আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অফিসে ব্লগিং বন্ধ এবং আমার ব্লগিং কমিয়ে দেবার ইতিকথাঃ এক ‘নিস্পৃহ মায়াডোরে’ আবদ্ধ হবার গল্প।

সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।

ঘটনাটা ঘটেছে গত রমযানের শেষ সপ্তাহে। এর আগের সপ্তাহ হতে অফিসে মেইন্টেনেন্স জাতীয় বিরক্তিকর কাজ শুরু হয়েছে। লেবারদের হাঁকডাক আর ছুটোছুটিতে মেজাজ এমনিতেই খারাপ। তার উপর কেমিক্যাল্‌সের নন-ষ্টপ উৎকট গন্ধে তো রোজা ভেঙে যাওয়ার যোগাড়।

সার্ভার রুমে যখন কাজ শুরু হলো তখন নিয়ম হল, একজন ইঞ্জিনিয়ার সর্বক্ষন সেখানে থাকবেন। কোন কারনে থাকতে না পারলে অন্যজনকে দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। সেদিন সকাল হতে এক কলিগ কাজ তদারকি করছিল। এগারটার দিকে একটা জরুরী ফোন আসায় সার্ভার রুম হতে বের হয়ে গেল কাউকে কিছু না বলেই। আর এর মধ্যেই ম্যানেজার মহোদয় এসে ঢুকলেন।

মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ঐ সময়ই এক লেবার না জেনে অপ্টিক্যাল ফাইবারের উপর হাঁটুর চাপ দিয়ে কাজ করছিল। আর যায় কোথায়? সার্ভার রুম থেকে বেরিয়েই ম্যানেজার পেলেন আমাকে। দুই মিনিট স্থায়ী ঝড় বইয়ে দিলেন; তারপরেই খেয়াল করিয়ে দিলাম, ওখানে থাকাটা আমার রেস্পন্সিবিলিটির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু, আমার মুখ হতে ও কথা শুনে তাঁর ভাল লাগল না। (মুখের উপর সত্য সবাই সহ্য করতে পারে না!) নিজের রুমে ফিরে গিয়েই অফিস অর্ডার।

আজ হতে অফিসে ব্লগিং বন্ধ! ভাবছেন, এতকিছুর মাঝে ব্লগ এলো কীভাবে? কাহিনী হলো, উনি যখন আমাকে ঝেড়ে চলেছেন তখন আমার মনিটরে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ খোলা অবস্থায় ছিল, যা ভদ্রলোকের চোখ এড়ায় নি। (দুনিয়ার সব ম্যানেজারই বোধকরি এমন। ভাল কিছুই চোখে পড়ে না আর খারাপ কিছুই চোখ এড়ায় না!) বাঙলা লেখা দেখেই ভেবেছেন আমি অফিসে বসে কাজ বাদ দিয়ে ব্লগিং নিয়ে ব্যস্ত! অতএব, ব্লগ বন্ধ। বদনবহি (ফেইসবুক) তো অনেক আগে থেকেই বন্ধ। ব্লগ বন্ধ হবার পর অফিসে নতুন কথা চালু হলো, “এভাবে একের পর এক সাইট ব্লক করতে থাকলে তো একসময় দেখা যাবে, অফিসে পর্ণোসাইট ছাড়া আর সবই ব্লকড্‌।

আমরা সেদিনের অপেক্ষায় আছি। ” যাইহোক, একদিকে, অফিসে ব্লগিং বাদ। অন্যদিকে, এ ঘটনার এক মাস আগে থেকেই বাসার পিসি নষ্ট। সাত বছরের পুরানো পেন্টিয়াম থ্রী টা ধুঁকে ধুঁকে আর চলছিল না। একে মানুষ করতে গেলে একেবারে নতুন পিসি কেনার ধাক্কা।

এদিকে, আবার, ল্যাপ্পি কেনার শখ চেপেছে; (গরীবের হাতি পোষার শখ আর কী!) কিন্তু, এই মূহুর্তে পকেট গড়ের মাঠ। ফলে, সাত মণ ঘি ও যোগাড় হয় না, রাধাও আর নাচে না! এভাবেই বন্ধ হয়ে গেল আমার শখের ব্লগিং। এবার, আসল কথায় আসি। অফিসের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে ব্লগে অনুস্থিতিটাকে জায়েজ করতে চাইলেও আসলে কী তাই? সামহ্যোয়ারইন ছাড়াও সচলায়তন, আমারব্লগ, প্রথম আলোব্লগেও স্বনামে আমার অ্যাকাউন্ট আছে। ওগুলো তো আর অফিসে ব্লকড নয়! তাহলে? মাস দুয়েক আগে যখন ব্লগে আমার একইসঙ্গে দ্বিবর্ষপুর্তি আর পোষ্টের শতক পূর্ণ হল, তখন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলাম, “দুই বছর আগে যখন রেজিষ্ট্রেশন করেছিলাম তখন যদি জানতাম, এর সাথে এভাবে মিশে যাব!- রেজিষ্ট্রেশন করতাম কীনা জানি না! এরপর দেড় বছর নিষ্ক্রিয় অবস্থা, শুধুই পাঠক।

