আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যাপায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ ....

গভীর কিছু শেখার আছে ....

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যাপায়ের ‘দৃশ্যাবলী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ঢালিউড সিনেমা ‘গুরুভাই’। এই সিনেমার মুক্তি উপলক্ষে আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সে যোগ দিতে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যাপায়। ঢাকায় ছিলেন দুদিন। টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। বলা যায়, প্রচন্ড ব্যস্ততাতেই তা সময়গুলো কেটেছে।

এরই এক ফাঁকে কথা হয় দুই বাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় ও গুণী এই ঔপন্যাসিকের সঙ্গে। বিনয়ী এই মানুষটির সঙ্গে কথোপথনে উঠে এসেছে উপন্যাস নিয়ে তার ভাবনার কথা, দুই বাংলার মানুষের কথাসহ নানা বিষয় .... এনটিভিতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যাপায় ইন্টারভিউ দিতে যাবেন দুপুর ১টায়। আগের রাতই বিষয়টি কনফার্ম হতে পারি। ফলে তখনই তার শিডিউল নিয়ে নেই। আমার বাসা থেকে এনটিভি যেতে খুব বেশি হলে বাসে ৩০ মিনিটের পথ।

কিন্তু ঢাকার রাস্তার যে জ্যাম, সেটিকে উপেক্ষা করে সময় মতো পৌঁছাতে পারবো কিনা তা নিয়ে নিজেই সন্দিহান ছিলাম। আর হলোও তাই। যেতে যেতে দুপুর দেড়টা বেজে গেলো। তবে স্বস্তির বিষয় হলো শীর্ষেন্দুদা তখনও এনটিভির স্টুডিওতেই রয়েছেন। তার ইন্টারভিউ রেকর্ডিং তখনও চলছে।

অপেক্ষা করতে থাকলাম রেকর্ডিং শেষ হওয়ার জন্য। আরো প্রায় ৩০ মিনিট পর শীর্ষেন্দুদা বের হলেন স্টুডিও থেকে। পুরান ঢাকার আশ্রমে শীর্ষেন্দুদা তার দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার আসবেন দেশ টিভিতে লাইভ ইন্টারভিউয়ের জন্য। ফলে শীর্ষেন্দুদার হাতে পর্যাপ্ত সময় কম থাকায় ঠিক করলাম তার সঙ্গে একই মাইক্রোবাসে কথা বলতে বলতে যাবো। শীর্ষেন্দুদাকে বিষয়টি জানাতেই তিনি মাথা নেড়ে সায় জানালেন।

এনটিভি থেকে বেরিয়ে মাইক্রোবাসের দেখা নেই। ড্রাইভার মোবাইলে জানালো রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়, সকলে যেন সোনারগাঁ হোটেলেন সামনে এসে দাঁড়াই। সেদিন রোদের তেজটাও ছিলো যেন একটু বেশি। যা হোক, এনটিভি থেকে বেরিয়ে সকলে মিলে দল বেঁধে হাটতে থাকি। শীর্ষেন্দুদা হাঁটছেন।

গল্প করছেন। জানাচ্ছেন নিজের নানা অভিজ্ঞতার কথা। কথা প্রসঙ্গ প্রথমেই তার কাছে জানতে চাইলাম, ‘দূরবীণ উপন্যাসের ধ্র“ব চরিত্রটির আইডিয়া তিনি কোথা থেকে পেলেন। এটি কি কাউকে ফলো করে তৈরি করেছেন?’ শীর্ষেন্দুদা মুচকি হেসে বললেন, ‘জানি না সবাই কেন যেন এই প্রশ্নটিই আমাকে সবার আগে করে। ’ তারপর একটু থেমে আবার মুখের স্মিত হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর হলো, লেখক নিজেও জানেন না ধ্র“ব চরিত্রটি কোথা থেকে তিনি তৈরি করেছেন।

’ শীর্ষেন্দুদার রসালো এ উত্তর শুনে আশে-পাশের সকলেই আমরা হেসে উঠলাম। এভাবে টুকটাক কথা বলতে বলতে সবাই মিলে সোনারগাঁ হোটেলের সামনে এসে গেলাম। রোদ বেশ কড়া থাকায় সকলেই ব্যস্ত উঠলো শীর্ষেন্দুদাকে গাছের ছায়ায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু শীর্ষেন্দুদা রোদের চেয়ে ঢাকার ব্যস্ত সড়কের ছুটে চলা মানুষদেরকে দেখতেই যেন বেশি পছন্দ করছিলেন। তিনি চারদিকের নানা ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

