আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখা ২০০৯ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ:সালতামামি



কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে আরো একটি বছর। আরো একটি নতুন বছরের সোনালি সূর্য উঠতে যাচ্ছে আর ক’টা দিন পরেই। হারিয়ে যেতে বসা ২০০৯ সালটি দেশের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে থাকবে। কেননা এ সময়টিতে দীর্ঘ দু’বছর পর একটি অসাংবিধানিক সরকার বিদায় নেবার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রস্তুতি, বিডিআর বিদ্রোহ, রাজনৈতিক দলগুলোর কাউন্সিল, ক্রসফায়ার বন্ধ না হওয়া, এনএসআইয়ের কর্মকর্তাদের গ্রেফতারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছে। সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৬ জানুয়ারি বিদায় নেয় দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দীর্ঘ দুই বছর অগণতান্ত্রিক,অনির্বাচিত, সংবিধানবিরোধি সরকার ক্ষমতা দখল করে রাখে। ৬ জানুয়ারি দেশের ত্রয়োদশতম সরকার প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। সেদিন মন্ত্রিসভার ৩১ সদস্যও শপথ গ্রহণ করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। শান্তিকামী সাধারণ মানুষ এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

স্বভাবতই মহাজোট সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেক। গত এক বছরে জনগনের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা এরকমÑ ‘রাজা আসে যায় রাজা বদলায় / নীল জামা গায় লাল জামা গায় / এই রাজা আসে ওই রাজা যায় / জামা কাপড়ের রঙ বদলায়.../ দিন বদলায় না’। দিন বদলায়নি দিন বদলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের আমলেও। দলীয় নেতাকর্মীদের দখল-বাণিজ্য এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলশ্রুতিতে দেশে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

ক্ষমতায় আসার মাস দুয়েকের মধ্যে শোকের মাস ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকার পিলখানার বিডিআর সদর দফতরে সংঘটিত হয় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির অনভিপ্রেত এ বিডিআর বিদ্রোহে প্রাণ হারান ৭৩ জন। তাঁদের মধ্যে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, ৭ জন বেসামরিক লোক ও ৮ জন বিডিআর জওয়ান। এ ঘটনার ফলে সারা বছরই শঙ্কার মাঝে ছিলেন দেশবাসী। যদিও এরকম কোনো ঘটনা এ বছর আর ঘটেনি, তবুও এক ধরনের শঙ্কা নিয়েই নতুন বছরে প্রবেশ করছেন তারা ।

উপজেলা নির্বাচন এবং জনমনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দীর্ঘ ১৯ বছর স্থগিত থাকার পর ২২ জানুয়ারি স্থানীয় সরকারের আওতাধীন তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও উপজেলা নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে। দিন বদলের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকার এ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব খাটানো, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগই উঠেছে। ২০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এবং ৬ মে উপজেলা পরিষদ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।

উল্লেখ্য, ২২ জানুয়ারি নির্বাচনে নানা অভিযোগে স্থগিত ছয়টি উপজেলার পাঁচটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৬ এপ্রিল। অন্যদিকে, জনগণের সেবা করা, নাকি নিজেদের আখের গোছানো কোনটা সরকারের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছেÑ তা নিয়ে বছরের শুরুতেই জনগণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। কেননা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা চিহ্নিত করে সরকার অনেকগুলো মামলা প্রত্যাহারের দিকে নজর দেয় ফেব্রুয়ারিতেই। ইতোমধ্যে অনেকগুলো মামলা প্রত্যাহার করাও হয়েছে। আইনজ্ঞদের মতে, সরকার যদি মনে করে যে, তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা হয়রানিমূলক, তাহলেও আদালত স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

অতীতে দুর্নীতির মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নয়, আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পন্ন করা হতো। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাই ক্ষমতায় আসার পর প্রথমদিকেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সংসদে আসন-বিতর্ক নবম জাতীয় সংসদ প্রায় সারাটা বছরই ছিল অকার্যকর। সংসদে বিরোধী দলকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের আন্তরিকতার অভাবের দিকটিও ফুটে উঠেছে। ২৫ জানুয়ারির প্রথম অধিবেশনের প্রথম কার্য দিবসেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সাংসদরা নিজেদের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে জাতীয় সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন।

