আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইসলামে খোশ আমদেদ :



আলহামদুলিল্লাহ। বোন খোশ আমদেদ। একথা বলে আমার নতুন বোনেরা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুম্বন করলেন। একজন বয়স্কা আফগান মহিলা আমার গালে তিনবার চুম্বন করলেন। তার চোখ দু'টি খুশীতে চিকচিক করছিল।

তার মুখে দাঁত নাই। কিন্তু তার ফোকলা মুখের হাসি ছিল প্রাণবন্ত। কেউ কারো ভাষা জানি না। এজন্য কথা বিনিময় করতে পারিনি কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য ভাষার প্রয়োজন হয় না। এমনি করে আমার রূহানী সফরের শেষ পর্যায়ের শুরু হয়েছিল।

এই সফর আমাকে মসীহর জন্য ইহুদী তথা জিউ ফর জেসাস-এর সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রবেশ করিয়েছিল। তারপর আমি পুনরায় ইহুদী ধর্মমত পরীক্ষা করলাম। দীর্ঘকাল আমি ধর্মহীন জীবন কাটিয়েছি। সে সময় আমি কোন ধর্মের অনুসারী ছিলাম, কোন ধর্মের সত্যতাও সন্ধান করিনি। আমার জীবনের এই শূন্যতার সে সময় অবসান ঘটলো।

যখন আমি বুদ্ধমতের তিন জাওয়াহেরে আশ্রয় নিলাম। এ অবস্থা চললো পাঁচ বছর। দুই বছর আগে একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি আমাকে ইসলামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমার নতুন জীবন কাহিনী বলার আগে আপনাদের কিছুটা অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই, আমি মরক্কোয় ইহুদী পিতামাতার সংসারে বড় হয়েছিলাম।

আমার দাদা-দাদী এবং আমার পিতা-মাতা পারিবারিক জীবনে ইহুদী জীবনধারা কঠোরভাবে অনুশীলন করতেন না। বছরে আমরা তিনবার বড় ছুটি পালন করতাম। প্রতি সপ্তাহে দাদা-দাদীর নিকট ‘ছাবত' অর্থাৎ পবিত্র শনিবার পালন করতে যেতাম। কিন্তু সেখানে পবিত্র শনিবারের নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে পালিত হতো না। আমার পিতা এবং চাচা জহুরানের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ধরাতেন।

সিনাগগের পবিত্র দিন সমূহে আমি পিতা এবং দাদার মাঝখানে বসতে পছন্দ করতাম। সাদা এবং নীল চাদরে আচ্ছাদিত লোকদেরকে গেমাঈয়া দোয়া পাঠের সময় ভাবের ঘোরে আন্দোলিত হতে দেখতাম। শোফার নামের গান শোনা ছিল আমার নিকট পছন্দনীয়। মহিষের শিং বাজিয়ে এই গান করা হতো। এই গানের সুরলহরী মনে হতো ভিন্ন জগতের।

আমার দেহের লোম খাড়া হয়ে যেতো। এতো কিছু সত্ত্বেও পারিবারিক জীবনে ধর্ম বেশি কিছু ছিল না। মিসর থেকে ইহুদীদের মুক্তি পাওয়ার আনন্দ উপলক্ষে একটি জিয়াফতের আয়োজন করা হয়। কিভাবে বনি ইসরাইলীরা মিসরের ফেরাউনের নির্যাতন থেকে হযরত মুসা (আ) নেতৃত্বে মুক্তি লাভ করেছিল আমার দাদা সে কাহিনী পড়ে শোনাতেন। ফেরাউন তার সৈন্যদলসহ বনি ইসরাইলীদের তাড়া করেছিল।

তারপর ফেরাউন এবং তার বিশাল সৈন্যদলসহ নীলনদে ডুবে মরেছিল। কিন্তু সে সময় আমি এতো ছোট ছিলাম যে, এই কাহিনীতে কোন আকর্ষণ খুঁজে পেতাম না। আমি শুধু উক্ত অনুষ্ঠানে তৈরি করা খাবার খেতে পছন্দ করতাম। আমার দাদার মৃত্যুর পর উক্ত কাহিনী পড়ে শোনানোর দায়িত্ব জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে আমার পিতার উপর বর্তায়। কিন্তু আমার পিতা কখনো পুরো কাহিনী পড়তেন না।

