আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকার বাকরখানি

সত্যের চেয়ে অপ্রিয় আর কিছু নেই
বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকে প্রতিষ্ঠিত ঢাকাকে এক সময় বলা হতো প্রাচ্যের রহস্য নগরী। ঢাকা শুধু রহস্য নগরীই ছিল না, ছিল রস নগরীও। ইতিহাস ঐতিহ্যের সুতিকাগার হিসেবে পরিচিতি ঢাকা ছিল নানা কারণে বিখ্যাত। ঢাকার খাবারের সুনাম ছিল জগৎময়। আদিকাল থেকেই ঢাকার আদিবাসীরা ছিলেন খাদ্য রসিক, ভোজন বিলাসী।

তাই ঢাকার নানা ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম আজও লোকমুখে শোনা যায়। এর মধ্যে অন্যতম বাকরখানি। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি আজও তার সুনাম-সুখ্যাতি ধরে রেখেছে। বাকরখানি সগৌরবে টিকে আছে মহাকালের ভ্রুকুটি এড়িয়ে। মুখরোচক ফাস্ট ফুডের জয়যাত্রা কালেও বাকরখানি তার জৌলুস ধরে রেখেছে সমহিমায়।

বাকরখানি হলো ময়দা, ডালডা ও লবণ মিশিয়ে তৈরি এক ধরনের ছোট গোলাকৃতির মুচমুচে রুটি, যা একান্তভাবেই ঢাকার সৃষ্টি। জনশ্রুতি রয়েছে, জমিদার বাকের খাঁ ও তাঁর স্ত্রী খানি বেগমের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয় বাকরখানি। আগা বাকের খাঁ ছিলেন ভাটির জমিদার। তার নামানুসারে বাকেরগঞ্জ জেলারও নামকরণ করা হয়। আগা সাদেক ছিলেন তাঁর পুত্র।

যার নাম অনুসারে পুরনো ঢাকায় একটি রাস্তার নামকরণ করা হয় আগা সাদেক রোড। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাকরখানির সৃষ্টি। বাকরখানি এখনও ঢাকায় তৈরি হয়। ঢাকার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবার এটি। চক বাজারের বিখ্যাত শাহী বাকরখানির মালিক হাজী শরিয়ত উল্লাহ বেপারী বলেন, ‘বাকরখানি ঢাকাবাসীর জান, ঢাকাবাসীর প্রাণ।

বাকরখানি ছাড়া ঢাকার মানুষের সকাল-বিকালের নাস্তাই জমে না। বাকরখানি ছাড়া গরম চায়ের মজাই পাওন যায় না মিয়া সাব। গরু, খাসী আর মুরগির ঝাল ফ্রাইয়ের সাথে বাকরখানি খাওনের সাধ এককেবারে বেহেস্তী খাওনের লাহান। এক বার খাইলে সারা জীবনে বাকরখানির স্বাদ ভুলতে পারবেন না মিয়া’। ঢাকার আদি বাসিন্দা হাজী শরিয়ত উল্লাহ আরও জানান, তার দোকানে ৭/৮ রকমের বাকরখানি তৈরি হয়।

এর মধ্যে রয়েছে ছানা, পনির, চিনি, নোনতা, কাবাব, কিমা ও নারিকেলের সংমিশ্রণে তৈরী রকমারি বাকরখানি। ৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হয় বাকরখানি। হাজী সাহেব আরো জানান, এক সময় ভোজন রসিক ঢাকাবাসী স্বাদ করে খেতেন বুন্দিয়া পোলাও, মাছ পোলাও, হাগলা পোলাও, সোইয়া পোলাও, মোবেত পোলাও। ১০/১৫ সের মাংস একটি শিকে গেঁথে তৈরি হতো ‘পরসুন্দর’ শিক কাবাব। ছিল হান্ডিকাবাব, তাশ কাবাব, মোরগ মুসল্লম, শবডেগসহ বহু প্রকার সুস্বাদু খাবার।

তিনি দুঃখ করে বলেন, কালের স্রোতে সেই মেহমান এবং মেজবান আর নেই। এখন আর কে কার থালায় পরিবেশন করবে দুধের ফেনায় শোভিত সুমিষ্ট ‘নামশা’। কোথায় মিলবে সোহান হালুয়া, নিশাসতার, আমিরাত, মুরাক্ষী, সাকরপাড়া, পদ্দের মোরব্বা, নুকুল কিংবা বালু শাহীর মতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী মিষ্টান্ন সামগ্রী। কালের প্রবাহে বিলীন হয়ে গেছে ঢাকার অসামান্য আরো অনেক খাবার। জানা গেছে, ঢাকার বিলুপ্ত হওয়া খাবারের তালিকায় টক, ঝাল, মিষ্টি সব ধরনের খাবারই রয়েছে।

আজ না আছে পালোয়ানের মোরগ পোলাও, না আছে পাগলার গেলাসি। বাকরখানি টিকে আছে শুধুই তার ঐতিহ্যের জোরে। শত শত যুগ ধরে বাকরখানি তার সৌরভ বিলিয়ে চলেছে রাজধানী ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সহযোগিতা পেলে এক সময় এই শাহী বাকরখানি সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে এখনও প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক বাকরখানি প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিত শতকরা ৮০ ভাগ শ্রমিকই সিলেটের অধিবাসী।

তারা নিতান্ত পেটের দায়েই এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে জানান সিলেটের হবিগঞ্জ নিবাসী আবদুল আলিম। ঢাকার চকবাজারের শাহী বাকরখানির কারিগর তিনি। বেতন সামান্য হলেও থাকা খাওয়া ফ্রি। ঢাকার মানুষের অতি প্রিয় খাবার বলে বাকরখানির চাহিদা কখনোও কমবে না বরং দিন দিন এর চাহিদা ও সুখ্যাতি বাড়ছে বলে জানান স্থানীয়রা।
 



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।