২৮ জানুয়ারি প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় কার্যদিবসে সামনের সারিতে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বরাদ্দ রাখা নয়টি আসনের পরিবর্তে নতুন আসন বিন্যাসে চারটি আসন বরাদ্দ রাখার কারণে আবারও বিরোধী দল ওয়াক আউট করে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, আরো তিনটি আসন সামনের সারিতে না দেয়া পর্যন্ত তারা সংসদে যাবেন না। ২৯ জানুয়ারি ৩য় কার্যদিবস থেকে একটানা ১৭ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর আসনের সারিতে আসন বাড়ানোর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি সংসদে ফিরে আসেন বিরোধী দলের সাংসদরা। কিন্তু বিএনপির প্রত্যাশিত আসন সংখ্যা আর বাড়ানো হয়নি। পরবর্তীতে ৩ মার্চ, ১৬ মার্চ, ১০ মার্চ এবং ১ম অধিবেশনের শেষ কার্যদিবস ৭ এপ্রিল তাঁরা ওয়াক আউট করেন।

বেগম জিয়া মাত্র দুদিন অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি এবং ১ মার্চ সংসদে যোগদান করেন। বাজেট অধিবেশন ও দ্বিতীয় অধিবেশন (যা চলে ৪ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত) এবং তৃতীয় অধিবেশনেও (যা চলে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত) বিএনপি যোগ দেয়নি। স¤প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা প্রত্যাহার না হলে তাঁরা সংসদে যাবেন না। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিরোধী দল সংসদে উপস্থিত থেকে টিপাইমুখ, ট্রানজিট, এশিয়ান হাইওয়ে, শিক্ষানীতিসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোতে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেনি এবং তা হয়েছে গণতন্ত্র ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। উল্লেখ্য, দেশের সংসদীয় ইতিহাসে কোনো সংসদের উদ্বোধনী দিনে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতি ছিল নজিরবিহীন ঘটনা।

আসন বণ্টন নিয়ে ক্ষোভ যে শুধু বিরোধী দলেই তা নয়, সরকারি দলের অনেক নেতার মাঝেও ক্ষোভ লক্ষ করা গেছে। আবার ৩১ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকেই নিয়োগ দেয়া হবে এবং আসনসংখ্যা দিয়ে বিরোধী দলকে মূল্যায়ন করা হবে না। কিন্তু এ দুটো প্রতিশ্রুতিও পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ শুরুর গোড়াতেই জনমনে সন্দেহ জেগেছে যে, দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল পরস্পরকে আসলে কতটুকু মানে? পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশের মানুষ বিশ্বাস করে, হাসিনা-খালেদার সদিচ্ছাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাঁরা ধারণা করেছিলেন, অতীতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের দূরত্ব কমে আসবে এবং দেশের কল্যাণে তাঁরা এক হয়ে কাজ করবেন।

কিন্তু তাদের রাজনীতি সারাটা বছরই দেখা দিয়েছে ‘পুরনো’ রূপে। তাদের মাঝে কাজ করেছে প্রতিহিংসার রাজনীতি। আমাদের দেশের রাজনীতিতে নেতিবাচক যে ধারণাটি ছিল, বিরোধী দল সরকারকে বিকল করতে চায় এবং সরকারি দল চায় বিরোধী দলকে দুর্বল করতে, তা এ বছরের রাজনীতিতেও দেখা গেছে। ফ্রান্সের বুরবোঁ সম্রাটরা বিপ্লবের অবসানে প্রতিবিপ্লবের ছত্রছায়ায় ক্ষমতায় এসেছিল। তাদের সম্পর্কে তখন বলা হতো, ‘তারা কিছু ভোলেনি, তারা কাউকে ক্ষমা করেনি এবং তারা কিছু শেখেনি।

’ বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি এক-এগারো থেকে কিছুই শেখেনি। তাদের এই কিছু না শেখার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতন্ত্র ও দেশের জনগণ। প্রসঙ্গত, সরকার গত ৮ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার ঢাকার সেনানিবাসের ৬ নম্বর শহীদ মইনুল রোডের আলোচিত বাড়ির ইজারা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ১২ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০ এপ্রিল তাঁকে বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ প্রদান করা হয়। এ বিষয়ে বেগম জিয়ার আপিল শুনানি এখনো চলছে।

উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের সেনানিবাসের ৯ বিঘার ওপর বাড়িটি তাঁকে প্রতীকি মূল্যে দেয়া হয়। আবার ‘নামে কী-বা এসে যায়’- ধ্রুব এ সত্যটি যে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল মানে না বা মানতে চায় না তা এ বছরের রাজনীতিতেও ফুটে উঠেছে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে বিগত (১৯৬৬-২০০১) আওয়ামী সরকারের সময়ে নামকরণ করা কিছু প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বঙ্গবন্ধু সেতুর নাম যমুনা সেতু, চট্টগ্রামের এমএ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পাল্টে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শেখ হাসিনা জাতীয় যুব কেন্দ্রের নাম জাতীয় যুব কেন্দ্র এবং বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের নাম পরিবর্তন করে ভাসানী নব থিয়েটার রাখা। আওয়ামী লীগও এ সংস্কৃতির ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাদ রাখেনি।

গত ১৪ ডিসেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, চারদলীয় জোট সরকারের সময় পরিবর্তিত স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের পূর্বের নাম বহাল রাখা হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলনের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র রাখা হয়েছে। ... বছর ধরে টিকে থাকা জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ রাখার ব্যাপারে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগতভাবে মতৈক্য হয়েছে। কাউন্সিল এবং হাসিনা-খালেদার সাক্ষাৎ শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলের কোনো বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ একটি বছর দেশে কোনো বিরোধী দলই ছিল না।

কেননা এ সময় তাদের কোনো কার্যক্রমই লক্ষ্য করা যায়নি। মূলত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকেই সাংগঠনিক দিক থেকে ছিল অনেক দূর্বল। তবে দলকে নতুন করে সাজিয়ে পূর্ণগতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশের আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য কয়েকটি দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগ এবং ৮ ডিসেম্বর বিএনপি কাউন্সিল সম্পন্ন করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সংস্কারপন্থীদের ঠাঁই নেই, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলের প্রেক্ষিতে সে সত্যটি উঠে এসেছে।

দুটো দলই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অনেক নতুন মুখের সন্ধান দিয়েছে। আবার শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সরাসরি সাক্ষাতের বিষয়ে দেশবাসী স্বভাবতই একটু উৎসুক থাকেন। এ বছরে তাঁদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হয়েছে দু’বার। ৯ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামীর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে তাঁর ধানমন্ডির বাসা সুধাসদনে এবং ১০ সেপ্টেম্বর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে তাঁদের সাক্ষাত ঘটে। তবে ১৭ অক্টোবর দারিদ্র বিমোচন সংক্রান্ত সমাবেশে তাঁদের দুজনের একই মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সে অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার আর যাওয়া হয়নি।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হম্বিতম্বি দেশের সংসদীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সবগুলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু এ কমিটি দেশের দায়িত্বশীল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। সেসব মানুষকে যখনই সংসদীয় কমিটি তলব করেছে, তাঁরা সংসদীয় কমিটির তলবের এখতিয়ার নিয়ে আইনি প্রশ্ন তুলেছেন। আবার তলব করার এখতিয়ার থাকলেও তাদের ডাকে সাড়া দিতে কেউ বাধ্য ননÑএমন যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন কেউ কেউ। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের কেউ সরকারি দলের, কেউ বিরোধী দলের এবং কেউ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের লোক।

উল্লেখ্য, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী, সাবেক চিফ হুইফ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সংসদীয় কমিটি তাঁদের তলব করে। কিন্তু তাঁরা কমিটির ডাকে সাড়া দেননি। বিশ্লেষকদের মতে, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তি নেয়ার এখতিয়ার সংসদীয় কমিটির আছে। যেহেতু তিনি সংসদ সদস্য। কিন্তু আখতার হামিদ সিদ্দিকী ও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সংসদীয় কমিটির অতি উৎসাহের নিদর্শন।

তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার সংসদের নেই। তাঁরা বর্তমানে সংসদ সদস্য নন। এক অর্থে তাঁরা সাধারণ নাগরিক এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত করার এখতিয়ার দুদকের। এম এ মতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগও দুদকে প্রেরণই যুক্তিযুক্ত। একইভাবে, দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব লে. জে.(অব) হাসান মশহুদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামকেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তলব করে, কিন্তু তাঁরারও এতে সাড়া দেননি।

