আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন সাধারন মফিজের অসাধারন্তের গল্প

একজন সাধারণ মানুষ যে সব সময় সাধারনই থাকতে চায়

মফিজের সাথে আমার ঠিক বন্ধুত্ব রকম সম্পর্ক ছিল না। ক্লাসমেট হিসাবে দু’চার কথা হয়ত বলতাম। পরিচয়ের পর্বটা এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। ঠিক কবে ও এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো আজ আর মনে নেই। একেবারেই সাধারন মানের এ মানুষটির চেহার ও চোখে ঠিক সদ্য পানাকরা নেশার ভাব থাকত বলে ওকে আমরা বাংলা মফিজ বলে ডাকতাম।

প্রতিদিন পড়া না পাড়া ছেলেদের সাথে শেষ বেঞ্চিতেই ও বসত। স্যারদের নির্বিচারে বেত্যাঘাত প্রতিবাদহীন এবং কথাহীন থেকে মার হজত করার একটা আশ্চর্য গুন ছিল ওর। আর এই গুনের জন্যই আমাদের ক্লাসের সকলের অপরাধের ও ছিল একমাত্র পাপি। আমরা তখন দশম শ্রেণীতে। এতটা ক্লাস ডিঙিয়ে মফিজের দশম শ্রেণীতে উঠার রহস্যটাও এখন আমার অজানা! সেবার আমাদের স্কুলে একটা নতুন নিয়ম তৈরী করা হলো।

পরবর্তী এস. এস. সি. পরীক্ষায় স্কুলের ভাল রেজাল্টের প্রত্যাশায়, এখন থেকেই আমাদের ক্লাসের সকল ছেলেকে বাধ্যতামূলক হোস্টেলে থাকতে হবে। সে সময় আমাদের মাঝে এ নিয়ে কোন প্রতিবাদ হয়নি। হয়তোবা পারিবারিক জীবন ছেড়ে কিছুদিন একলা হওয়ায় বাসনায়। পরে অবশ্য বুঝে ছিলাম এর চেয়ে বাব মার কাছে গৃহপালিত হয়ে থাকাটা অনেক সুবিধের। আনন্দের মাঝেই শুরু হওয়া আমাদের হোস্টেল জীবন পুরোপুরি নিয়মানুবর্তিতার মাঝে চলতে চলতে এক সকালে ঘটে গেলে একটি ব্যতিক্রমি ঘটনা।

হোস্টেলের পিয়নটা এসে আমাদের বলে গেলো এক্ষুনি সাবইকে হোস্টেল ইনচার্জ স্যার স্কুল মাঠে যেতে বলেছে কি যেন একটা ব্যাপার ঘটে গেছে? আমি মাঠে গিয়ে দেখলাম ইতি মধ্যে সব ছাত্রই প্রায় মাঠে এসে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে থেকে একটি মহিলা খুব চেচিয়ে কথা বলছে। যাকে আমরা গ্রামের নষ্ট মেয়ে বলেই জানি। তার অভিযোগ আমাদের হোস্টেলের কোন এক ছাত্র প্রায় মাস দুয়েক আগে তার ভালো মেয়েটির সাথে জোর করেই শাররিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। তার বক্তব্যের সারাংশ হলো; সে জানতো, সে যতই তার মেয়েকে এ পথে আসা থেকে আগলে রাখুক। একদিন কোন না কোন ভাবে তার মেয়ে এ পথই বেছে নেবে।

এতে তার দুঃখ বা অভিযোগ নেই। অভিযোগ হলো তার মেয়েটি না বুঝেই এখন সন্তান সম্ভবা হয়ে গেছে। আর এ সন্তানের দায়িত্ব কে নেবে। সে যত খারাপ মানুষই হোক না কেন জেনে শুনে একটা প্রাণ কে নষ্ট করতে পারবেনা। স্যারের কাছে তার অনুরোধ সে যেন সেই ছেলেটিকে খুজে বের করে।

আমাদের হোস্টেল ইনচার্জ স্যারটি খুব ধর্ম প্রাণ ছিল। উনাকে আমরা মৌলভি ছাড় বলে ডাকতাম। উনি এ অভিযোগ শুনে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার মেয়েটি কি ছেলেটিকে চিনতে পারবে? মহিলাটির উত্তর দেখলে অবশ্যই পাড়বে। স্যার বললেন ঠিক আছে আমি আজ স্কুল শুরু হওযায় পর হেড স্যারের সাথে কথা বলে রাখব তুমি কাল স্কুল শুরুর পর তোমার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে আস। ঐ দিন স্কুল শুরু হলো একটু অন্য রকম ভাবে।

স্যারদের মাঝে সর্বদা একটা গাম্ভীর্যের ভাব। পরে শুনাগেল হোস্টেলের সকল ছাত্রদের অভিভাবকদের আসতে বলা হয়েছে পরের দিন। এ সব ঘটনায় গ্রাম্য জীবনের সাথে মিল রেখে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় নিল না। সবাই অনুসন্ধানি হয়ে মূল অপরাধীকে খোজ করতে লাগল। আমরা কাসে সব মিলিয়ে ৯০ থেকে ১০০ জনের মতো ছাত্র ছিলাম এবং সবাই সবাইকে সন্দেহ করতে লাগলাম এবং অপরাধীর মত দিন কাটাতে লাগলাম।