একদিন, হঠাৎ জেগে ওঠা; তারপর হতেই মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য, পোষ্ট, রাজনীতি-অর্থনীতি, সাম্প্রতিক বিষয় বিতর্ক, আস্তিক-নাস্তিক ক্যাঁচাল, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ, নোটিশবোর্ডের উপর সম্মিলিত আক্রমন, ব্যান-ওয়াচ খেলা, উপমা-ডাক্তার মেয়েটার (নাম ভুলে গেছি- ‘নাহিদা’ পরে মনে পড়েছে) পাশে দাঁড়ানো- এমনি করে দিনগুলো যেন স্বপ্নের মত পার করে দিয়েছি। একই ভাষাভাষী এক অনুন্নত জাতির বৃহদাংশের তুলনায় সামান্য বেশী সুবিধাভোগী অংশের একজন সদস্য হিসেবে এ সুবিশাল ভার্চুয়াল সমাজে সক্রিয় থাকতে পেরে নিজেকে প্রায়ই ভাগ্যবান মনে হয়। সহব্লগারদের অনেকেই হৃদয়বান, দেশের প্রতি তাদের মমত্ব রয়েছে, সর্বোপরি বন্ধু বৎসল। এদের বেশীরভাগকেই আমি নিক নেইম ছাড়া আসল নামে চিনি না; জানি না তারা কেমন। কেন যেন আশেপাশে সারাদিন যে সব মানুষের সাথে চলি, মিশি, আলাপ করি তাদের সাথে এই নাম নাজানা ব্লগারদের তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না!” মনে পরে, ক’মাস আগেও ব্লগে ৬০-৭০ জন অনলাইনে থাকলেই খুশী হয়ে যেতাম।

এখন তো ১০০ এর নিচে নামতেই দেখি না। এখনকার মত তখন এত পোষ্ট আসত না। কিন্তু, সমস্যা হল, পোষ্টগুলোতে আগের চেয়ে কমেন্টের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে গিয়েছে। ভালো পোষ্টের অনুপাতও কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। কথাটা পরিসংখ্যানিকভাবে প্রমান করতে আমি অপারগ, চোখের আন্দাজেই বলছি।

এর রহস্য বের করতে গিয়ে যা বুঝলাম, তা হল, অনেক নতুন ব্লগারই এখানে আস্তানা গেড়েছেন যাঁদের অন্যের লেখা পড়ার চাইতে নিজের লেখা অন্যকে পড়াতেই বেশী আগ্রহ। মনে পরে, প্রথম লেখাটা লিখবার আগে আমি কতদিন ভেবেছি! ‘লিখব?’ আর এখন, ‘সেফ হচ্ছি না কেন? ভাল্লাগেনা’- এ বিষয়ের উপরেও একাধিক পোষ্ট দেয়া হয়! বুঝতে পারছি যে, ছোট্ট একটা মফস্বল শহরের গন্ডি পেরিয়ে ব্লগ এখন একটা সুবিশাল ভার্চুয়াল নগরীতে (কসমোপলিটন?) পরিণত হচ্ছে। আগে যেখানে পুরো ব্লগই একটি সম্পর্কের বৃত্তে আবদ্ধ ছিল, এখন সেখানে জন্মেছে ছোট ছোট অনেক গুলো বৃত্ত। মহানগরীতে এটা মেনে নিতেই হবে। পুরানো সেলিব্রেটি ব্লগারদের এতে কোন সমস্যা নেই।

সমস্যা হচ্ছে, আমরা যারা পুরানো নন-সেলেব্রেটি তাদের। অনেকদিন পর পর এসে খোলনলচে পালটে যাওয়া এ নতুন নগরে বড় দিশেহারা ভাব হয়। নতুন মুখ – বেশীরভাগকেই চিনি না। কী বলবো, কীভাবে বলবো- থৈ খুঁজে পাই না। আরেকটা উপদ্রব শুরু হয়েছে ইদানিং।

সহব্লগারের সাথে যে ভার্চুয়াল চেনাজানা ছিল, তা আড্ডা, বদনবহি আর মুঠোফোনের কল্যানে অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত চেনাজানার দিকে এগিয়ে গিয়েছে। খুবই ভাল লক্ষণ। তবে, এক্ষেত্রে কেউ কেউ ভুলে যান, ভার্চুয়ালি একজন মানুষ যেমন হয়ে থাকেন, সাধারনতঃ বাস্তবজীবনে তেমন হন না। ঐ আশায় পড়ে থাকলে, কেবল আশাভঙ্গই হয়। আর সে আশাভঙ্গ হতেই বেশীরভাগ ব্যক্তিগত আক্রমনমূলক পোষ্ট আর ক্যাঁচালের সূত্রপাত।

আমি এসবই এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। তারপরেও কেমন হাঁপ ধরে গিয়েছে। অন্য ব্লগে গিয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করার শক্তি-ধৈর্য কোনটাই নেই এখন। তাই, আগে যেমন করে ব্লগের পাতার পর পাতা উলটিয়ে যেতাম, এখন সে রকম আর পারি না। ক্লান্ত লাগে।

তবু, চেষ্টা করে যাচ্ছি, সাথে থাকবার। পায়ে পা মিলিয়ে চলবার। এ এক আশ্চর্য্য অনুভূতির উদাহরন। লাভ-হেইট রিলেশন নয় তবে, একটা ‘নিস্পৃহ মায়াডোর’ বলা যায়। চলুক না এমন করেই।

যতদিন চালানো যায়। “ ‘চল’ বাহে, কুন্‌ঠে সবাই?”

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।