কাফফারার দিনে আমরা সবাই রোযা পালন করতাম। আমরা মনে করতাম রোযা রাখার চিন্তা পাপ থেকে নাজাত দেবে। আমি মেজাজ গরম করে বলতাম, একদিনের রোযা তো আমার নিজের পাপের কাফফারার জন্য যথেষ্ট নয়। ইহুদীবাদ এমন মজহাব যাকে আমি নিজস্ব বলতে পারি। কিন্তু এই মজহাব বা ধর্ম ছিল শুধুমাত্র লৌকিকতাপূর্ণ।

এতে রূহানিয়াত বলতে কিছু ছিল না। এই ধর্মে দৈনন্দিন এবাদতের ব্যবস্থা ছিল না, সম্মিলিত এবাদতের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি আল্লাহর জিকির পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু প্রথমদিকে আমার ভেতর এক ধরনের রূহানিয়াত আমি অনুভব করতাম। রোববার যে সময় গীর্জায় ঘণ্টা বাজানো হতো সে সময় আমি সাদা গীর্জার দিকে অগ্রসর হতাম।

আমি গভীর আগ্রহে গীর্জার ভেতরে যেতাম এবং দেখতাম ক্যাথলিক খৃস্টানরা কি কাজ করে। পবিত্র পানিতে আমি নিজের হাত ডুবিয়ে রাখতাম, বুকে ক্রস অাঁকতাম এবং রুকু করতাম। মুয়াজ্জিনের মধুর কণ্ঠের আযানধ্বনি ভেসে আসতো। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমি মুসল্লিদের নামাযের কাতার সোজা করার দৃশ্য দেখতাম। খৃস্টান নানদের লম্বা কালো জামা পরিধানের দৃশ্য দেখে আমিও তাদের মতো এবাদত করতে আগ্রহী হতাম।

এই পটভূমির বর্ণনায় আপনারা বুঝতে পারবেন আমি সত্যের সন্ধানে জীবন কাটাচ্ছিলাম। আমি আল্লাহকে খুঁজছিলাম। আমার অবস্থা ছিল ঠিকানা না জেনে শহরে আসা পথিকের মতো। ঠিকানার সন্ধানে সেই পথিক কখনো এখানে যাচ্ছে কখনো ওখানে যাচ্ছে। সত্যের সন্ধানে থাকার সময়ে আমি কখনো মনজিলের কাছাকাছি পৌঁছাতাম কখনো মনজিল থেকে দূরে চলে যেতাম।

তবে দৃঢ়সংকল্প ছিলাম যে, আমি শেষ পর্যন্ত অবশ্যই মনজিল খুঁজে পাবো। আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ কাউকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাইলে তিনি তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। (সূরা আনআম, আয়াত ১২৫) ১৯৬৬ সালে আমাদের আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ আসে। সে সময় আমার বয়স ছিল উনিশ বছর। যেখানে আমি একটি সাংস্কৃতিক মনোবেদনার সম্মুখীন হই।

আমার মনে আছে সেখানে আমার এক বয়স্ক ফুফুর মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেস্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য সিনাগগে প্রবেশ করেছিলাম। সে সময় লজ্জায় আমি লাল হয়ে গিয়েছিলাম। দোয়া প্রার্থী এবং রাবিবর কর্মকান্ডে আমার বেজায় হাসি পাচ্ছিল। কিছুতেই আমি হাসি থামাতে পারছিলাম না। রাবিবর হিব্রু ভাষা উচ্চারণ ছিল হাস্যকর।

দোয়ার পর আমার মতো মেয়েদের সাবালিকা হওয়ার অনুষ্ঠান ‘ব্যাট মিটজবাহ' পালিত হচ্ছিল। মরক্কোয় এ রকম অনুষ্ঠানের কথা কখনো শুনিনি। এ কারণে আমি এবং আমার পিতা হাসতে লাগলাম। আমি ব্যাট মিটজবাহর প্রতি কোন আগ্রহ অনুভব করছিলাম না। তবু সেখানের মেয়েদের সাবালিকা হওয়া প্রমাণের উক্ত অনুষ্ঠানে হিব্রু ভাষা এবং তাওরাতের সবক দেয়ার দৃশ্য দেখে স্থানীয় মেয়েদের প্রতি আমি ঈর্ষান্বিত হয়েছিলাম।

