আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার প্রাইমারি স্কুল...নানা রঙের দিনগুলি.....



অনেক বড় মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটা পুকুর। পুকুরের চারধার বেশ কিছুটা খেলার জায়গা রেখে, সীমানাটা পুরো-বিল্ডিং আর আধা-বিল্ডিং-আধা-টিনের ঘরে ঘেরা; একদিকে স্কুল ঘর আর শিক্ষকদের কমোন রুম। অন্য দুইদিকে শিক্ষকদের হস্টেল। ছোটবেলার চোখে লেগে থাকা সেই স্কুলটাকে এখনো মনে হয় বি-শা-ল।

বড় রাস্তার একপাশে আমার প্রাইমারি স্কুল, অন্য পাশে সেন্ট যোসেফ'স হাই স্কুল, তার ও পাশে করোনেশন গার্লস স্কুল। এরপর সুন্দরবন কলেজ। একই লাইনে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শহরটা খুলনা। আর আমার প্রাইমারি ইশকুলের নাম ছিল - পি.টি.আই. (প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউশন), আমরা বলতাম 'পিটাই' স্কুল।

কারনও ছিল - ওখানের শিক্ষকরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন কিনা কে জানে! ওনারা পিটানোতে ওস্তাদ ছিলেন। আরবী স্যারের নাম ছিল বোধ হয় - জামাল স্যার। খুব আনন্দ পেতেন বেত চালাতে। কারন কার্যটি সম্পাদনের সময় উনি হাসিটি হারাতেন না। বিরামহীন বেত চালিয়ে যেতেন।

জামাল স্যারের ক্ষেত্রে আরো একটা বিষয় প্রজোয্য - স্যার খুব সম্ভবতঃ নিরিখও অনুশীলন করতেন - একই জায়গায় বেতের বাড়ি! উহ সে যন্ত্রণার ভিতর না পড়লে বোঝানো যাবে না। আরবী ছিল এমনিতেই আতঙ্ক তার সাথে যোগ হতো জামাল স্যার-দুইয়ে মিলে মহাতঙ্ক! যে প্রাইমারির পর আরবী তুলে দেওয়ার মত বুদ্ধি দিয়েছিলেন ঈশ্বর তাকে শান্তিতে রাখুক বা বেহেস্ত নসীব করুক । ছিলেন ভুঁইয়া স্যার -স্যারের এক পায়ে সমস্যা ছিল। কিছুটা ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটতেন, সাথে ছিল গিঁটওলা লাঠি, লোহার মত শক্ত। উহ্! ওই জিনিসের অভিজ্ঞতা শত্রুরও যেন না হয়।

স্যার পড়াতেন ভূগোল। স্যার আর গিঁটওলা লাঠির ভয়ে ভূগোলের ম্যাপ পুরোটাই আমাদের কাছে এলোমেলো 'পি'। আমি যে আমার স্টেটমেন্টে সৎ তার প্রমাণ আমি রেখেছি মেট্রিকে। পাক্কা ঈমানদার। কোনমতে, টেনেটুনে, কানের গোড়া দিয়ে গুলি বের হয়ে গেছে।

কাজী স্যার ছিলেন সম্পুর্ণ আগুনে তৈরী। মনে পড়ে না স্যারকে কখনো হাসতে দেখেছি। ঝাকড়া চুল আর চাপ দাড়ির রাসভারী কাজী স্যার। আগুন বলে কথা; স্যারকে আমরা কখনো ঘাটতে যাইনি। উরে বাপ্স্।

ভয়ের ঠেলায় মনেই পড়ে না স্যার কি পড়াতেন। ফরিদ স্যার ছিলেন আরেক আগুন। তবে উনি হাসতেন আবার পিটাইতেনও। মাঝে মাঝে স্যার দিনের শেষের দিকের ক্লাসে এসে গানের ক্লাস নিতেন (আব্দার ধরতেন বলাই ভাল)। গান জানো আর না জানো - কিছুতেই কিছু যায় আসে না - গান তোমাকে গাইতেই হবে।