সংশ্লিষ্ট অনেকেই সংসদীয় কমিটির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি হিসেবেই দেখেছেন। সরকারি প্রশাসনে স্থবিরতা: বছরের পুরোটা সময় সরকারি প্রশাসনে স্থবিরতা কাজ করেছে, গতি পায়নি প্রশাসন। মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দলীয় আনুগত্যে নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতির ধারা প্রশাসনের কাজে গতি কমিয়ে আনে। আগে থেকেই পদধারী কর্মকর্তাদের মাঝে বদলি বা পদোন্নতির চিন্তায় নিজের যথাযথ কর্তব্য পালনে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও সংসদে বাজেট বক্তৃতায় সরকারের গতিহীনতার কথা স্বীকার করেছেন।

বলেছেন, ‘প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। কোথাও যেন আটকে থাকছে। ’ আবার গত ৩১ মে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ (সোহেল তাজ)-এর স্বেচ্ছা পদত্যাগ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। উল্লেখ্য, সোহেল তাজের এ বিষয়টি ৩১ মে থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত অনেকটা ‘পদত্যাগ-পদত্যাগ নাটক’-এর সৃষ্টি করে। তাঁর ৩১ মে’র পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হয় ১৯ জুলাই।

সেদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি মানুষের বড় সম্বল তার নীতি, আদর্শ ও আত্মসম্মানবোধ। এসব বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রিত্ব করার লোক আমি নই। ’ তাঁর এ উক্তি প্রশাসনের ভেতরে নেতিবাচক পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার রায় এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ১৯ নভেম্বর বহু প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর দায়েরকৃত মামলা প্রায় ১৩ বছর প্রক্রিয়াধীন থাকার পর বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এক বিশেষ বেঞ্চ এগারো সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচজনের আপিলের ওপর দেয়া রায়ে তাদের প্রাণদণ্ডাদেশ বহাল রাখে।

অন্য ছয় প্রাণদণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা পলাতক আছেন এবং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করার কারণে তাদের বিরুদ্ধেও দণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এর মাধ্যমে বিশাল এক দায় থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ। আবার বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার রায় ঘোষণার আগে ২১ অক্টোবর রাতে মতিঝিল ঘটে আরেকটি উদ্বেজনক ঘটনা। সাংসদ ফজলে নূর তাপসকে লক্ষ্য করে তাঁর নিজ কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলা হয়। তিনি আহত না হলেও সেখানে আহত হন অন্তত ১৩ জন।

তবে এ হামলার সঙ্গে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠে আসে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করা হয়। এদিকে সারা বছর জুড়ে আলোচিত আরেকটি বিষয় ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি ছিল। ২৯ জানুয়ারি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সিদ্ধান্ত জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে পাশ হলে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে ব্যক্তিগত ও দলবদ্ধ অপরাধের বিচারের ধারা সংযুক্ত করে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনাল) আইন-২০০৯ নামের বিল ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৯ জুলাই সংসদে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। পাস হওয়া বিলে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের সহযোগী বাহিনীর বিচারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও দলবদ্ধ অপরাধের বিচারের বিধান রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য ছাড়াও একক কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। স¤প্রতি জানা গেছে, এ বিচার শুরু করতে আরো দুই মাসের মতো সময় লাগবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যামামলার রায় কার্যকর হওয়ার আগে সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজে হাত দেবে না। এছাড়া পর্যান্ত তথ্যচিত্র বা তথ্য সংগ্রহ, প্রশাসনিক প্রস্তুতি এবং বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণের কাজটি শুরু করতেও সময়ের প্রয়োজন আছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ক্রসফায়ার ২০০৯ সালটিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। এ বছরের জুলাই মাসে একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, ‘দেশে বেআইনি কাজে নিয়োজিত রয়েছে চার লাখ অবৈধ ও ২৫ হাজার বৈধ ুদ্র অস্ত্র। এ সংখ্যা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে থাকা ুদ্রাস্ত্রের চেয়েও বেশি।

