঐ দলিলে। আরও আশ্চার্যের বিষয় যে ১৯৬৯ সালের মহান গণঅভ্যুত্থানেরও আগে সিরাজ সিকদার তার থিসিস দিলেন দেশকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক জাল থেকে মুক্ত করার জন্য আমাদের কি করতে হবে। আজকের ডিজে আর ডিজুস প্রজন্মের ২৩ বছর বয়সি বন্ধুরা কি করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে কোনো আশাব্যঞ্জক কথা শোনা যাবে না। আজকের তরুন তরুনীরা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, কারন আমাদের দেশের প্রধান ধারার দৈনিক পত্রিকাগুলো দেশজুড়ে যে বিরাজনীতিকরণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তা সফল হয়েছে বলতেই হয়। ফলে এই তরুন তরুনী বড়জোর বন্ধুসভা করে আর গণহারে রাজনীতিকে গালমন্দ করে।

ভাবখানা এমন যে রাজনীতি মুক্ত হলে, রাজনীতি থেকে যে যতো দূরে থাকবে সে ততো বেশি স্মাট আর বুদ্ধিমান। অথচ এই নিরেট গিলুহীন তরুনী তরুনী জানেনা যে, রাজনীতির জ্ঞান বর্জিত মানে অস্পূর্ন আনস্মাট জীবন। যে দেশে পত্রিকা জোর প্রচার চালায় রাজনীতি করা খারাপ, আর বিনা বাক্যে মেনে নেয় যে তরুন তরুনী তাদের আর কিইবা বলার আছে। তবে একই সাথে এই তরুন তরুনীদের জানা থাকা দরকার তাদের বয়সি আরেক তরুন ১৯৬৭ সালের ৮ জানুয়ারি ঘোষণা দিয়েছিলো যে, পাকিস্তান আর টিকবে না। পাকিস্তানের পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিপরীতে একটি সুখি সমৃদ্ধশালী পূর্ব বাংলার স্বপন দেখতে পারে যে জাতির তরুনেরা সে জাতির আজকের তরুন তরুনীরা হাল আমলের চুলের ফ্যাশন আর মোবাইল ইন্টারনেট চালানোর পরও কি আনস্মাটই জীবন যাপনই না করে।

বাদ দিন তরুন তরুনীদের কথা। যদি প্রশ্ন করা হয় তিনকাল পেরিয়ে যেসব বুড়ো অধ্যাপকেরা অপো করছে কবরে বা শম্মানে যাবার তাদের ভাড়ারে কি কি জমা আছে? উত্তর জানা আছে সবার। কারোরই কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই, শুধু শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়ানো জরাগ্রস্ত কিছু ছবি ছাড়া। স্বদেশী বিপ্লবীদের চোখে বিশ্ব ভাতৃত্বের গান আমাদের দেশে ইসলামী বলেন আর কমিউনিস্ট বলেন দু ঘরনার মানুষই হয় আরব নতুবা চীন রাশিয়াকে কপি করে। সেখান থেকে বিচার করলে সিরাজ সিকদার শুধু মেধাবীই নয়, মেধার সঙ্গে যা যুক্ত করেছেন তা হলো এই ভূমির হাজার হাজার বছরের অর্জিত মানুষের জ্ঞান কাঠামোকে।

যারা নিজেদের সামর্থ্যরে ঈমানে বিশ্বাস করেন তারা বুঝতে পারবেন এই প্রয়োজন কত গভিরে রয়েছে। সিরাজ সিকদার ০৩ জুন ১৯৭১ সালে তৈরি করলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। সর্বহারা তথা প্রলেতারিয়েতের এত সুন্দর বাংলা এর আগে কোন বিপ্লবী কল্পনা করতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি জাতিতে খাঁটি বাঙালী। আর পশ্চিম বাঙলার দাদাদের ভাষায় বাঙাল।