মনে আছে কামাল নামের আমাদের এক বন্ধু 'মা' নিয়ে এক গান গেতে গিয়ে ফরিদ স্যারের ভয়ে না আবেগে কে জানে, দু চোখের পানিতে বন্যা নামিয়ে দিয়েছিল। সে দৃশ্য দেখে যে কোন মায়ের চোখও ভেসে যাবে কিন্তু ফরিদ স্যার বলে কথা! আরো গান কর্ - সে কী নিষ্ঠুর আব্দার! আর মনে পড়ে দূর্বোধ্য পদাসীন আমাদের 'সুপারিন্টেন্ডেন্ট' স্যারকে! এই পদের নাম প্রাইমারি স্কুল তো দুরের কথা বহু বছর উচ্চারণই করতে পারি নাই। তো আমাদের এই 'সুপার' স্যার ছিলেন সেইরকম! শুকনা মানুষ কিন্তু পরতেন পান্জাবি-পায়জামা যেন বাঁশের সাথে কাপড় ঝুলে আছে। কিন্তু হলে হবে কি - বাঘেমহিশের মত শিক্ষকছাত্র এক ঘাটে পানি খাওয়ার মত অবস্থা ছিল। স্কুলটাতে তারপরও একটা মায়া ছিল।

প্রশিক্ষণে আসা শিক্ষকদের ছায়া ছিল। ভীষন ভাল ব্যবহার ছিল তাঁদের। আমাদের ক্লাস ছিল ওনাদের জন্য প্রাকটিক্যাল। ওনারা যখন প্রাকটিক্যালে আসতেন আমাদের জন্য সেটা স্বর্গসুখ । আমাদের 'হানিমুন পিরিয়ড'।

নো পিটাপিটি। হাসি-হাসি মুখ; বাবা সোনা সম্বন্ধ। সাথে কিছু উপহারও -আহা! কিন্তু ভাল দিন বেশীদিন টেকে না। টেকেওনি। খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যেতো সেসব দিনগুলো! স্কুলটাতে তারপরও একটা মায়া ছিল।

পিটাই স্কুলেই ক্লাস ফোরে আমি প্রথম প্রেমে পড়ে যাই। ছেলেমেয়ে এক ক্লাসেই পড়াশোনা, তার ভিতর হঠাৎ একদিন 'মেঘ সরায়ে ফুল ঝরায়ে' বাবার বদলি সূত্রে শ্যামল এক মেয়ের আগমন। আচরণেই বোঝা গেল বাবা-মায়ের আহ্লাদি কন্যা। সুতরাং তার কথা তো ভাল লাগবেই। লেগে গেল! তার বাসস্থান চিনলাম, কোন্ রাস্তা বেশী ব্যবহার করে জানলাম।

স্কুল থেকে দেরী করে বের হতে শুরু করলাম যেন বাসায় ফেরার পথে তাকে দেখা যায় তার বাসার বারান্দায়। স্কুলের নাম 'পিটাই' সুতরাং সে যেই হোক না কেন, হোক না আমার প্রথম প্রেম, তাতে কার কি আসে যায় - তাই তাকেও পিটাই খেতে হতো। এতযুগ পরে শুধু মনে আছে তার কাঁপা হাত, যে হাতে জামাল স্যার, ফরিদ স্যার, ভুঁইয়া স্যার, কাজী স্যাররা বেতের বাড়ির চর্চা করেছেন। স্কুল জীবনে বন্ধু ভাগ্য ভাল ছিল না মোটেই। শিক্ষকদের 'পিটাই' অংশ বাদ দিলে ভীষন নিঃসঙ্গ কেটেছে।

কষ্ট করেও একটা বন্ধু'র মুখ মনে করতে পারি না! অথচ আমার সেই নিঃসঙ্গ পুরো স্কুল জীবনের একমাত্র স্মৃতি একটা কাঁপা হাত। সেই আমার প্রাইমারি স্কুল! টিফিনে চালতা'র চাটনি, তেঁতুল টকে ভিজিয়ে কাঠি গেঁথে আলু সেদ্ধ কিংবা রহমান ভাইয়ের চটপটি খাওয়া আমার নানা রঙের 'পিটাই' স্কুলের দিনগুলি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.