আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদের মুনাফা লিপ্সা - ২

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা

জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদের মুনাফা লিপ্সা - ১ Click This Link কোপেনহেগেন দলিলের অসারতা কোপেনহেগেন দলিলের সফলতা-ব্যর্থতার বিষয়টি আলোচনার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগত দিনের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। কারণ এবারের দলিলের মূল উদ্যোক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৭ সালে সাক্ষরিত হয় কিয়োটো প্রটোকল। এ প্রটোকল ছিল গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের মানমাত্রা নির্ধারণকারী আইনি দলিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ দলিলে কখনোই স্বাক্ষর করেনি। ২০০১ সালে সে স্পষ্টভাবে নিজেকে কিয়োটে প্রটোকল থেকে সরিয়ে আনে। এবারও কোপেনহেগেন সম্মেলনের মূল দাবি কার্বন নিঃসরণ কমানোর আইনি ঘোষণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধান প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, চীন ও ব্রাজিলকে সাথে নিয়ে তথাকথিত এই রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল উত্থাপন করে সম্মেলন শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। ১৮৯টি দেশ কর্তৃক সমর্থন পাওয়া এ রাজনৈতিক দলিল সব রাষ্ট্রের সমর্থন পায়নি। তাই এটি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহিত কোনো দলিল নয়।

এমনিক কোনো কোনো দেশের অভিযোগ, এর প্রস্তাবনা জাতিসংঘের রীতিনীতির বিরুদ্ধে এবং কার্যত এটি জাতিসংঘের বিরুদ্ধে একটি ‘ক্যু’। দলিলটি বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল। এক । যখন ডুবে যাওয়ার উপক্রম নিরূপায় দ্বীপদেশ এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো নিজেদের অস্তিত্ব ও জীবন রক্ষার্থে কার্বন নিঃসরণ কমানো আইনি বাধ্যবাধ্যকতা দাবি করছে তখন দীর্ঘ সময় পার করে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই এমন রাজনৈতিক দলিল গ্রহণ করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটি অনেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারের মতো যার কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।

এ সমঝোতার বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে টুভালুর প্রতিনিধি ইয়ান ফ্রাই-এর কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থা টাইটানিক জাহাজের মতো। আমরা দ্রুত ডুবে যাচ্ছি। এখনই কিছু করা দরকার। কিন্তু এর মধ্যে একদল বলছে, আমরা ডুবছি কিনা সেটা নিয়ে আরও আলোচনা করার আছে।

’ দুই । যেহেতু এটি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহিত ও অনুমোদিত কোনো দলিল নয় তাই এর ভিত্তিতে পরবর্তী আলাপ-আলোচনা চালিয়ে ২০১০ সালে মেক্সিকোয় একটি আইনগত দলিল পাওয়াও আশা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। একই সাথে কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো কার্যকর আইনি দলিল গৃহিত হবে কিনা তা নির্ভর করবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অন্তর্বিরোধের ধরনের ওপর। তিন। এ দলিল বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব স্বীকার করলেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো অঙ্গীকার করে নি।

দলিলে কেবল সাম্য ও টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করার তাগিদ দিয়েছে (অনুচ্ছেদ - ১)। এমনকি কবে থেকে নিঃসরণের চূড়ান্ত মাত্রা ক্রমান্বয়ে নামিয়ে আনা হবে তাও উল্লেখ করা হয় নি (অনুচ্ছেদ - ৩)। যদিও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের প্রস্তাবিত নিঃসরণ হ্রাসের মাত্রা ৩১ জানুয়ারি ২০১০ নাগাদ জাতিসংঘ সচিবালয়ে জানাতে আহ্বান করা হয়েছে, কিন্তু সে হ্রাসের ন্যূনতম মাত্রা কী হবে তার কোনো উল্লেখ করা হয় নি। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া ২০১০ সাল নাগাদ নিঃসরণ হ্রাসের যে মাত্রা প্রস্তাব করেছে, আইপিসি’র প্রস্তাবনার তুলনায় তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। সেই সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকলের অধীনে নিঃসরণ হ্রাসের মাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলো।

আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রতো ওই প্রটোকল স্বীকারই করেনি। চার। এ দলিল শিল্পোন্নত দেশগুলো ছাড়াও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের তাগিদ দিয়েছে এবং এ বিষয়ে গৃহিত কর্মসূচি এ বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে জাতিসংঘ সচিবালয়ে জানাতে আহ্বান করা হয়েছে। দলিলটির প্রস্তাবনা অনুযায়ী শিল্পে অনুন্নত দেশগুলো এবং বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাগ্রস্ত দেশগুলো যারা কোনোভাবেই ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী নয় তারাও স্বপ্রণোদিত হয়ে নিঃসরণ হ্রাসের ব্যবস্থা করবে। শিল্পোন্নত দেশগুলো কার্বন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নিঃসরণ কমাবে - এমন কোনো প্রতিশ্রুতি না দিলেও শিল্পে অনুন্নত দেশগুলিকে বন উজাড় রোধ এবং নতুন বনায়নের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।

বনায়নের এ কর্মসূচিটি যেহেতু জাতিসংঘের অধীনে প্রণীত দলিলের কর্মসূচি নয় তাই প্রস্তাবিত ‘কোপেনহেগেন গ্রিন ফান্ড’ও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। ফলে এ দলিলের অধীনে প্রদত্ত সাহায্যের সব প্রতিশ্রুতিও অনিশ্চিত। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো নিজেদের নানা (রাজনৈতিক-সামরিক-অর্থনৈতিক) স্বার্থে এ সাহায্য প্রতিশ্রুতিকে ব্যবহার করবে। পাঁচ। এ দলিলে জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে শিল্পোন্নত দেশগুলো কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পর্যাপ্ত, অনুমেয় এবং টেকসই সমর্থন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ‘পর্যাপ্ততা’র কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয় নি।

শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ককতার সাথে অভিযোজনের জন্য অর্থপ্রাপ্তির আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা আগামী তিন বছরে (২০১০-২০১২) ভারসাম্যমূলক প্রশমন (বিশেষত বন উজাড়) ও অভিযোজনের কাজে ব্যয় করা হবে। অভিযোজনের সঙ্গে প্রশমনের শর্ত জুড়ে দেওয়ায় এবং অর্থের বিনিয়োগ ‘আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান’-এর (বাংলাদেশের প্রস্তাবনা হল বিশ্বব্যাংক) মাধ্যমে করার ঘোষণায় (অনুচ্ছেদ - ৮) অভিযোজনের প্রয়োজনীয় অর্থপ্রাপ্তির এবং এর ওপর অনুন্নত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এ সহযোগিতার বিষয়টিও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর হাতেই তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ভূমিকায় ব্যবহৃত হবে। ছয়।

২০২০ সাল নাগাদ প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা কার্বন প্রশমণের জন্য, অভিযোজনের কোনো উল্লেখ সেখানে নেই। বলা হয়েছে, প্রশমনের বাস্তবতা বিবেচনায় এবং এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে উন্নত বিশ্ব ২০২০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রয়োজন মেটাতে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করবে। যেহেতু বাংলাদেশসহ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর কার্বন নিঃসরণ মাত্রা একেবারেই নগণ্য, তাই সঙ্গত কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, প্রশমনের জন্য প্রস্তাবিত এ অর্থের প্রধান দাবিদার হবে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষত ভারত, চীন ও ব্রাজিল ( এ প্রস্তাবের যারা মার্কিন সহযোগী)। সাত। প্রশমনের জন্য ‘বন উজাড় রোধ’কে বেছে নিলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তরের বিষয়ে এ দলিল ‘পদ্ধতি’ প্রণয়নের কথা বলেই দায় শেষ করেছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকারকে (গ্যাট ও ট্রিপস) অজুহাত করে প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কঠোর অবস্থান ইতিবাচক পরিবর্তনকে সবসময়ই বাধাগ্রস্ত করেছে। আট। এ দলিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কার থাকা বিপুল জনগোষ্ঠীর আইনি সুরক্ষার বিষয়ে কিছুই বলেনি। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে হিমালয় পর্বতমালা, সুন্দরবন ইত্যাদিসহ দুনিয়াজুড়ে ছড়ানো মানবজাতির অভিন্ন উত্তরাধিকার বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কোনো বক্তব্য এ দলিলে নেই। জলবায়ু পরিবর্তন কেন ঘটে? গ্রিনহাউজ ইফেক্ট, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ইত্যাদি শব্দগুলো এখন মোটামুটি সবারই জানা।

এ কথাগুলো দিয়ে কি বোঝায়, এ সবের কারণ কি সেটা সামান্য ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ... ... ... ... চলবে ... ... ...

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।