১৯৬৮ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে এক মাসের জন্য আমি ইসরাইল গেলাম। সেখানের সব জিনিসের প্রতি আমার মনে ভালোবাসা তৈরি হলো। ইসরাইল ছিল মরক্কোর মতোই। একারণে ফিরে এসে আমি ইসরাইলে বসবাসের আগ্রহ ব্যক্ত করলাম। কিন্তু আমার পিতা বললেন কিছুতেই না।

আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যতো কিছু হোক আমি আবার আসবো ১৯৭২ সালে পুনরায় ইসরাইলে গেলাম। সেখানে আমি হিব্রু ভাষা শিক্ষা করছিলাম এবং একটি কিউবিটসে কাজ জুটিয়ে নিলাম। নিজের ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহের কারণেই আমি ধর্মীয় কিউবিটস বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু তিন বছর পর হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। এ সময়ে অবশ্য আমি হিব্রু ভাষা শিক্ষা করেছি, আদেশ নিষেধ সম্পর্কিত এবং খানাপিনার রীতিনীতি শিক্ষা করেছি।

পবিত্র দিনসমূহ সম্পর্কেও আমি অনেক কিছু জেনেছি। কিন্তু ইহুদী মতবাদ সম্পর্কে কিছু শিখতে পারিনি। আমি বুঝতে চাইছিলাম আমরা ইহুদীরা কিভাবে আল্লাহর বন্ধু হলাম এবং কি কারণে বিশ্বের মানুষ ইহুদীদের ঘৃণা করে। ইহুদীদের উপর কেন বারবার কঠিন পরীক্ষা নেমে আসে। কিউবিটস থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি ফিলিস্তিনের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরতে লাগলাম।

সিনাই দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত গেলাম। আত তূর-এ গেলাম। মনে হচ্ছিল সেটি ভূতের বাসস্থান। স্থানীয় অধিবাসীরা উক্ত এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। কারণ উক্ত এলাকা ইসরাইল অধিকার করে নিয়েছে।

সিনাই-এর পশ্চিম দিকে এবং উত্তর দিকে আবু রুবাইস সফর করলাম। এসব সফর কখনো সামরিক জীপে কখনো বাসে কখনো ট্রাকে করেছিলাম। আরব বালকেরা আমাকে অবাক হয়ে দেখতো যে এই মেয়ে এখানে মরুভূমিতে একাকী কি করছে। এক পর্যায়ে আমি ঘরে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু পিতা টাকা পাঠালেন না।

একারণে ঘরে ফিরে যাওয়া হয়নি। আমি পিতার ইচ্ছার বিপরীতে ইসরাইলে গিয়েছিলাম একারণে পিতা আমার কোন দায়িত্ব নিতে রাজি ছিলেন না। তিনি আমাকে জবাব পাঠালেন যে, সাঁতার দিয়ে ঘরে আসো। পিতার এই মনোভাবে আমি ব্যথিত হলাম। কিছু সংখ্যক যীশুর দেওয়ানার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর আমার চোখের দৃষ্টি খুলে গেল।

তারা নিজেদেরকে জিউ ফর জেসাস অর্থাৎ যীশুর জন্য ইহুদী পরিচয় দিচ্ছিল। আমি কিছু জানার জন্য তাদের সঙ্গী হলাম। তারা আহাদনামা আতিকের কয়েকটি আয়াত আমার উপর প্রয়োগ করতে চাইলো। অথচ এটা কোন প্রয়োজন ছিল না। ঈসা মসীহর আগমণ, তার প্রতি সম্বর্ধনা তাঁর সঙ্গে আচরণ এসব কিছু হযরত মুসার পাঁচ কিতাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত আমি ঘরে ফিরে এলাম পিতামাতার নিকট যখন জিউ ফর জেসাস-এর ঘটনা বললাম তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা আমাকে অনুরোধ করলেন ইহুদীয়াতকে আর একবার যেন সুযোগ দেই। এখান থেকে আমার জীবনের শুষ্ক রুগ্ন অধ্যায়ের শুরু হয়। এই অধ্যায় বারো বছর দীর্ঘ হয়েছিল। আমার মন পরিচ্ছন্ন করার জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল।