প্রায় ছয় লাখ মানুষ এসব অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধী তৎপরতায় নিয়োজিত। এদের চালায় ১৩০টির মতো অপরাধী সিন্ডিকেট ও মাফিয়া গডফাদার চক্র। ’ ১১ অক্টোবর রসু খাঁ নামে দেশের প্রথম এক সিরিয়াল কিলারের সন্ধানও সে পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দেয়। দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ক্রসফায়ারকেই একমাত্র উপায় হিসেবে মনে করেছে সরকারÑ এমন মত ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তথা ক্রসফায়ার বন্ধের কথা বলা হয়েছিল।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাপ্তাহিক এখনকে দেয়া তথ্য মতে, এ বছর ক্রসফায়ারে মারা গেছেন প্রায় ১২৫ জন (জানুয়ারি-২২ ডিসেম্বর)। আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক ‘ক্রসফায়ার বলতে কিছু নেই’Ñএমন মন্তব্যও করেছেন। অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার ছিল বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। ২১ জুন ২০০৯ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অবৈধ ঘোষণার দাবিতে এবং এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচার চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও কর্মজীবী নারী জনস্বার্থে এ রিট দায়ের করে।

পরবর্তীতে ২৯ জুন ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গত ১৪ ডিসেম্বর ক্রসফায়ার নিয়ে হাইকোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন । ১৫ নভেম্বর মাদারীপুর সদর উপজেলার দুই সহোদর লুৎফর খালাসী ও খায়রুল খালাসীর ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়েমোটো) হাইকোর্টের দ্বৈতবেঞ্চ ১৭ নভেম্বর রুল জারি করেন। সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব, র‌্যাবের মহাপরিচালক, র‌্যাবে কর্মরত একজন মেজরসহ চারজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। রুল জারির পরও ১১ জন ক্রসফায়ারের শিকার হওয়াটাই হাইকোর্টের উদ্বেগের মূল কারণ।

সরকারপক্ষের সময় আবেদন করায় আগামী ৯ জানুয়ারি এ রুল শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। সূত্র মতে, ২০০৪ সালের র‌্যাব গঠনের পর নভেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত এক হাজার ৫৭ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। জঙ্গি তৎপরতার আধিক্য বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো বছরের শুরু থেকেই আগের চেয়ে কৌশলী ও গোছানো তৎপরতা চালনা শুরু করে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ সাত দেশের জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতির খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তান ভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবা, জইশে মোহাম্মদ, আসিফ রেজা কমাণ্ডো ফোর্স, ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন, হরকাতুল মুজাহিদীন ও হরকাতুল জিহাদ (হুজি)।

এছাড়া যুক্তরাজ্য, মিয়ানমার, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়া ভিত্তিক কয়েকটি জঙ্গিগোষ্ঠীরও এ দেশে যোগসাজশ থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মপ্রচেষ্টায় ২৪ মার্চ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার এক গহীন গ্রামে মাদ্রাসার আড়ালে পরিচালিত একটি জঙ্গি ঘাঁটি, ১৫ মে রাজধানীর মিরপুরের মণিপুরে জঙ্গিবাদের বোমা-বিস্ফোরকের গবেষণাগার এবং ২৬ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দুর্গম পাহাড়ে জেএমবির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রত্যেক এ জঙ্গি ঘাঁটি থেকেই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক, বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম ও সংশ্লিষ্ট অনেক বইপুস্তকের সন্ধান মেলে। মণিপুরে জেএমবির বোমা-বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বোমারু মিজান র‌্যাবের হাতে আটক হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো বেশ কিছু জঙ্গি আটক হয় এ বছরই।

যার মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি জেএমবির ঢাকা বিভাগীয় কমান্ডার মামুনুর রশিদ ও সামরিক কমান্ডার মোহতাসিম বিল্লাহ, ২২ জুন জেএমবির তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) শাখার প্রধান বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করা এমরানুল হক, ১৭ জুলাই আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের বাংলাদেশের প্রধান সংগঠক শেখ ওবায়দুল্লাহ এবং ১৩ নভেম্বর লস্কর-ই-তাইয়্যেবার ৩ পাকিস্তানি সৈন্য আটকের ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। প্রশ্নের মুখে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি যেকোনো দেশের জন্যই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা যে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব সেই এনএসআইয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা ঘটে, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্রের চালান। এ সংক্রান্ত মামলায় ১৯ এপ্রিল এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, ৩ মে সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) ইউং কমান্ডার (অব.) সাহাবউদ্দিন আহমেদ, ১৬ মে সাবেক দুই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম আব্দুর রহিম গ্রেফতার হন।