তো এই বাঙাল কিন্তু শুধু বাংলায় থাকলেন না এর সঙে যোগ করলেন মার্কসিয় আন্তর্জাতিকতবাদী দৃস্টিভঙ্গি। সিরাজ সিকদার যখন শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস দিচ্ছেন ঠিক তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে গেছে রাশিয়া আর চীনের মহাবির্তক। সেই স্রোত এসে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও লাগে। চীন ও রাশিয়া ধারায় কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়। বামপন্থীদের মধ্যে সে সময় দুটো ধারা-রুশ ও চীনপন্থী।

মূলত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যেই তা প্রবল ছিলো। নেতা পর্যায়ে তা ছিলো ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ব্যানারে। কারণ পাকিস্তানে তখন কম্যুনিস্ট পার্টি ছিলো নিষিদ্ধ, গোপন তৎপরতা চালাতো পার্টি। ১৯৬৭ সালে বসন্তের প্রাক্কালে ভারতের নকশাল বাড়িতে কৃষকরা সশস্ত্র আন্দোলন করে বসলো। বসন্তের সেই বাতাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ছাড়িয়ে পূর্ব বাংলায় এসেও লাগলো।

ভারত কাপানো এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন চারু মজুমদার। নকশাল বাড়ি আন্দোলনের সেই জোয়ার পিকিং রিভিউর সৌজন্যে রোমাঞ্চিত করে তুললো চীনাপন্থী তরুণ বিপ্লবীদের। নকশালবাড়ির আন্দোলনকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা হঠকারিতা বলে তত্ব দিয়ে দিলেন। আর এর প্রতিবাদে তরুণদের একটা দল বেরিয়ে এসে গঠন করলেন রেডগার্ড। ঢাকা শহরে চিকা পড়লো- বন্দুকের নলই সকল মতার উৎস/ নকশালবাড়ী জিন্দাবাদসহ প্রভৃতি দেওয়াল লিখন প্রচারণা চালাতো তারা।

সিরাজ শিকদার তাদের অন্যতম। তাঁর চোখে তখন সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের স্বপ্ন। যার মাধ্যমে পরাজিত হবে পাকিস্তানের জান্তা সরকার। আর এখন কল্পনা করুন আত্মসর্বশ্বো বিকিয়ে দেওয়া তরুন তরুনী যিনি মানুষ শব্দের গভীরে যে মূল্যবোধ তা বোঝে না, বোঝে না পশুর প্রাণের সঙ্গে মানুষের প্রাণ ও আত্মমর্যাদার তফাতটি ঠিক কোথায়। বিপ্লবের আরো প্রস্ততি হিসেবে ৭ সঙ্গী নিয়ে টেকনাফ হয়ে গেলেন বার্মা (মায়ানমার)।

সেখানকার কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা থান-কিন-থাউর সঙ্গে দেখা করলেন নে-উইনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের স্বরূপ জানতে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় তিনি বিপ্লবীদের মূল ঘাটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন পাহাড় কেটে সুরঙ্গ তৈরি করে গোপন আস্তানা বানানোর কাজে লেগে গেলেন। সঙ্গীরা সব অল্প বয়সী, কেউ ২০ পেরোয়নি। পাহাড়ের খাদে ওই খেয়ে না খেয়ে ঝড় বৃষ্টিতে মশার কামড় খাওয়া অভিযানে এগিয়ে যাচ্ছেন এই বীর বিপ্লবিদের দল। অনেকের হয়তো মনে হতে পারে এটা নিছক এ্যাভেঞ্চরা।

যদি নিছত এ্যাভেঞ্চারই হয় তবে এখন এরকম কোনো এ্যাভেঞ্চারিস্টকে পাওয়া যায় না কেন? এই প্রচেষ্টা টিকলো না। কারন সিরাজ সিকদার বুঝতে পারলেন মানুষ ছাড়া জঙ্গলে তিনি কার জন্য বিপ্লব করবেন কাকে সাথে নিয়ে। এরপরের ঘটনাকাল ১৯৬৭-৬৮ সালের। ১৯৬৭ সালে মাও সেতুং থট রিসার্চ সেন্টার বা মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র মালিবাগে স্থাপন করলেন। তবে মৌলবাদীদের আক্রমনের মুখে গবেষণা কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে হলো।