তবে একটা বিষয়ে আমি গর্বিত যে, আমি আমার বান্ধবীদের চেয়ে ভাগ্যবতী। কারণ আমি আমার বান্ধবীদের মতো আমি কোরিয়ান সান মা ইয়াং মুনের অনুসারীদের পাল্লায় পড়িনি অথবা হরেকৃষ্ণ ফেরকার পেছনে কখনো ছুটে বেড়াইনি। ১৯৮৬ সালে একজন মিশনারী আমার মেয়ের হাতে একখানি হ্যান্ডবিল গুঁজে দেয়। সেখানে শু শু বুদ্ধমত সম্পর্কে কিছু লেখা ছিল। বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানতাম না তবে এটা জানা ছিল যে তারা বিদেশে মুবাল্লিগ প্রেরণ করেনা।

আমি তাদের ফাঁদে পা দিলাম না। তবু একটি বৌদ্ধ মঠ খুঁজে বের করলাম এবং বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জানতে সচেষ্ট হলাম। পাঁচ বছর যাবত বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। এ সময়ে মাহায়ান ফেরকার নবীর অনুসারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এর অর্থ হচ্ছে আজিম গাড়ী।

সে সময় তিববতিয়া এবং বিজয়াইয়ান-এর পরিচিত হয়েছি। তাদের বলা হতো হীরা গাড়ী। এরা সকল বাধা অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হতো। ইহুদীয়াত এবং ঈসায়ীয়াতের মতো একত্ববাদের দাবীদার ধর্ম থেকে হতাশ হওয়ার পর আমি খোদার সন্ধানে বুদ্ধমতের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। জানা গেল বুদ্ধমত হচ্ছে ধর্মের চেয়ে অধিক একটি জীবন দর্শন।

এই ধর্মের পাপ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। প্রতিটি বিষয়ের কারণ এবং ফলাফল ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া রয়েছে। নিজের কাজের জন্য মানুষ নিজেই বহুলাংশে দায়ী। মানুষ নিজেই নিজের বিচারক। মূর্তির সামনে মাথা নত করতে আমার কোন সংকোচ হয়নি।

কারণ আমি জানতাম তারা দেবতাদের প্রতিনিধি। তাছাড়া এসব মূর্তি মহাত্মা বুদ্ধের স্বভাবের বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তোলে। ওয়াজিরিয়ান ফেরকার সঙ্গে মেলামেশার পর বুঝলাম ডজন ডজন দেবদেবী রয়েছে। ধর্মীয় রসম রেওয়াজ রয়েছে এবং কঠিন কঠিন ওজিফা পাঠের জন্য দীর্ঘ মন্ত্র রয়েছে। এ সময় তিববতি ভাষার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।

পর্যায়ক্রমে আমি এমন জায়গায় পৌঁছলাম। যেখানে কয়েকজন প্রাক্তন ইহুদী, প্রাক্তন খৃস্টান বৌদ্ধধর্মের অনুসরণে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম মহাত্মা বুদ্ধ যদি পুনরায় ধরাধামে আসতেন তবে তার শিক্ষার পরিণতি দেখে ভীষণ ব্যথিত হতেন। তিনি দেখে লজ্জা পেতেন যে তার অনুসারীরা তাকে খোদা জ্ঞানে তার উপাসনা করছে। পিপল গাছের নীচে বসে বুদ্ধ যে ধ্যান করেছিলেন সেই ধ্যানের উদ্দেশ্য কি এটাই ছিল যে তার অনুসারীরা এভাবে তার শিক্ষাকে বিকৃতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেবে? হযরত মুসা (আঃ) এবং হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুসারীদের অবস্থা দেখে এই দুই নবীও ভীষণ কষ্ট পাবেন।

ইসলাম এবং মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হওয়ার কারণেই শেষ পর্যন্ত আমি মুসলমান হয়েছি। ইসলাম এক চিরকালীন এবং শাশ্বত জীবনাদর্শ। এবং জীবন বিধান। আগেই উল্লেখ করেছি যে, মালয়েশিয়ার এক ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সে অন্য তিনজন সঙ্গী নিয়ে আমার বাসার কাছাকাছি অবস্থান করছিল।