এখানে দিন কাটানোর কথা এ কারনে উল্লেখ করালাম যে ঠিক পরের দিন এ ঘটনার নায়কে সনাক্তকরন ও বিচার হওয়ার কথা থাকলেও কোন এক গ্রাম্য কারনে তা হয়ে উঠতে সাতদিন লেগে গেলো। সে সময় মানুষ হিসাবে আমার বুদ্ধিমতা এত বেশি ছিল না যে এর পিছনে আমি অন্য কারন খুজে বেড়াব। আমি শুধু অপরাধী দেখার কথা ভাবছিলাম। ঠিক সাতদিন পর যখন স্কুলের সকল স্যার, অভিভাবক এবং গ্রামের হাজার হাজার মানুষের ঐ মেয়েটি সহ আমাদের হোস্টেলের সবাইকে কে এনে ফুটবল মাঠে খেলোয়ারদের সারিবদ্ধ দাড়ানোর মত দাড় করিয়ে দেয়া হলো। সত্য বলতে সে সময় আমি মেয়েটিকে দিকে তাকাতে পারিনি যদি মেয়েটি আমার কথা বলে দেয় এই ভয়ে।

তারপর মেয়েটিকে বলা হলো ছেলেটিকে সনাক্ত করতে ও খুব বেশি সময় না নিয়েই মফিজ কে সনাক্ত করল অপরাধী হিসাবে। মফিজ সে সময় তার চিরাচরিত প্রতিবাদহীন ভাষায় ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির দিকে। মৌনতা সম্মতির লক্ষন জেনে আমরা সাবাই ভেবে নিলাম মফিজ এ কাজটি করেছে। এনিয়ে আমাদের মধ্যে কোন দ্বীধাদন্ড রইল না। তবে আজ মনে হয় আমাদের রাগি হেড স্যার সেদিন আশ্চর্য রকম নীরব ছিল।

মফিজের সাথে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে কিছুদিনের জন্য একঘরে করে দেওয়া হলো। মফিজ স্কুল ছেড়ে দিল। তারপর একরম সাধারন মানুষ আর অপরাধীকে নিয়ে কিছু দিন গালগল্প চলার পর সবাই ভুলে গেলো সব। আমিও ভুলে গেলাম মফিজ কে। এরপর অনেক সময় গত হয়েছে আমি, আমরা স্কুল কলেজ পেরিয়ে কেউ চাকুরে, ব্যবসায়ী, কিংবা বিদেশ ভূইয়ে।

কিছু ক্লাসমেটে সাথে গ্রামে গেলে এখনও দেখা হয় কথা হয় মফিজের সাথে কখনও হয়নি। কিছুদিন আগে আমার এক চাচার মৃত্যুতে হঠ্যাৎ আমার মফিজ কে দেখে মনে হলো এই লোকটাকে আমি চিনি। আমার আর খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না ওকে চেনার জন্য ওই কাছে এসে বললো তুমি অমুক না আমি মফিজ চিনতে পেরেছো তোমার সাথে পড়ালেখা করেছি। আমি ঠিক ঐ ঘটনাকে মনে করে ওকে চিনতে পারলাম। এরপর কিছুদিন আমি গ্রামের বাড়িতে ছিলাম।

মফিজ আমাদের গ্রামেই একটি দোকান দিয়েছে। মাঝে মধ্যে ওখানেও গিয়ে বসতাম ওর সাথে কথা বলতাম। ওর দুটি মেয়ে । তারা লেখাপড়া করছে। একদিন কথায় কথায় ওকে জিজ্ঞেস করে ফেলতাম তুমি ঐ কাজটা কেন করতে গিয়েছিলে? ও মৃদু হেসে উত্তর দিল তোমার কি ধারনা আমি ঐ কাজটি করেছিলাম? আমি বললাম ওরকম করে আমি কখন ভেবে দেখেনি।

ভাবতে পারতে! যাই হোক, শুনো আমি ঐ কাজটি করেনি আমি শুধু মেয়েটিকে একটি পাপের রাস্তা থেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রতিবাদহীন থেকেছি । আর যে এ কাজটি করেছিলো তাকে আমি চিনি কারণ সে যে রাতে কাজটি করে হোস্টেলে ফিরেছিলো আমিই তাকে রুমের দরজা খুলে দিয়েছিলাম। আমি হতবাক হয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম সেদিন তবে তুমি কেন তাকে দেখিয়ে দাওনি বা কাউকে বলোনি ? ও বললো এর উত্তরতো তোমাকে আগেই কিছুটা দিয়েছি আর বন্ধু হিসাবে আরেক বন্ধু কে বিপদের মধ্যে ফেলতে আমার মনে সায় দেয়নি। আমি আবারো ওকে বোকার মত প্রশ্ন করলাম সেই সন্তান এখন কই? ও বললো সেই সন্তান বলছো কেন ওতো আমার সন্তান।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.