হয়তো তার পর্যবেক্ষণের মধ্যে একজন লেখকের উপলব্ধি ছিলো, যেটা আর সকলের থাকে না। একটু পরেই মাইক্রোবাস আসলো, সকলেও উঠে পড়লাম তাতে। গাড়ি ছুটে চললো পুরান ঢাকার দিকে। শীর্ষেন্দুদার পাশেই বসেছিলাম আমি। নানা কথা চলছিলো তার সঙ্গে।

দেশ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছেন ৩৫ বছর ধরে। সাংবাদিকতার জন্য অনেক কঠিন কঠিন অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়েছে তাকে। জানালেন, একবার রাম চন্দ্রের বনবাসের পথ খোঁজার জন্য পুরো ভারত চষে বেড়াতে হয়েছে তাকে। আরো অনেক ডেঞ্জারাস অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়েছে তাকে। তবে এগুলোকে তিনি উপভোগ করেছেন বলে জানান।

সাংবাদিকতা সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেনও অনেক কিছু। একজন সাংবাদিকের নিজস্ব সোর্স থাকাটা জরুরী বলে মনে করেন তিনি। জানতে চাইলাম, পেশাগত জীবনে কোন সমস্যায় পড়েছিলেন কিনা। উত্তরে বললেন, ‘সমস্যা তো থাকবেই। এগুলো কিছু নয়।

এগুলো অল ইন দ্য গেম। এগুলোকে মেনে নিতে হয় এবং সেগুলো ওভারকাম করতে হয়। জীবনে যত বাঁধা বিঘœ আসে ততই ভালো। জীবনে যত দুঃখ আসে, সংকট আসে এবং তার সাথে যে মানুষ লড়াই করে; এর ফলে মানুষের মধ্যে লড়িয়ে ভাবটা আসে। ’ কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম, ‘জীবনের কোথায় যেতে চেয়েছিলেন আর কোথায় পৌঁছালেন’।

প্রতুত্তরে তিনি বললেন, ‘জীবনের গতির লাগামটা যদি আমাদের হাতে থাকতো তাহলে অনেক ভালো হতো। জীবনের লাগামটা তো আমাদের হাতে নেই। যেমন এই গাড়িটা মোড় নেবার সময় একটা অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। সুতরাং কোন কিছুই ধরে নেয়া নেই। আমি মনে করি জীবন যেভাবে চলে, জীবন যেভাবে নিয়ে যাচ্ছে, সেই গতিটা তো আমার মেনে নিতেই হবে।

ফলে এটিকে আমার মান্য করা উচিত। কারণ ঘটনার রাশ আমার হাতে নেই। আমার জীবনটা এরকম ভাবে চালাতে চাই, এরকম ভাবে চলতে চাই; এরকম কিছু ভেবে নেই না। ’ - ‘তাহলে জীবনের কি কোন লক্ষ্য ছিলো না আপনার, যে কোথায় যেতে চেয়েছিলেন?’ - ‘আসলে তেমন কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিলো না আমার। তবে এই বিশ্ব ব্রম্মান্ডই আমার কাছে এক বিরাট রহস্য।

এই রহস্যের সমাধান খোঁজাটাই আমার জীবনের লক্ষ্য বলা যেতে পারে। কথা-বার্তার এ পর্যায়ে গাড়ি জ্যামে পড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শীতের দিন বিধায় জ্যামের মধ্যেও গাড়ির ভেতরের কারোরই তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। অন্য সময় হলে সকলেই গরমে অস্থির হয়ে উঠতো। ঢাকার রাস্তার জ্যামের সঙ্গে পরিচিত তিনি।

তবে জানালেন গতবারের চেয়ে জ্যাম যেন আরো বেড়েছে। এজন্য ফ্লাইওভারের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি। উপরন্তু ঢাকায় রিকশাগুলোর বদলে আরো বেশি যন্ত্রচালিত যানবাহনের প্রচলন ঘটালে জ্যাম কমতে পারে বলে মন্তব্য করলেন তিনি। অবশেষে জ্যাম ছুটলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কাছে জীবনের সংজ্ঞাটা কি বলে মনে হয় অথবা আপনার জীবন নিয়ে যদি একটি বই লিখতে লা হয়, তবে জীবনের কোন অনুসঙ্গকে তুলে আনবেন?’ শীর্ষেন্দুদা বললেন, ‘সেটা নিয়েই তো সাহিত্য করি। আমার জীবন মানেই তো সাহিত্যের একটা পার্ট। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে জীবনের সংজ্ঞা কে আমি বারংবার খুঁজি এবং ধরবার চেষ্টা করি। আমার যে খোঁজ এবং চেষ্টা তারই অনন্য রূপ আমার সাহিত্যে উঠে আসে। ’ - ‘এমন কোন বই কি আছে যেটি ভাবেন লিখবেন, কিন্তু এখনও লেখা হয়ে ওঠেনি?’ - ‘হ্যাঁ, প্রত্যেকেরই তো একটি স্বপ্নের বই থাকে।