এই চারজনের একজনের সঙ্গে কিছুদিন আগে একটি হেলথ ফোর্ড সুপার মার্কেটে আমার দেখা হয়েছিল। সেই ছাত্র সেখানে পার্টটাইম চাকরি করতো। এই চার যুবক আমার প্রতিবেশী হওয়ার পর পরিচিতির এবং কুশল বিনিময়ের জন্য এলো। আমরা উভয়ে উভয়কে নিজেদের ঘরে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। তারা আমার ঘরে বুদ্ধমূর্তি এবং অন্যান্য মূর্তি দেখে বিরক্ত হলো।

তাদের মধ্যে একজন এই চিন্তায় পড়ে গেল যে, এই মহিলা তো ইহুদী, কিন্তু বৌদ্ধধর্মের ছায়ায় এলো কি করে? আমরা কয়েক ঘণ্টা আলাপ আলোচনা করলাম। আমি খুব শীঘ্র বুঝলাম যে, ইসলাম সম্পর্কে আসলে আমি কিছুই জানি না। আমরা আয়াতুল্লাহ খোমিনী, সালমান রুশদী, এবং ইসলামে নারীদের প্রকাশ্যে নির্যাতন সম্পর্কে আলোচনা করলাম। আমি একথা জেনে অবাক হলাম যে, কোন কোন মুসলিম দেশে নারীরা যদি জোর জুলুমের শিকার হচ্ছে কিন্তু অন্যান্য মুসলিম দেশে এরকম অবস্থা নাই। সেই যুবক ইসলামকে জবরদস্তি আমার ভেতর প্রবেশ করাতে চায়নি।

বরং সে পর্যায়ক্রমে ইসলামের মূল্যবোধসমূহ আমায় তুলে ধরেছে। কথায় কথায় ইসলামের হিজাব অর্থাৎ পর্দা প্রথার প্রসঙ্গ এলো। আমার ধারণা ছিল যে, মুসলমান পুরুষরা নারীদের রূপ যৌবন এবং সৌন্দর্য দেখে পাগল হয়ে যায়, একারণে ওইসব পাগলের হাত থেকে মুসলিম নারীদের নিরাপদ রাখার জন্যই তাদেরকে পর্দায় সর্বাঙ্গ জড়িয়ে রাখা দরকার। সেই যুবক আমাকে কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় এবং তাদের নিজেদের পরিবারের উদাহরণ উল্লেখ করে। আমি মনে করতাম মুসলিম মেয়েরা নিজের জীবন সাথী নিজে বাছাই করতে পারে না।

অথচ এই যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যুবক আমাকে জানালো যে, আমার জন্য এরকম চিন্তা কতো মধুর যে, আমার স্ত্রীর হাত পা, গ্রীবা, বাহু, চুলের সৌন্দর্য আমিই দেখবো এবং বেগানা পুরুষদের দৃষ্টি থেকে এসব কিছু ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করবো। একথা শোনার পর আমি যুবকের প্রতি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। অথচ পশ্চিমা দেশসমূহের নারীদের হাত পা, চুল, বাহু, গ্রীবা সবসময় খোলা থাকে। এসব কিছুকে মনে করা হয় প্রদর্শনের জিনিস।

পশ্চিমা পোশাকের কথা আমি চিন্তা করলাম। আমি বুঝতে পারলাম যে, সকল প্রকার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা পাওয়া সত্ত্বেও আমরা সুখী নই। আমাদের সকলের আত্মা উপোষ এবং অতৃপ্ত। ডলারকে দেবতার আসনে আমরা বসিয়েছি। নারীদেহের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার কাজে হাজার হাজার ডলার ব্যয় করা হয়।

একাজে মানুষের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হলেও কিছু আসে যায় না। যেসব নারী অতিরিক্ত স্থূলকায়, মোটা হওয়ার কারণে অথবা অতিরিক্ত পাতলা হওয়ার কারণে টিপটপ হয়ে সাজসজ্জা করতে পারে না, মেকআপ নিলেও যাদের রূপের বাহার খোলে না, তাদের নিকট জীবন হচ্ছে এক রকমের যন্ত্রণা। তরা হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার প্রতি সমবেদনা প্রকাশকারী এই মালয়েশিয়ান যুবক সত্যিকার ইসলামের সন্ধানে বের হয়েছিল। সে জানতো ক্ষমতার মসনদে বসা লোকেরা অনেক কিছু নিজেদের স্বার্থের অনুকূল করে তৈরি করেছে।