১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন সংগঠনটি তৈরি করলেন। এই সংগঠনটি ছিলো পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রস্তুতি সংগঠন। এ সময় সংগঠনটি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনটি মাওর বিখ্যাত উক্তি নিয়ে দেওয়াল লিখন শুরু করলো ঢাকা শহরে , `Power comes from the barrel of a gun' (বন্দুকের নলই মতার উৎস)। এক সময় সর্বহারা পার্টি করতো এমন কয়েকজন শ্রমিকের কাছে শুনেছি, ঢাকায় এরকম দেওয়াল লিখনের পরে পুলিস সারারাত ধরে সেই দেওয়াল লিখন আবার মুছতো। তখন তরুন সিরাজ সিকদার হেসে বলতেন এটা দিয়েই হবে।

এসবই অবশ্য আমার শোনা কথা। আজকের বাংলাদেমের যে লাল সবুজের পতাকা আমরা দেখি অনমনিয় স্বাধীন পতাকা পত পত করে উড়ে সেই প্রিয় পতাকা সিরাজ সিকদারের নিজের হাতে তৈরি করা। ১৯৭০ সালের ৮ জানুয়ারী সংগঠনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপল্েয স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহে ওড়া এই পতাকায় সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য্য। অথচ বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামো এমনই অকৃতজ্ঞ যে সিরাজ সিকদারকে সেই স্বীকৃতিটুকও দেয়নি।

আর সে বছরে ৬ মে কার্লমাক্সের জন্মদিন উপলক্ষে পাকিস্তান কাউন্সিলে দুটো হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের সামরিক উইং। সংগঠনটির সামরিক শাখা ১৯৭০ সালের অক্টোবর নাগাদ আরও বেশ কিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠানে হামরা চালায়। সিরাজ সিকদারের সংগঠন সেই সব বিদেশী প্রতিষ্ঠানাগুলো ল করে হামলা চালায় যারা পূর্ব বাংলার জনগনের রাষ্ট্র আকাঙ্খার বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছিলো। এই হামলার মধ্যে ছিলো ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন, আমেরিকান ইনফরমেশান সেন্টারসহ আরো বেশ কিছু জায়গায়। এরপরের ইতিহাস খুব দ্রুত এগিয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বে সিরাজ সিকদার শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কাছে একটি খোলা চিঠি লেখে। ২ মার্চ ১৯৭১ সালে লেখা ঐ চিঠিতে সিরাজ সিকদার স্বাধীন পূর্ব বাংলার জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গণযুদ্ধ শুরু করার প্রস্তাব দেন। তবে নেতা তখন ব্যস্ত গোল টেবিলে। ইতিহাস স্বাক্ষি গোল টেবিলে কখনো স্বাধীনতা বেরিয়ে আসেনা। তবে ২ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কাছে একটি খোলা চিঠি দেওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারী ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, একটি স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে রুপ দিন; স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ন, নিরপে, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা করুন’ শীর্ষক শিরোনামে দেশবাসীর প্রতি ডাক দেন।

তখন যদি আমাদের বুর্জোয়া জাতিয় নেতৃবৃন্দ সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় একটি জাতিয় ঐক্যমত গড়ে তুলে দেশবাসীর প্রতি যুদ্ধের ডাক দেন তবে, পাকিস্তানের জান্তা সরকার পশ্চিম পাকিস্তান হতে অস্ত্র ও সেনা সদস্য বৃদ্ধি করার সুযোগ পেতো না। যুদ্ধের ভয়াবহতায় ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারতো না পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা। এরপর ঘটনা স্বপ্নের মত চলে গেলো। বরিশালের পেয়ারা বাগানে নারী পুরুষের সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী গড়ে তুললেন সিরাজ সিকদার ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল, নাম দিলেন জাতিয় মুক্তিবাহিনী। ঐ বছরের ৩ জুন গড়ে তুললেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।