২০০৩ সালে বগুড়ার কাহালুতে আটক করা ট্রাক ভর্তি গুলি, বিস্ফোরকের চালানের সঙ্গেও জনাব সাহাবউদ্দিনের আহমেদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। আবার জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই) ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির সুপরিকল্পিত বিডিআর বিদ্রোহের তথ্য পূর্বে জানাতে পারেনি। বিডিআর বিদ্রোহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে সামরিক কিংবা আধাসামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ, হত্যাযজ্ঞ কিংবা নৃশংসা এ দেশে নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর জেল হত্যা, ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবী, ১৯৭৭-এর অক্টোবরে বিমান বাহিনীতে বিদ্রোহ, ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ড, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থান এবং ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আনসার বিদ্রোহে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের মতো এমন শোকাবহ ও জঘন্য হত্যাযজ্ঞ আর সংঘটিত হয়নি।

এ ঘটনা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেই তা বিরল। দীর্ঘ ৩৪ ঘন্টা শ্বাসরুদ্ধকর রক্তাক্ত ঘটনার অবসান ঘটে ২৬ ফেব্রুয়ারি। নিহতদের স্মরণে ২৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। পলাতক বিডিআর সদস্যদের ধরতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ‘অপারেশন রেবেল হান্ট’ শুরু হয় ২ মার্চ। ২১ মে সরকারি তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হওয়ার পর সরকার ২৭ মে উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকাশ করে।

১৫ সেপ্টেম্বর সরকার বিডিআর বিদ্রোহের বিচার বিডিআর আইনে এবং পিলখানায় হত্যা ও লুণ্ঠনের বিচার দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিদ্রোহের বিচার শুরুর লক্ষ্যে ৬ টি বিশেষ আদালত গঠন করা হয় ১৫ নভেম্বর । বাংলদেশ রাইফেলস অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় দুটি এবং ঢাকার বাইরে ৪টি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। বর্তমানে এর বিচার কাজ চলছে। ঐতিহ্যবাহী বিডিআর দুঃখময় ঘটনার কারণে ‘বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ’ (বিজিডি) নাম ধারণ করতে যাচ্ছে।

১৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিডিআর পুনর্গঠন সংক্রান্ত এক প্রস্তাবনার উপস্থাপনায় এ নাম করার প্রস্তাব করা হয়। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জনবলের ৩০ শতাংশ সশস্ত্র বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত যোগ্য লোকদের আত্তীকরণ করা হবে এবং বাকি ৭০ শতাংশ থাকবে বাহিনীর নিজস্ব জনবল। ৪ অক্টোবর পোশাক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিডিআর পুনর্গঠন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। অন্যান্য আরো ঘটনা ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা প্রকাশ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নানা সমালোচনা করেছেন।

তাছাড়া সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী দুদক পুনর্গঠনের কথা বলেছিলেন। ২ এপ্রিল দুদকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে লে.জে.(অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের ক্ষেত্রে তিনি কোনো কারণ না জানালেও সংশ্লিষ্টরা প্রভাবশালীদের বিভিন্ন চাপকেই কারণ বলে মনে করেছেন। এদিকে রমজানে চিনি মজুদ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চিনি কেলেঙ্কারির বিষয়টি ঈদুল ফিতরের পরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় । অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান দুটি হলো Ñ মেসার্স জয়েন্ট ট্রেডিং কর্পোরেশন ও মেসার্স শেখ ব্রাদার্স ।

সরকারের উচ্চ মহলের এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টতাুুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে অক্টোবরে দশটি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও। এ বছরটিতে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়টিও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আবার ‘শিক্ষানীতি ২০০৯’ গঠনের লক্ষ্যে ৮ এপ্রিল ২০০৯ শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ২৭ আগস্ট নায়েম ভবনে ২৩ তম সভায় পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি খসড়া চূড়ান্ত করে এবং তা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জমা দেয় ২ সেপ্টেম্বর।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আটটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন এ শিক্ষানীতি ২৪টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে ১৯টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং ৬৮ হাজার কোটি টাকায় তা বাস্তবায়নযোগ্য। নতুন এ শিক্ষানীতি নিয়েও বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের মাঝে অনেক বিরূপ মন্তব্যও দেখা গেছে। উল্লেখ্য, ৩১ আগস্ট মন্ত্রীসভার গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ নভেম্বর প্রথমবারের মতো দেশে শুরু হয় পঞ্চশ শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা।

সারাদেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রায় ৭৮ হাজার ৩৬৩টি স্কুলে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ২০ লাখের মতো শিশু এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল দেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা। আবার ১৯ জুন দিবাগত রাত ১১টায় ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে এনে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডে লাইট সেভিং টাইম (ডিএসটি) চালু করা হয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে নতুন এ নিয়মটি ১ অক্টোবরে আবার পরিবর্তিত করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। যদিও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

কতটুকু বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার প্রমাণ মিলেছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও। পুরো বছরই লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিও সাধারণ মানুষকে হতাশায় ফেলে দেয়। তবে ১১ নভেম্বর ৭ম বেতন কাঠামো অনুমোদিত হওয়ার বিষয়টি সরকারি চাকরিজীবীদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। অন্যদিকে গত ২৯ জুলাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৫টি ক্যাম্প ও তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নসহ একটি সম্পূর্ণ বিগ্রেড প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ধীরে ধীরে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হবে। ’৯৭-এর পর সেখান থেকে ২০০টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৯’র সরকারের এ সিদ্ধান্ত সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারেরই একটি ধারাবাহিকতা মাত্র। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শপিং মল বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে ভয়াভহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিও এ বছরেই ঘটে। ১৩ মার্চ দেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এ অগ্নিদুর্ঘটনায় সেখানকার ওপরের ৭টি ফোর সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।

এতে মর্মান্তিকভাবে নিহত হন ৭ জন এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর এটাই দেশের সর্ববৃহৎ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। গার্মেন্টস-শ্রমিক বিক্ষোভ এবং দূর্যোগ-দূর্ঘটনা পুরো বছরজুড়ে বিভিন্ন সময়ই গার্মেন্টস-শ্রমিকরা নানা কারণে বিক্ষোভে অংশ নেন এবং সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের অনেকের প্রাণহানির খবরও পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ২৮ জুন সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে একজন এবং ৩১ অক্টোবর টঙ্গী শিল্প এলাকায় ২ জন নিহতসহ শতাধিক আহতের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ২৮ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর রোকেয়া সরণিতে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে শতাধিক আহতের খবরও পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে এ বছরও প্রাকৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। ১৭ এপ্রিল ও ২৫ মে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে যথাক্রমে ঘূর্ণিঝড় ‘বিজলী’ ও ‘আইলা’। বিজলীতে ৫ জন এবং আইলার তাণ্ডবে কমপক্ষে ১১৯ জনের প্রাণহাণির খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া গত ১ ও ২ মে কালবৈশাখী ও বজ্রপাতে জামালপুর, ফেনী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ প্রাণ হারান ১৭ জন। এছাড়া ঘরবাড়ি, পশুসম্পদ ও ফসলেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।

এ বছরটিতে নৌ ও সড়ক পথে দুর্ঘটনাও ঘটেছে ব্যাপক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২৬ জানুয়ারি মাদারিপুরে আড়িয়াল খাঁ নদে ট্রলার ডুবিতে ১২ জন, ১৯ ফেব্রুয়ারি বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চডুবিতে ২৭ জন এবং ১০ মে চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় ৮ জন নিহত হন। গত পবিত্র ঈদুল আযহার আগের দিন রাতে অর্থাৎ ২৭ নভেম্বর ভোলার তেতুলিয়া নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় ৮৭ জন এবং তার এক সপ্তাহ পর ৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের মিঠামাইনে ট্রলারডুবিতে ৪৭ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। সড়কপথেও এ বছরে ঘটে বেশ ক’টি দুর্ঘটনা। ১৭ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটে ৯ জন, ১১ মার্চ পাবনার ঈশ্বরীতে ৩০ জন, ২১ মার্চ টাঙ্গাইলের বাসাইলে ১০ জন, ২০ মার্চ ফরিদপুরে ভাঙা উপজেলায় ৪ জন, ২৮ মে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কে ১৬ জন, ৭ জুন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে ১২ জন এবং ২২ জুন কমলাপুর রেলস্টেশনে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে রেলের নিরাপত্তা শাখার কর্মী একজন এবং ১১ জুলাই আশুলিয়ায় বাস-টেম্পো সংঘর্ষ ৪ জন নিহতের ঘটনা উল্ল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.