কিন্তু এই যুবকের পটভূমি ছিল আমার চেয়ে ভিন্ন রকম। তার পরিবারের লোকেরা একত্রে নামায আদায় করতো। বিকেলে একত্রে বসে কুরআন পাঠ করতো। ধর্ম ছিল তাদের জীবনের চালিকাশক্তি। এই যুবকের প্রতি আমি ঈর্ষাবোধ করতাম।

ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বড় বোঝা আমি বহন করছিলাম। এই যুবক সেই সকল ভ্রান্ত ধারণা একে একে সরিয়ে দিচ্ছিল। উদাহরণ দিয়ে নিজের আচরণের মাধ্যমে এবং কুরআনের আয়াত দিয়ে সে আমাকে পথনির্দেশ দিচ্ছিল। যুবক নামায আদায় করতো। আমি তার নামায আদায়ের দৃশ্য দেখতাম।

আমি ধ্যানে যখন মগ্ন হতাম তখন যুবক আমার প্রতি তাকিয়ে থাকতো। আমরা কখনা নদী তীরে কোন পাহাড়ী এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য যেতাম এবং সেখানে নিজ নিজ এবাদত সম্পন্ন করতাম। আরো এক বছর কাল আমি বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে আবিষ্ট ছিলাম। এ সময় সর্বক্ষণ পড়তাম, সংবাদপত্র পড়তাম। আরব দেশ, এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি সম্পর্কে বহু সংখ্যক গ্রন্থ এবং ম্যাগাজিন এ সময়ে আমি পাঠ করেছি।

আমি হার্টফোর্ড শেমজির ‘ইসলামী কর্মসূচি পর্যালোচনা' শুনতাম এং সেখানে আরবি শিখতে যেতাম। সেখানে ইব্রাহীম আবু রবিই নামে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে তার বক্তৃতা শোনার আমন্ত্রণ জানান। শেমজির প্রকাশিত দি মুসলিম ওয়ার্ল্ডে আলী শরীয়তীর নাম পড়লাম। তারপর তার লেখা গ্রন্থ খুঁজে পাঠ করলাম।

তার লেখা আমাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করলো। এরকম একজন নিষ্ঠাবান মহৎ মুসলমানের মৃত্যুর কথা জেনে আমি ব্যথিত হলাম। এ সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে আমি রমজানের রোযা রাখতে শুরু করলাম। আমার বন্ধুরা আমার রোযা রাখা দেখে খুশি হলো। কিন্তু তারা কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেনি যে, আমি কবে ইসলাম গ্রহণ করবো।

তারা আমাকে নিজেদের একজন মনে করতো এবং আমার প্রতি তাদের সমবেদনাও ছিল। যদিও আমি ছিলাম ইহুদী অথবা খৃস্টান। অবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায় ঘনিয়ে এলো। মালয়েশিয়ার এক ভাই আমাকে একটি বই পাঠ করতে দিলো। সে ভাই গ্রাজুয়েশন করে দেশে ফিরে যাচ্ছিল।

তার দেয়া বইটির নাম হচ্ছে বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান। লিখেছেন মরিস বুকাইলি। এ বইটি পড়ে আমি ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। এ গ্রন্থটিতে ইসলামী বিশ্বাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ সম্পর্কে আমার মনে যেসব প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে। একজন মুসলিম ভাই আমাকে এক কপি কুরআন উপহার দিয়েছে।

মরিস বুকাইলির গ্রন্থটি পাঠ করার পর আমার মনে কুরআন পাঠের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। তারপর আমি কুরআন পাঠ করতে এবং কুরআন বুঝতে শুরু করলাম। এ সময় ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম, চারদিক থেকে সবাই আমাকে সাহায্য করলেন। অনেক আগে এক বন্ধুকে বলেছিলাম, আমাকে নামায শিখিয়ে দাও। সে রাজি হয়নি।

কারণ সে জানতো যে, ইসলাম গ্রহণ করার আগে নামায শিখে কোন লাভ নাই। কিছুকাল আগে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছি। সেই তারিখটি ছিল ৯ই ফেব্রুয়ারী ১৯৯২ সাল। ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দান করায় আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আলহামদু লিল্লাহ।

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত। (বিদেশী জারনাল থেকে অনুবাদ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।