আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যশোরের চিঠি: হা ঈশ্বর! আমার দুঃস্বপ্নটা মিথ্যে করে দাও...

শেষ বলে কিছু নেই

উৎসবের শুরু গতকাল থেকে। উচ্ছেদের উৎসব। গতকাল বিকেলে দেখেছিলাম দড়াটানা ব্রিজের উত্তর পাশে রাস্তার দুপাশের ফলের দোকান, পাখি আর চায়ের দোকান ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আমি একজন মানবাধিকার কর্মী, উচ্ছেদ দেখলে বুক কেঁপে ওঠে। যদিও উচ্ছেদোৎসবটা চলছে আইনের সামিয়ানার নিচে, তথাপি বুক কাঁপাটা থামে না।

কারণ বাংলদেশে এযাবৎ যতগুলো আইনী উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সর্বহারা শ্রেণীর মানুষ। গতকাল বিকেলে বুক কেঁেপছে ঠিকই, কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটাকে বুকের ভেতর ফেনিয়ে তুলে কম্পনকে চাপা দিয়ে ঘরে ফিরে গেছি। কিন্তু সকালে অফিসে এসে মৃতপ্রায় বুড়ি ভৈরবের উপর ঝুলে থাকা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যখন দেখলাম নদীর ওপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে বৃক্ষ নিধন চলছে- হৃদপিন্ডটা ফের লাফিয়ে উঠল। আমি ঘটনা সম্পর্কে ইন্টারকমে আমার এক সাংবাদিক সহকর্মীকে অবগত করতে উনি আমাকে বললেন, অপারেশনটা নদী রক্ষার। দুপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ চলছে।

নদীকে খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। নিঃসন্দেহে ধন্যবাদার্হ প্রচেষ্টা। আমি প্রায় ২০ বছর ধরে লেখাপড়া এবং কর্মসূত্রে ঢাকাতে থাকার পর বছর খানেক হল রাইটস যশোর নামক মানবাধিকার সংস্থায় চাকরী নিয়ে যশোরে এসেছি। অফিসটা আর এস ভবনের তিন তলায়। অফিস বিল্ডিংটাই অনেকখানি নদীর ভেতর সেঁধোনো।

প্রথম দিনেই ব্যালকনি থেকে মৃতপ্রায় বুড়ি ভৈরবের জীর্ন চেহারা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারি নি। আমি নদী-প্রেমিক মানুষ। নদীর বুকের কষ্ট-কান্না আমি শুনতে পাই। একটা কবিতাও লিখেছিলাম সেদিন। বুড়ি ভৈরবকে জেগে উঠতে বলেছিলাম।

সেই নদীকে বঁচাবে বলে প্রশাসন কাছা দিয়ে নেমেছে। এর চেয়ে ভাল খবর আর কী হতে পারে? কিন্তু মনটাকে স্থির করতে পারছি না। আমার দ্বান্দ্বিক মনে অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করছে। প্রথমেই বৃক্ষ নিধন কেন? একটা একটা করে চোখের সামনে পয়মন্ত নারকেল গাছ শুয়ে পড়ছে মাটিতে; শুয়ে পড়ছে কলা গাছের ঝাড়, হিজল গাছ। আমার বিল্ডিংটাও তো নদীর ভেতরে সেঁধোনো।

আমাদের পাশের বিল্ডিং একটি নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল। হাসপাতালের পেছনে হাসপাতালেরই বর্ধিত অংশের বহুতল বিল্ডিং উঠছে একেবারে নদীর সানুদেশে। তারা কি বৈধ? যদি বৈধ না হয়, তাহলে কারা বেশি অবৈধ? স্থাপনা না বৃক্ষ? আমার সহকর্মী আমাকে বলেছেন, এর আগেও নাকি এরকম নদী বাঁচানোর তৎপরতা হয়েছে। কিন্তু বিগউইগদের (রাঘববোয়াল) প্রতি-তৎপরতায় মাঝপথেই থেমে গেছে প্রচেষ্টা। এবার কী হবে? সফল হবে নদী বাঁচানোর এই প্রকল্প? আমি স্বপ্ন দেখছি....বুড়ি ভৈরব পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।

কলকল খলখল করে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। জলের টানে আটকে পড়া কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে। নদীর উপর নেমে আসছে পেশাচ্যুত ধীবরেরা। নৌকো চলছে। ঘাটে ঘাটে মানুষেরা গোসল করতে নামছে।

বিকেলে শহরবাসী নদীর জলে নিজেদের মুখ দেখে ক্লান্তি ঝেড়ে চনমনে মন দিয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে। নদী প্রেমিক পাখিরা ফিরে আসছে একে একে। পানকৌড়ি মাছরাঙাদের দল। তীর ধরে ছুটে যাচ্ছে একদল দূরন্ত কিশোর... কিন্তু কি হবে যদি বিগউইগদের প্রতি-তৎপরতায় মাঝপথেই থেমে যায় প্রচেষ্টা? এতদিন মরা নদী দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে বৃক্ষদের দিকে তাকিয়ে শান্তনা খুঁজেছি। নদী নেই, গাছ তো আছে।

জল নেই, খানিকটা সবুজ তো আছে। কিন্তু সবুজদের অধিক অবৈধ বিবেচনা করে তাদেরই আগে উচ্ছেদ করা চলছে। এরপর তৎপরতা থেমে গেলে কী হবে আমার? কাজ করতে করতে কান্ত হয়ে দৃষ্টিটাকে দু’দণ্ড কোথায় রাখব তখন? আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি: নিচে মরা নদীর চিমসে শরীরখানা, বাসি-পচা আবর্জনায় ঢেকে আছে; উপত্যকার উপর কুয়াশার মত ঝুলে আছে দুর্গন্ধের হলুদ আস্তরণ। ওদিকে কতিপয় গাছের গুড়ি আর সবুজের ধ্বংসাবশেষ গিলে খাচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা। হা ঈশ্বর! আমার দুঃস্বপ্নটা মিথ্যে করে দাও।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.