যেটা কখনও লেখা হয়ে ওঠে না। আমারও একটি স্বপ্নের বই আছে। এরকম একটা বই যেটা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রহণীয় হবে। মানুষকে বাঁচতে শেখাবে। তবে কখনো তা লেখা হয়ে উঠবে কিনা জানি না।

’ পাবনার হেমায়েতপুরে অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমের মেলায় প্রায় বছরই তিনি আসেন। গুরুদেব ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের একজন একনিষ্ঠ শিষ্য হিসেবে নিজেকে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে গুরুদেবকেই তিনি তার জীবনের রোল মডেল বলে মনে করেন। আর তাই মানবধর্মকেই তিনি তার জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। শীর্ষেন্দুদা মনে করেন মানুষের লক্ষ্যটা এমনই হওয়া উচিত যেন নিজের ভেতরে সে আল্লাহ বা ঈশ্বরকে আবিষ্কার করে।

মানুষ যেন মনে করে যে আল্লাহ বা ঈশ্বর আমার ভেতরেই রয়েছেন। তার ইচ্ছা আছে ঠাকুরকে নিয়ে পুর্নাঙ্গ একটি বই তিনি লিখবেন। নিজের লেখা প্রিয় বই কোনটি জিজ্ঞেস করতেই শীর্ষেন্দুদা বললেন, ‘আমার কোন প্রিয় বই নেই। সত্যি বলতে কি আমি এখন যদি আবারও আমার লেখা বইগুলো পড়তে যাই তবে মনে হয়, এমন হলো কেন, এটাকে অন্যভাবেও তো লেখা যেতো। তবে ‘উজান’ নামে আমার একটা উপন্যাস আছে, সেই বইটার মধ্যে আমি আমার ছেলেবেলার কথা লিখেছি।

সেটির প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে। ’ - ‘আমাদের দেশের লেখকদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ - ‘বাংলাদেশেও বেশ ভালো ভালো সাহিত্যিক রয়েছেন। এদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখ রয়েছেন। তবে বাংলাদেশি লেখকদের বই খুব বেশি আমরা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে পাই না। আর বাংলা গদ্য আরো নতুন নতুন লেখকের আগমনে খুব শিগগিরই যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এটাও আমি মনে করি না।

তবে প্রত্যাশাই করি বাংলা গদ্য যেন আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ’ - ‘যেহেতু বললেন পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি বই খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। সেরকম ভাবে বললে ভারতে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোও প্রচার করা হয় না। এ সম্পর্কে আপনারা কি উদ্যোগ নিয়েছেন?’ - ‘এটা মনে হয় প্রশাসনিক আদান প্রদানের কোন ভুল বোঝাবুঝির ব্যপার রয়েছে। কারণ ওখানকার কেবল অপারেটরদেরকেও বলে দেখেছি, কিন্তু ওরা কেমন যেন গা করে না।

এটা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সমঝোতা হওয়াটা জরুরী বলে মনে করি। ’ নিজের ভালো ও খারাপ গুণগুলো বলতে বললে অপকটেই জানালেন, তার ভালো গুণ হলো তিনি সহজেই রেগে যান না। আর তার অহং জিনিসটা কম। কারণ অহংকার তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। আর নিজের খারাপ গুণ হিসেবে অলসতাকেই দায়ী করলেন তিনি।

গতি মন্থরতাকে তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে মনে করেন। পরিবারের কেউ লেখালেখির সঙ্গে রয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি জানালেন, ‘আমার সন্তানরা কেউ লেখালেখির দিকে আসে নি। ওরা বলে বাড়িতে একজন লেখক থাকাই ভালো! আমার স্ত্রী অবশ্য লেখেন। তিনি কবিতা লেখেন, গদ্য লেখেন। ’ আবার কবে বাংলাদেশে আসবেন জিজ্ঞেস করতেই হাস্যেজ্জল মুখে জবাব দিলেন, ‘দেখি আবার কবে ডাক পড়ে।

আসলে তো কোন উপলক্ষ ছাড়া আসা তো হয় না, তাই উপলক্ষ হলেই আসা হয়। ’ দৈনিক যায়যায়দিনে প্রকাশিত

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.