ল্ক্ষ্য একটাই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলামুক্ত করে একটি স্বনির্ভর দেশ। ১৯৭১ সালের পরে আজকের দেশ যেখানে এসেছে যেখানে ন্যায় অন্যায়ের কোনো প্রভেদ নেই। যে রাষ্ট্রে কতিপয় মিলিটারি আমলা আর লুটেরা ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদেরা দেশটাকে চেটেপুটে খাচ্ছে। সেই ভবিষৎবানী সিরাজ সিকদার ১৯৭২ সালেই করেছিলেন। আবার বিপ্লবের জন্য, মুক্তির জন্য লড়াই শুরু।

তবে এবার খোদ মুজিব সরকারের হাতে ১৯৭৪ সালের ২ জানুয়াী ক্রসফায়ারের এক নাটকে সাভারে নিহত হলেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সেটাই ছিলো প্রথম ক্রসফায়ার। এখানে আরেকটু এলেম নিয়ে বিষয়টির গুন বিচার হওয়া দরকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বরাবরই মাওবাদী ধারার সশস্ত্র বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছে, এখনো করছে। আজও সেই ধারার বিপ্লবীদের ক্রসফায়ারে খুন করা হচ্ছে।

শেষ হলো সাহসের এক উপখ্যানের। আর পরেরদিন শেখ মুজিব অট্রহাসি হেসে বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার। ’ এরপর খাটি গোপালগঞ্জর ভাষায় তিনি বললেন, ‘ লাল ঘোড়া (কমিউনিস্টদের) দাবড়াই দিবানি। ’ নিজের কবিতার একটি স্বগক্তি করছি ‘‘যে শোকপ্রস্তাবে সাভারের মাটি লাল হলে/ পরের দিন অশ্লীল বাক্যবানে আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট / বিদ্ধ করেছিলেন মানুষের হ্রƒদয় : লাল ঘোড়া দাবড়ায় দিবানী/’’ (শোকপ্রস্তাবের অপেক্ষায়)। শুরু করেছিলাম আইকন দিয়ে।

কার আইকন কে ছিনতাই করে। সিরাজ সিকদার সাহসের একটি নাম। আর উল্টো করে বললে বলতে হবে সাহসের একটিই রঙ হয় সেটা লাল আর তার নাম সিরাজ সিকদার। আমাদের কুদো মধ্যবিত্ত স্বপ্নহীন তরুন তরুনী কার কাছে স্বপ্ন জমা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিরাত। মানুষের জন্মতো মানুষ একবারই পায়।

সে জীবন যখন আর জীবনের মধ্যে থাকে না তখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। আমাদের ভবিষৎ জীবন কি শুধু আফসোসের জন্য তুলে রাখবো, নাকি লড়াই আর জীবনের মধ্যে খুঁজে নিবো? একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পাওনা বুঝে নিবো, নাকি বহুজাতি করপোরেটের কনিস্ট কেরানি (জুনিয়র এক্সিউকিউটিভ) হয়ে দিন গুজরান করবো? সময় আজ সেই হিসেবে নিকাশের । অথবা উল্টো করেও বলা যায় মানুষের সাথে কেবল মানুষের দেখা হয়। আর মহাত্মা জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, ‘যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা’। এই সময়ের তরুন তরুনীদের জীবন আসলে দোয়েল ফড়িঙের সে জীবনে মানুষের সাথে তাদের হবে নাকো দেখা।

নাকি জীবন পাল্টে ডিজে আর ডিজুস প্রজন্ম মানুষের সাথে দেখা করবার জন্য চোখ থেকে রঙিন চশমা খুলে ফেলবে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.